১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট মাঝরাতে পার্লামেন্টের সেন্ট্রাল ভবন এবং লাল কেল্লার লাহৌরি গেটে জওহরলাল নেহরু পরম আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীন ভারতের তেরঙ্গা পতাকা উড়িয়ে দিতেই প্রায় দুই শতকের পরাধীনতার গ্লানি পিছনে ফেলে ভারতবর্ষ স্বাধীন হল। নেহরুর সঙ্গে সেদিন উপস্থিত ছিলেন স্বাধীনতার আন্দোলনে পথিকৃৎ তাঁরই দলের বিশিষ্টরা আর লাখো আমজনতা। একই দিনে লর্ড মাউন্টব্যাটন নেহরুকে প্রধানমন্ত্রিত্বের এবং অন্যান্য ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের শপথ বাক্য পাঠ করান। শপথ নেন স্বাধীন ভারতের প্রথম এবং শেষ গভর্নর জেনারেল (ভাইসরয়ের পরিবর্তিত ভারতীয় নাম) চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী। আন্দোলনে ঝড় তোলা বিপ্লবী এবং মন্ত্রিসভার সদস্যদের মনে তখন সুশাসন নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল এবং সেজন্যই রাজ্যে রাজ্যে গড়া সরকার কেমন হবে তা নিয়ে সরকারকে সঠিক পথ দেখাতে লর্ড মাউন্টব্যাটনকে ভাইসরয় পদে রেখে দেয় ২১ জুন ১৯৪৮ পর্যন্ত।
আরও পড়ুন-শংকরের শ্রীরামকৃষ্ণ
স্বাধীনতার পরে ভারতীয় সংবিধান রচনা হল এবং তা গ্রহণের পর ১৯৫১ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে শুরু করে ১৯৫২-র ২১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে লোকসভা এবং রাজ্যগুলিতে নির্বাচন হয়। লোকসভার ৪৮৯ আসনের মধ্যে জাতীয় কংগ্রেস ৩৬৪টি আসন দখল করে এবং জওহরলাল নেহরু ভারতবর্ষের প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন।
আমাদের বিশাল এই দেশ ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার সময় শাসন ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত জটিল। ৪টি বড় রাজ্যসহ ২১টি রাজ্যে থাকলেও দেশজুড়ে ৫৬৫টি প্রিন্সলে রাজ্য ছাড়াও হাজারো জাগির-জমিদারি শাসন ব্যবস্থা ছিল। তাদের এলাকা ছিল গোটা ভারতবর্ষের এলাকার প্রায় ৪০% এবং জনসংখ্যা ২৩%। তাদের আয়তন, স্ট্যাটাস এবং ধনসম্পদও ছিল ভিন্ন মাপের। ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত মোটের উপর শান্তিপূর্ণভাবে প্রিন্সলে রাজ্যগুলি স্বাধীন ভারতের সঙ্গে জুড়তে থাকে। কেবলমাত্র পাকিস্তান সেনার হামলার পরিপ্রেক্ষিতে জম্মু-কাশ্মীর ভারতবর্ষের সঙ্গে জুড়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি ছিল জটিল। প্রিন্সলে রাজ্যগুলি জুড়ে যাওয়ার সময় তাদের স্ট্যাটাস অনুযায়ী সরকারি ভাতার ব্যবস্থা ছাড়াও সেই শাসকদের সুযোগ-সুবিধা, সম্মান এবং তাদের রাজ্যের কিছুটা অভ্যন্তরীণ অটোনমি দেওয়া হয়। তাদের রাজাদের রাজ্যের গভর্নরের মর্যাদার সমতুল ‘রাজপ্রমুখ’ উপাধি দেওয়া হয়। ১৯৫৬ সালে ‘রাজপ্রমুখ’ উপাধির সমাপ্তি ঘটলেও সরকারি ভাতা চলতে থাকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত।
আরও পড়ুন-বিদ্যুতের চরম সংকট! পাকিস্তানে বিয়ের অনুষ্ঠানেও কড়া নির্দেশ
