পৃথিবীর গভীর, গভীরতর অসুখ দেখা দিয়েছিল তখন। সময়টা ছিল কোভিড-১৯ অতিমারির। মানুষ ভুগছে। মানুষ মরছে। তখন, তখনই, মানুষের আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তাকে মূলধন করে ব্যবসা ফেঁদেছিল গুটিকয়েক ওষুধ কোম্পানি। তাদের অন্যতম হেটেরো ল্যাব আর হেটেরো হেলথকেয়ার। কোভিডের বাজারে রমরমিয়ে বিক্রি হচ্ছিল তখন রেমডিসিভি।
আরও পড়ুন-চাকরি কই? আশঙ্কায় আইআইটি বম্বের পডু়য়ারা
আর ঠিক তখনই মহারাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নোটিশ ধরায় সংস্থাটিকে। কারণ, তাদের ল্যাব টেস্টে ধরা পড়েছিল একটা বড় রকমের গরমিল। রেমডিসিভি-তে থাকার কথা স্বচ্ছ তরল। কিন্তু তার বদলে রয়েছে এমন একটি তরল যেটার রং হলুদ। ২০২১-এর জুলাই মাসে তাই মহারাষ্ট্র খাদ্য ও ওষুধ নিয়ামক সংস্থার তরফে নোটিশ পাঠানো হল হায়দরাবাদের এই ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাটিকে।
তিন মাসের মাথায় আবার ধরা পড়ল অনিয়ম। এবারও ওই মহারাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এর গবেষণাগারের নজরে পড়ল সেটা। যতটা পরিমাণ ওষুধ থাকার কথা তার চেয়ে বেশ খানিকটা কম পরিমাণ ওষুধ ভরা হয়েছে শিশিগুলোতে। অ্যান্টি ভাইরাল ড্রাগ হিসেবে তখন বাজারে দেদার বিকোচ্ছে রেমডিসিভি। বেশি পরিমাণ ওষুধের দামে মুনাফা লুটছে প্রস্তুতকারক সংস্থা, অথচ মানুষ পাচ্ছে কম পরিমাণ ওষুধ। সোজা কথায়, ঠকানো হচ্ছে তাদের। তাই নোটিশ ইস্যু করা হল ২০২১-এর অক্টোবরে হেটেরো ল্যাব হেটেরো হেলথকেয়ারের বিরুদ্ধে।
আরও পড়ুন-অভিষেকের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠকে চাঙ্গা দলীয় নেতৃত্ব
দু’মাসের ভেতর, ডিসেম্বর, ২০২১-এ গেল তৃতীয় নোটিশ। ল্যাব টেস্টে দেখা গিয়েছে, রেমডিসিভির তৃতীয় নমুনাটাও জঘন্য মানের। তাই এই নোটিশ প্রেরণ।
তিন-তিনবার নোটিশ পাঠানো সত্ত্বেও তেলেঙ্গানার ড্রাগ রেগুলেটর কোনও পদক্ষেপ করেনি হেটেরোর বিরুদ্ধে। তিন-তিনবার ল্যাব টেস্টে ফেল করল রেমডিসিভি। অথচ সেটার বিক্রি বন্ধ হল না! প্রস্তুতকারক সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ তো দূর অস্ত্।
শুধু রেমডিসিভির নয়, ওই একই ওষুধ সংস্থার আরও দুটো ওষুধের গুণমান নিয়ে ততদিনে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। এক, ইটবর ক্যাপসিউল, ছত্রাক সংক্রমণ প্রতিরোধের ওষুধ। দুই, মোনোসেফ, এটি ব্যাকটেরিয়াজাত সংক্রমণ ঠেকানোর ওষুধ।
২০২১-এর এত গন্ডগোল, এত গোলমাল, সব থেমে গেল ২০২২-এ। সে-সময় নয়া অর্থবর্ষ শুরু হওয়ার পর পরই, এপ্রিল মাসে হেটরো ৩৯ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনল। ২০২৩-এর অক্টোবরের মধ্যে তাদের ইলেক্টোরাল বন্ড কেনার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াল ৬০ কোটি টাকায়।
আরও পড়ুন-আবার ভারতীয় পড়ুয়ার রহস্যমৃত্যু, মার্কিন মুলুকে, প্রশ্নের মুখে নিরাপত্তা
এই বন্ড না কিনে বোধ হয় উপায় ছিল না হেটরো ল্যাব আর হেটরো হেলথকেয়ারের। ছ’টি রাজ্যে একযোগে আয়কর হানার মুখে পড়েছিল সংস্থাটি। তাদের অফিস থেকে উদ্ধার হয়েছিল ৫৫০ কোটি টাকা। পুরোটাই হিসাব-বহির্ভূত সম্পদ, জানিয়েছিল আয়কর দফতর। তারা যে নগদ উদ্ধার করেছিল ছ’টি রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা হেটরোর অফিসগুলো থেকে, তার পরিমাণ ১৪২ কোটি টাকা। প্রচুর নথিপত্র, ইউএসবি ড্রাইভ, ডিজিটাল মাধ্যম বাজেয়াপ্ত করল আয়কর দফতর।
কিন্তু এপ্রিল, জুলাই আর অক্টোবর, তিন লপ্তে মোট ৬০ কোটি টাকার ইলেক্টোরাল বন্ড কেনার পর সব চুপচাপ। কেন্দ্রীয় সরকারের মুখে কুলুপ। আয়কর দফতরও নড়াচড়া বন্ধ করে দিল।
আরও পড়ুন-ভূপতিনগরে হামলার শিকার এনআইএ, বিজেপির রাজনীতি ও প্ররোচনার ইঙ্গিত দিলেন কুণাল ঘোষ
কী এই নির্বাচনী বন্ড যা তথাকথিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাবৎ অভিযানে লাগাম পরাতে সক্ষম?