বেশ কয়েকদিন হল পশ্চিমবঙ্গ-সহ কয়েকটি রাজ্যে রাজ্যপালের পরিবর্তে মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির চ্যান্সেলর হওয়ার প্রস্তাব প্রসঙ্গে সংবাদমাধ্যম এবং কিছু বিদ্বজ্জনদের মধ্যে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় এটি নেহাতই দীর্ঘদিনের ব্রিটিশ কালচার। ১৮৫৪ সালে প্রথমবার ‘প্রেসিডেন্ট অফ দ্য বোর্ড অফ কন্ট্রোল অফ ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র স্যার চার্লস উড-কে এক্স-অফিসিও চ্যান্সেলর করা হয় ‘দ্য ম্যাগনা কার্টা অফ ইংলিশ এডুকেশন ইন ইন্ডিয়া’তে। ওই বছর গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসিকে তাঁর পাঠান ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার ‘ম্যাগনা কার্টা’ (প্রধান দলিল) ‘উডস্ ডিসপাচ অন এডুকেশনের’ মাধ্যমে ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় পশ্চিমের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থায় আমুল পরিবর্তন আসে। ১৮৫৭ সালে ক্যালকাটা, বম্বে এবং ম্যাড্রাস বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তখনকার ব্রিটিশ মডেল অনুসরণ করে গভর্নরকেই চ্যান্সেলর করা হয়। এই পদ সাংবিধানিক হলেও ‘অর্নামেন্টাল’এবং আজও একই ধারা বহমান।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্র ছাড়াও রাজ্যগুলি নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার গড়তে থাকে এবং রাজ্যগুলিও পেয়ে যায় তাদের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী। সময় গড়াবার সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষের নিজস্ব যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আবর্তিত হয়ে গণতন্ত্র যত মজবুত হয়েছে রাজ্যপালদের ভূমিকা দিনে দিনে ততটাই প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে।
আরও পড়ুন-দেশ জুড়ে বাড়ছে সংক্রমণ, করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৮ হাজার ছাড়াল
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের সবচাইতে জনপ্রিয়, বিচক্ষণ এবং বরিষ্ঠ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বই শুধু নন, রাজ্যের মানুষ এবং মাটি, মানুষের ভাবাবেগ, তাদের উন্নয়ন, শিক্ষা, আশা-আকাঙ্ক্ষা থেকে শুরু করে রাজ্যের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের রূপরেখা মুখ্যমন্ত্রীকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। তিনি মাঠে নেমে নির্বাচন লড়ে তাঁর দলকে নেতৃত্ব দিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়ে বিধানসভায় প্রবেশ করেছেন। কিছু মুগুরভাঁজা-ব্যক্তিভজা ব্যক্তি দিল্লি থেকে উড়ে গিয়ে কোনও ছোটখাটো অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসতেই পারেন তবে এমন ঘটনা বিরল এবং ব্যতিক্রমী।
অনেকেই মনে করেন রাজ্যপালের পদ মানবদেহের কোলনে থাকা অপ্রয়োজনীয় অ্যাপেনডিক্সের মতো। ‘ভেস্টিজিয়াল প্রভিশনের’ এর মতো যতই অপ্রাসঙ্গিক হোক এই পদের নিয়োগ থেকে শুরু করে কার্যকলাপের বিবরণী দিয়ে অনেকগুলি ধারা স্বাধীন ভারতবর্ষের সংবিধানে ঠাঁই পেয়েছে।
আরও পড়ুন-ক্রশভোটিং, বরখাস্ত কুলদীপ
বিসমিল্লায় গলদের মতো রাজ্যপাল নিয়োগের গলদ থেকেই বোধহয় বিভ্রান্তির উৎপত্তি। অকেজো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে অবসরপ্রাপ্ত এবং বাধ্য আমলা কিংবা আর্মি অফিসারদের অবসরকালীন প্যাকেজ দিতে রাজ্যে রাজ্যে পাঠানো হয় রাজ্যপাল করে। বিরোধী দল পরিচালিত রাজ্য সরকার থাকলে রাজ্যে পৌঁছেই ছলে বলে কৌশলে কেন্দ্রের অদৃশ্য অঙ্গুলি হেলনে রাজ্য সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করে কেন্দ্রের প্রশংসা কুড়ানোর প্রতিযোগিতা কমবেশি শুরু করে দেন প্যাকেজ পাওয়া রাজ্যপালরা। সংবিধানে সতর্কবাণী রয়েছে কিছু ব্যতিক্রমী সিচুয়েশন ছাড়া রাজ্যপালরা মূলত রাজ্য সরকারের কাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করবেন, কিন্তু বাস্তবে তাঁদের কাজকর্ম নিয়ে বারে বারে প্রশ্ন উঠছে। মানুষ রাজ্যপালের উপর অবশ্য কমবেশি নির্ভর করে সরকারকে বিব্রত করার মাত্রাটি। পশ্চিমবঙ্গকে পাঁচ বছরের লিজে পাওয়া ২৩তম কেন্দ্রীয় প্রতিভূ আমাদের বর্তমান রাজ্যপাল শ্লথ গতিতে হেঁটে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছেন।
আরও পড়ুন-অস্ত্র ও ত্রাণসামগ্রী পাঠান বিশ্বের কাছে আর্তি জেলেনস্কির
পদের সুবাদেই রাজ্যপাল রাজ্য সরকার পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ‘ভিজিটর’। তিনি রাজ্য সরকারের সুপারিশের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উপাচার্য নিয়োগ ছাড়াও ‘কনভোকেশনে’ সভাপতিত্ব করেন, সরকারের পরামর্শমতো সেনেট, সিন্ডিকেট, বোর্ড অফ ম্যানেজমেন্ট, সিলেকশন কমিটি এবং অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে প্রতিনিধিদের নিয়োগ করেন। গুজরাটে আবার রাজ্য সরকার সরাসরি উপাচার্য নিয়োগ করে। কেরলে রাজ্যপাল নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য পদ থেকে সরে দাঁড়াবার। তামিলনাডুতে সরকারের সঙ্গে রাজ্যপালের মতপার্থক্যের কারণে সেখানে আইন পাশ করে রাজ্যপালের হাত থেকে উপাচার্য নিয়োগের ক্ষমতা নিয়ে নেওয়া হয়েছে। মহারাষ্ট্রেও রাজ্যপালের আচার্য পদে নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ, আমাদের রাজ্যে প্রায়শই রাজ্যপাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলির দৈনন্দিন কাজে মাথা ঘামাতে পছন্দ করেন এবং মাঝে মাঝেই তাঁর ক্ষমতার ব্যবহার (?) করে বিভিন্ন সুপারিশ এবং বিল আটকে দেন। তাই রাজ্য সরকার রাজ্যপালকে আচার্য পদ থেকে সরাবার জন্য আইন প্রণয়ন করতে চলেছে। ২০১০ সালে ‘পাঞ্ছি কমিশনের’ সুপারিশ ছিল তেমনটাই। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সরকার শিক্ষা-সহ সর্বস্তরের কাজে গতি আনতে চায় এবং মনে করছে বিশ্ববিদ্যালয়য়ের কাজে রাজ্যপালের ‘রেগুলার’ কোয়ারি অপ্রয়োজনীয় এবং সরকারের কাজের পরিপন্থী।
আরও পড়ুন-অস্ত্র ও ত্রাণসামগ্রী পাঠান বিশ্বের কাছে আর্তি জেলেনস্কির
স্বাধীনতা-উত্তরকালে গঙ্গা দিয়ে যত জল গড়াতে থাকে ততই বিতর্কের ঝড় সঙ্গে নিয়ে রাজ্যপালের ভূমিকা আতশকাচের নিচে চলে আসে! অনেকেই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন, স্বাধীন ভারতের ভাইসরয়ের খণ্ডিত উত্তরসূরির আদৌ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কি না! সংবিধান ড্রাফটিং কমিটির প্রধান ড. ভীম রাও আম্বেদকর বলেছিলেন, রাজ্যপাল ‘রাজনৈতিক দলের’ নয় বরং রাজ্যের সমস্ত মানুষের প্রতিনিধিত্ব করবেন। তাঁর ‘ডিস্ক্রিশনারি পাওয়ার’ কেবলমাত্র বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া অপব্যবহার না করে মুখ্যমন্ত্রী এবং মন্ত্রীমণ্ডলীর সুপারিশগুলি শ্রদ্ধার সঙ্গে কার্যকর করবেন। সাংবিধানিক আইন বিশেষজ্ঞ পি এস দেশমুখ, টি টি কৃষ্ণমাচারী কিংবা ননী আর্দেশির পাল্কিওয়ালা ছাড়াও অনেকে বললেন, রাজ্যপাল সাধারণ মানুষের জন্য গৃহীত সংবিধানের ম্যান্ডেটের ‘প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য’ রক্ষা করবেন। স্বাধীনতার কয়েকবছর পর থেকেই বিতর্ক এড়িয়ে সুষ্ঠু সমাধানের জন্যই উদ্যোগে খামতি ছিল না, তাই এই নিয়ে কমিটি আর কমিশনও গঠিত হয়েছে অনেক।