২০১৮-তে প্রথম নির্বাচনী বন্ড বা ইলেক্টোরাল বন্ড বাজারে আসে। মোদি সরকার বলেছিল, রাজনৈতিক দলগুলোকে নগদে অনেকে চাঁদা দেন। সেটাই এবার থেকে বন্ডের মাধ্যমে দেওয়া যাবে। রাষ্ট্রনৈতিক দলগুলো বন্ড কেনার ১৫ দিনের মধ্যে তাদের ঘরে জমা পড়া বন্ড ভাঙিয়ে নেবে নিজেদের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে। কোনও দল তা যদি না করে তবে ওই অর্থ চলে যাবে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে। এতে নাকি রাজনৈতিক দলগুলিকে তহবিলে চাঁদা দেওয়ার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আসবে।
কী স্বচ্ছতা এল? কেমন স্বচ্ছ এই ব্যবস্থা?
মোদি সরকারের সৌজন্যে এই ব্যবস্থা যে আদতে তোলাবাজির নামান্তর, দুর্নীতির প্রতিষ্ঠানিকীকরণ, তা প্রমাণ হয়ে গেল বন্ড ক্রেতাদের নাম সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে, বহু টালবাহানার পর, সামনে আসতেই। দেখা গেল হেটেরোর মতো অনেক ওষুধ কোম্পানিই কোটি কোটি টাকার বন্ড কিনে তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো ধামাচাপা দেওয়ার বন্দোবস্ত করেছে। বন্ডের মাধ্যমে মোদি বাহিনীকে টাকা জুগিয়ে খারাপ মানের ওষুধ বাজারে বিক্রি চালু রেখেছে।
আরও পড়ুন-স্মৃতির মহানায়িকা
ভারতে এসেছিলেন অস্ট্রেলীয় চিকিৎসক গবেষক ডেভিড বার্গার। এদেশে ছিলেন প্রায় এক বছর। সব দেখেশুনে ওঁর উপলব্ধি, প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এক ধরনের অনৈতিকতা চিকিৎসা পরিষেবার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে।
দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছার।
কথাটা যে কতটা খাঁটি তা বোঝাই যাচ্ছে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিজেপির তোলাবাজির উদ্যোগে ওষুধ কোম্পানিগুলোর শামিল হওয়ার ঘটা দেখে। কার্যত, নিজেদের খারাপ মানের ওষুধ বাজারে চালিয়ে মুনাফা লোটার তাগিদে তারা এই বন্ডের খেলায় নাম লিখিয়েছে এবং এ-ব্যাপারে হেটেরো-কাণ্ড কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং, একটা বিরাট দুর্নীতি-রুটির সামান্য একটা টুকরো মাত্র। হিমশৈলের চূড়া।
কোম্পানির নাম গ্লেনমার্ক। বাজারে চলে এদের ব্লাড প্রেসারের ওষুধ টেলমা। সেই ওষুধ ল্যাব টেস্টে ফেল করল। একবার নয়, বারবার। ২০২২-’২৩-এর মধ্যে পাঁচবার সেই মর্মে নোটিশ গেল কোম্পানির কাছে। নভেম্বর, ২০২২-এ ৯ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকার বন্ড কিনে গ্লেনমার্ক ব্যাপারটা সামাল দিল।
কোম্পানির নাম সিপলা। হেটেরোর মতো তাদের রেমডিসিভিও ল্যাব টেস্টে পাশ করতে পারেনি। তাদের ওষুধেও ওষুধের শিশির গায়ে উল্লিখিত ওষুধের পরিমাণের সঙ্গে শিশির ওষুধের সঠিক পরিমাণ মেলেনি। বেশি দাম নিয়ে কম ওষুধ কিনিয়ে মানুষ ঠকানোর চক্রান্ত। ২০২১-এর জুলাইয়ে দু’-দু’বার নোটিশ খেল সিপলা। ২০২২-এর নভেম্বরে তারা কিনে ফেলল ২৫ কোটি ২০ লক্ষ টাকার বন্ড। ব্যস! সব চুপচাপ। এর আগে ২০১৮-র অগাস্টে তাদের কাশির সিরাপ ল্যাব টেস্টে ফেল করেছিল। মোদি সরকার বন্ড ব্যবস্থা চালু করার পরই ২০১৯-এ ১৪ কোটি টাকার ইলেক্টোরাল বন্ড কিনে তারা পরিস্থিতির সামাল দেয়।
আরও পড়ুন-‘ক্ষমতা থাকলে লড়াই করে জেত’ এনআইএ’র আচরণ নিয়ে ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী
কোম্পানির নাম টোরেন্ট ফার্মা। মোদি-শাহর গুজরাতের ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা। তাদের ডেপল্যাট-১৫০ অ্যান্টিপ্লেটলেটের জনপ্রিয় ওষুধ। ২০১৮-তে মহারাষ্ট্র ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সেই ওষুধকে ‘নিম্নমানের’ বলে জানিয়ে দেয়। কারণ, ওষুধটি স্যালিসাইকিলিক অ্যাসিড টেস্টে পাশ করেনি। ২০১৯-এর সেপ্টেম্বরে আবার ধাক্কা খায় টোরেন্ট ফার্মা। গুজরাতের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন জানায় তাদের লোসার এইচ কে-র মান ‘অতি খারাপ’। লোসার এইচ কে হল টোরেন্ট ফার্মার লো ব্লাড প্রেসারের ওষুধ। ২০২১-এর ডিসেম্বরে আবারও ধাক্কা। টোরেন্ট ফার্মার হার্টের অসুখের ওষুধ নিকোরান এলডি-র গুণমান ঠিক নেই বলে জানায় মহারাষ্ট্র ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। ২০২৩-এর ফেব্রুয়ারিতে টোরেন্ট ফার্মার লোপামাইড ল্যাব টেস্টে ফেল করে ‘নিম্নমানের’ তকমা পায়। লোপামাইড ডায়েরিয়া সারানোর ওষুধ।
রক্তচাপ কমের ওষুধ থেকে হৃদরোগের দাওয়াই, এমনকী পেট খারাপের ওষুধও ফেল। তাহলে উপায়? উপায় বাছতে ভুল করেনি টোরেন্ট ফার্মা। ২০১৯-এর মে মাস থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত তারা ইলেক্টোরাল বন্ডে ঢেলেছে প্রায় ৭৮ কোটি টাকা। ফেল করা ওষুধকে পাশ করানোর মোক্ষম দাওয়াই।
কোম্পানির নাম জাইডাস হেলথকেয়ার। এটাও মোদি-শাহর গুজরাতের ওষুধ কোম্পানি। এদের তৈরি রেমিডিসিভির একটা ব্যাচের ল্যাব টেস্টে দেখা যায় ওষুধটিতে ব্যাকটেরিয়াজাত এন্ডোটক্সিন রয়েছে। ২০২২-’২৩-এ সংস্থাটি নির্বাচনী বন্ড কেনে ২৯ কোটি টাকার।
কোম্পানির নাম আইপিসিও ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড। এদের অ্যান্টি প্যারাসাইটিক ড্রাগ ল্যারিয়াগো। ২০১৯-র অক্টোবরে ল্যাব টেস্টে দেখা গেল এই ল্যারিয়াগোতে কম মাত্রায় ক্লোরোকুইন আছে। ২০২১ থেকে ২০২৩-এর মধ্যে এই ওষুধ কোম্পানিটি ১৩ কোটি ৫০ লক্ষ টাকার বন্ড কিনে খারাপ মানের ওষুধের বাজারজাতকরণের প্রক্রিয়া বহাল রাখে।
আরও পড়ুন-মোদি জমানায় নিহতের নাম গণতন্ত্র