আরও পড়ুন-পূর্ণিয়াতে পুকুরে গড়িয়ে পড়ল স্করপিও, মৃত ৯
১৯৮৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রঞ্জিত সিং সারকারিয়াকে চেয়ারম্যান করে কমিশন গঠন করে কেন্দ্র-রাজ্যে সম্পর্কের লক্ষ্মণরেখার হদিশ দিতে। এই কমিশন ১৯৮৮ সালে যে রিপোর্ট দিয়েছিল তাতে ২৪৭টি সুপারিশ ছিল, যার মধ্যে রাষ্ট্রপতি রাজ্যপাল নিয়োগের আগে দেশের প্রধানমন্ত্রী অন্য রাজ্যের কোনও বিশিষ্টজন (যিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে বেশ কিছুদিন দূরে থাকার সুবাদে স্থানীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠেছেন এমন ব্যক্তি) উপরাষ্ট্রপতি, লোকসভার স্পিকারের সঙ্গে পরামর্শ করা ছাড়াও বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে সহমতের ভিত্তিতে (নিত্য প্রয়োজনের কারণে মুখ্যমন্ত্রীর মতামত নেওয়াটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রস্তাব রাখেন) রাষ্ট্রপতিকে রাজ্যপাল পদের জন্য সুপারিশ করবেন যাতে সরকারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রাজ্যপালরা কাজ করেন। রাজ্যে রাজ্যপাল দেখবেন সরকার গঠন হচ্ছে কি না কিন্তু তিনি নিজে সরকার তৈরির চেষ্টা করবেন না। ভূভারতের সংবিধানের এমনটাই ছিল নিদান।
আরও পড়ুন-কিপিং গ্লাভস! শাস্তি বাবরের
সারকারিয়া কমিশনের পরে ২০০৭ সালে তৎকালীন ইউপিএ পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি মদনমোহন পাঞ্ছিকে চেয়ারম্যান করে আরও একটি কমিশন গড়ল সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা, ট্যাক্স, সংবিধানের ৩৫৫ ধারার প্রয়োগ, জরুরি অবস্থার ঘোষণা, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা-সহ পঞ্চায়েতি রাজ লাগু করা ইত্যাদি ছাড়াও অবশ্যই রাজ্যপালের ভূমিকা সহ কেন্দ্র-রাজ্যের সম্পর্কের গণ্ডি ঠিক করতে। ২০১০ সালে পাঞ্ছি কমিশন সাত খণ্ডের রিপোর্টে ৩১২টি সুপারিশ পেশ করে। পাঞ্ছি কমিশন সারকারিয়া কমিশনের সুপারিশকে সমর্থন করে জানিয়ে দেয় অবশ্যই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষে রাজ্যপাল নিয়োগ করতে হবে এবং সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন এমন ব্যক্তিকে রাজ্যপাল করা যাবে না।
আরও পড়ুন-দিল্লির হাসপাতালে আগুন, মৃত এক
আমাদের বর্তমান রাজ্যপালকে নিয়োগের আগে আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আলোচনা করেছিলেন, এমনটা শোনা যায়নি। এই নিয়োগের অনুমান ‘গ্যালাপ্যাগোস’ কচ্ছপের পক্ষেও করা সম্ভব হয়নি। রাজ্যপাল তাঁর ‘হিজ এক্সেলেন্সি’ পদের সঙ্গে বেমানান বলে ভূরিভূরি অভিযোগই শুধু ওঠেনি, নানান নামে ভূষিত হয়েছেন এবং রাজভবনকে বহুলাংশে তাঁর দিল্লির প্রভুদের শাখা কার্যালয়ে পরিণত করেছেন, এমন অভিযোগ আমজনতাও আজকাল করে। পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের এই অভিযোগ এবং সন্দেহ রাষ্ট্রের কাছে বড়ই বেদনাদায়ক এবং অগৌরবের!