বন্ডের নিরাময় ক্ষমতার প্রগাঢ়ত্ব এতেই শেষ নয়। কেবল খারাপ মানের ওষুধের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ ঠেকাতেই নির্বাচনী বন্ডের ব্যবহার, তা নয়। আরও আছে। বহু ক্ষেত্রে ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলো কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলোর কর ফাঁকির অভিযোগে অভিযান ঠেকাতেও ইলেক্টোরাল বন্ডে টাকা ঢেলে পিঠ বাঁচিয়েছে।
যেমন রেড্ডিজ ল্যাব। গত বছর ১৩ নভেম্বর সেখানে আয়কর দফতর অভিযান চালায়। কোম্পানিটি সঙ্গে সঙ্গে ১৭ নভেম্বর বিজেপির ফান্ডে দেওয়ার জন্য ১০ কোটি টাকার বন্ড কেনে।
যেমন মাইক্রো ল্যাব। ২০২২-এর জুলাই মাসে এই সংস্থার কারখানায় ও অফিসে আয়কর বিভাগ হানা দেয়। এই হুজ্জতি ঠেকাতে সংস্থাটি নির্বাচনী বন্ড কিনে ৬ কোটি টাকা বিজেপিকে দেওয়ার ব্যবস্থা করে।
ওষুধ তৈরি এবং স্বাস্থ্য পরিষেবাখাতে যুক্ত সংস্থাগুলো সব মিলিয়ে প্রায় ৩৯৪ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনে বিজেপির পকেটে অর্থবল জুগিয়েছে। টোরেন্ট ফার্মা, সিপলা, হেটেরো ও তার সহযোগী সংস্থাসমূহ, ডক্টর রেড্ডিজ ল্যাবরেটরিজ— এদের কথা আগেই বলেছি। এবার একবার নিচের তালিকায় চোখ বোলান। তাহলেই বুঝতে পারবেন কী হারে ওষুধ কোম্পানিগুলো বিজেপির তহবিলে টাকা ঢেলেছে। টাকা যখন ঢেলেছে, তখন অনৈতিক কিছু সুবিধা যে তারা আদায় করে ছেড়েছে, সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এমএসএন গ্রুপ। এরা ২০ কোটি টাকা নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিজেপিকে দিয়েছে। নাটকো ফার্মা দিয়েছে ১৫ কোটি ২৩ লক্ষেরও বেশি টাকা। ডিভিসি ল্যাবরেটরি দিয়েছে ৩০ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা। অরবিন্দ ফার্মা ৩৪ কোটি ৩২ লক্ষ টাকা বিজেপির পকেটে গুঁজেছে।
আরও পড়ুন-যাকাত-দানে গরিবের ইদ হয়ে ওঠে খুশির
এমএসএন গ্রুপ নির্বাচনী বন্ড কিনেছিল তাদের সংস্থায় আয়কর দফতর অভিযান চালিয়ে হিসাব-বহির্ভূত ৪০০ কোটি টাকা উদ্ধার করার পর। বাকিদের ক্ষেত্রেও এমন ঘটনাই ঘটেছে। খারাপ মানের ওষুধ খেয়ে মানুষ রোগমুক্ত হওয়ার বদলে আরও রোগগ্রস্ত হয়েছেন। সেরে ওঠার বদলে ভুগেছেন, কষ্ট পেয়েছেন। অভিযোগও জানিয়েছেন। কিন্তু কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। নির্বাচনী বন্ড কিনে বিজেপি সরকারের মুখ বন্ধ করেছে ওষুধ সংস্থাগুলো। ওষুধ কোম্পানিগুলো কর ফাঁকি দিয়েছে। কোটি কোটি হিসাব-বহির্ভূত টাকা উদ্ধার হয়েছে তাদের দফতর থেকে আয়কর অভিযানের সুবাদে। তারপর সব ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিজেপিকে ঘুষ দেওয়ার সৌজন্যে।
আপনার আমার শরীর স্বাস্থ্য ধ্বংস হয়েছে বাজে ওষুধ খেয়ে। আর বিজেপি-র পকেট ফুলে ফেঁপে উঠেছে। ওষুধ কোম্পানিগুলো ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছে। বিজেপির পকেট ফুলে ফেঁপে উঠেছে। এই বিজেপি, এই মোদিপক্ষ আবার নীতি-নৈতিকতার কথা বলে!
আরও পড়ুন-অভিষেকের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠকে চাঙ্গা দলীয় নেতৃত্ব
এই বিজেপির, এই মোদি পার্টির মানুষের রোগভোগ, শরীর স্বাস্থ্য, এসব নিয়ে কোনও মাথাব্যথা আছে? মনে তো হয় না। বরং বেশ বোঝা যায়, দেশের নাগরিকদের স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে চিন্তা ভাবনার সময় বা ইচ্ছা, কোনওটাই বিজেপির নেই।
রেস্তোঁরায় খেতে গেলে জিএসটি দিতে হয় ৫ শতাংশ হারে। সেখানে এক্স-রে, ইউএসজি কিংবা ব্লাড শুগার মাপার স্ট্রিপ কিনতে গেলে জিএসটি দিতে হয় ১৮ শতাংশ হারে। সোনার বা হিরের গয়না কিনতে গেলে ৩ শতাংশ হারে জিএসটি আর প্রবীণদের স্বাস্থ্য বিমার প্রিমিয়ামে ১৮ শতাংশ জিএসটি। আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ টাকা বেসরকারি খাতে খরচ হয়েছে, কারণ ভারতে মোট ১৯ লক্ষ বেডের মধ্যে ১৩ লক্ষ বেডই বেসরকারি বেড। ওদিকে নির্বাচনী বন্ড কিনে চলেছে ওষুধ কোম্পানিগুলো। সে টাকা তো তারা নিজেদের গাঁট থেকে দেয়নি। ফলে বন্ডের খরচ ঘুরপথে চাপানো হয়েছে ওষুধের ক্রেতার ওপর। তার অনিবার্য পরিণামে ওষুধের দাম বেড়েছে হু-হু করে। মানুষ ওষুধ কিনতে না পেরে যন্ত্রণায় কাতরেছে। পকেট ভরেছে বিজেপির।
আরও পড়ুন-আগুনে ছাই দেড়শো বিঘার গম
প্রায় ১৭৪ বছর আগে ১৮৫০-এ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় অক্ষয়কুমার দত্ত একটি প্রবন্ধে বাংলার গরিবগুর্বো খেটে খাওয়া মানুষদের ‘দুরবস্থা’র বর্ণনা দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছিলেন ‘বাজে আদায়’ নামে একপ্রকার জমিদারি ট্যাক্সের কথা। খুন, ডাকাতি, রাহাজানি, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, সব অভিযোগ থেকে রেহাই মিলত যদি ‘বাজে আদায়’ নামক করটি জমিদারবাবুদের দেওয়া হত।
আজ সেই ‘বাজে আদায়’-এর জায়গায় এসেছে নির্বাচনী বন্ড। খারাপ মানের ওষুধ হোক বা আয়কর ফাঁকির অভিযোগ, বিজেপির তহবিলে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে টাকা ঢাললেই সব অভিযোগ, সবরকম এজেন্সির অভিযান থেকে রেহাই।
একেবারে শেষে দুটো কথা তুলে ধরা আবশ্যক।
এক, জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচনী ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনার জন্য রাষ্ট্রের অর্থে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ফান্ড গড়ার কথা বলে আসছেন। সে-কথায় কেউ কর্ণপাত করেনি।
দুই, ওষুধ কোম্পানিগুলোর কেনা নির্বাচনী বন্ডের টাকা বিজেপি, এমনকী কংগ্রেস, আপ-সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তহবিলে ঢুকেছে, কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস সে-টাকা নেয়নি।
আরও পড়ুন-দাঁড়িয়ে থেকে লীলার বিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ
কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতা পেয়ে নিজেকে দেবতা ভাবছে। সে-দেবতার নৈবেদ্য চাই। চাল, কলা, মুলো নয়। কোটি কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড হল সেই নৈবেদ্য। এই সহজ সত্যিটা বুঝতে আর কারও বাকি নেই।
পরিশেষে আর একটা কথা, অন্য কারও নয়, একেবারে বাল্মীকির। একেবারে রামায়ণের কথা। রামায়ণে আছে, ‘সর্বে ক্ষয়ান্তা নিচয়াঃ পতনান্তাঃ সমুচ্ছ্রয়া। সংযোগী বিপ্রয়োগান্তা মরণান্তং তু জীবিতম্।।’ সব সঞ্চয়ের শেষে ক্ষয়, উন্নতির অন্তে পতন, মিলনের শেষে বিচ্ছেদ, জীবনেরও অন্তে মরণ।
বিজেপি আমাদের মেরে নিজেদের দেদার আর্থিক উন্নতি নিশ্চিত করেছে। এবার ওদের পতন নিশ্চিত করার দায়ভার, ওদের ক্ষমতার সঙ্গে মিলনের পরিবর্তে ক্ষমতার থেকে বিচ্ছেদ সুনিশ্চিত করার কর্তব্য, আমাদেরই পালন করতে হবে।