সার্চ কমিটির অনুমোদনের পরও নানান অজুহাতে দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ ঝুলিয়ে রাখা কিংবা নানান অজুহাতে রাষ্ট্রপতির পর্যবেক্ষণের জন্য সিদ্ধান্ত ‘রিজার্ভ’ রাখা থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিল আটকে রেখে সরকারি কাজে বিলম্ব সৃষ্টি করা বড়লাটের কাজের পরিপন্থী। কথায় কথায় মুখ্যমন্ত্রীকে কিংবা অন্যান্য মন্ত্রী, চিফ সেক্রেটারি, ডিজিপি নয়তো পুলিশ কমিশনারকে ডেকে পাঠানোর মধ্যে একটা যেন ‘কেমন দেখিয়ে দিলাম’ গোছের পাড়ার মস্তানদের মতো মনোভাব প্রকট হয়ে ওঠে যা রাজ্যপালের পদের মর্যাদা এবং গৌরবের পক্ষে বড্ডই বেমানান।
বছরখানেক আগের কথা, পশ্চিমবঙ্গের মাননীয় রাজ্যপাল দিল্লির প্রভুদের নির্দেশে সদ্য নির্বাচিত সরকারের প্রধান মুখ্যমন্ত্রীকে কষ্টকল্পিত নির্বাচন-পরবর্তী হিংসার উল্লেখ করে কড়াভাষায় চিঠি দিলেন। সংবিধান রাজ্যপালকে এইভাবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনগণ দ্বারা নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দেওয়ার অধিকার দিয়েছে? সরকারের প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপে প্রতিবাদ করা ডান-বাম বিরোধীরাও বিপুল জনাদেশ পেয়ে মাস দেড়েক আগে সরকার গড়া দল তৃণমূলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে শোরগোল ফেলে দেয়, এই রাজ্যপালকে কেন্দ্র ফেরত নিক, কারণ উনি বিশেষ একটি দলের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিষ্টাচার, পবিত্রতা এবং গৌরব নষ্ট করে মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা চিঠি ‘ট্যুইট’ করে আমজনতাকে জানিয়ে দিয়েছেন। কট্টর ডানপন্থীরাও অতটা আশা করেনি, আড়ালে বলল, ‘ইনকি নিয়তমে খোট হ্যায়’।
আরও পড়ুন-সোনিয়াকে তলব
ট্যুইট করে আমজনতার চেতনাকে এমন একটা কল্পিত বিষয়ে জাগ্রত করার মধ্যে কতটা তাঁর মানব দরদ কাজ করেছে তা এই বাংলার মানুষ অনুমান করতে না পারলেও তিনি যে ভোটে একটি নির্দিষ্ট দলের পরাজয় সহ্য করতে না পেরে এমন কাণ্ডটি করেছেন তা তাঁর শারীরিক ভাষাতেও প্রকট হয়েছিল বলেই সবাই বুঝতে পারে। তাই তারা প্রকাশ্যে মুচকি হেসে ফেলে। আবারও একবার রাজ্যপালের ভুমিকা নিয়ে বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন দেখা দেয় যা শুধু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে তা নয়, রাজ্যের সম্মানহানিও ঘটিয়েছে।
স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তিতে কেন্দ্রীয় সরকারের ঘটা করে ‘আজাদি কি অমৃত মহোৎসবে’ নূপুরের আওয়াজে সরগরম, অমৃতের বদলে গরল যখন উঠছেই তখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে চ্যান্সেলর করে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের পথে রাজ্য এগিয়ে গেলে তা শুধু গৌরবের নয়, মানুষও হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে পারে।