মহিষাসুরমর্দিনী : মুকুটে নতুন পালক

বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো। যতখানি বাস্তবে ততটাই সাহিত্য, সিনেমা, সংগীত, নাটকে এই উৎসবকে ঘিরে গাঁথা হয়েছে একাধিক কাহিনি। সময়ের সঙ্গে বিবর্তিত হয়েছে ভাবনা কিন্তু কেন্দ্রে থেকে গেছে দুর্গোৎসবের উপস্থিতি। পরিচালক রঞ্জন ঘোষের ছবি ‘মহিষাসুরমর্দিনী’— তেমনই এক পরীক্ষামূলক প্রচেষ্টা ছিল। গত নভেম্বরে মুক্তি পাওয়া ছবি আজও নতুন নতুন স্বীকৃতিতে বাংলা সিনেমা জগৎকে গর্বিত করে চলেছে। জানাচ্ছেন প্রীতিকণা পালরায়

Must read

খুশির খবরটা সোশ্যাল মিডিয়ায় সম্প্রতি শেয়ার করেছেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রাভিনেত্রী। ‘ফিপরেস্কি’ জুরি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত পঞ্চাশটি ভারতীয় ছবির মধ্যে স্থান করে নিয়েছে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ (Mahishasur marddini)। অভিনেত্রী আরও জানিয়েছেন, তিনি আন্তরিকভাবেই চান, শুধু মনোনয়ন নয়, খেতাব জিতে আসুক এই ছবি। কারণ আজকের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই ছবিটি এতই বাস্তব ও প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলিকে সিনেমার মাধ্যমে সবার সামনে তুলে ধরেছে, তা ব্যতিক্রমী। এ-ধরনের চরিত্রে অভিনয় করে তিনি শিল্পী হিসেবে যে অত্যন্ত সমৃদ্ধ হয়েছিলেন, তা-ও অকপটে জানিয়েছেন ঋতুপর্ণা। এই বক্তব্যের সারবত্তা রয়েছে। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শুধু গল্পের কারণে নয়, ছবির ‘ফরম্যাট’-এর কারণেও ব্যতিক্রমী। এই ছবিতে সিনেমা ও থিয়েটারের এক যুগলবন্দি ঘটেছে যা পরীক্ষামূলক হলেও, প্রয়াসে সফল। তাই ঋতুপর্ণার মতোই উচ্ছ্বসিত ছবির টিম ও পরিচালক রঞ্জন ঘোষ। ছবির চিত্রনাট্য তৈরি করতে যিনি দশটা বছর সময় নিয়েছিলেন!
রঞ্জন জানিয়েছেন, ‘‘এ-ছবি হৃদয়ের অত্যন্ত কাছাকাছি, কারণ দীর্ঘ সময় যাবৎ এই ছবির সঙ্গে আমি বসবাস করেছি। ভেবেছি, কাটাছেঁড়া করেছি, দ্বিধান্বিত হয়েছি। এর অন্যতম কারণ দুটি ভিন্ন মাধ্যমকে অর্থাৎ সিনেমা ও নাটককে এক সুতোয় বাঁধা। এই ভাবনাটা মাথায় আসারও একটা কারণ আছে। ছবির গল্প মাত্র একটি রাতের। অর্থাৎ যা কিছুই ঘটবে পর্দায় তার টাইমফ্রেম দুর্গাপুজোর আবহের এক রাত। একদিকে আলো-ঝলমলে খুশির শহর, মায়ের আগমনে উদ্বেল। অন্যদিকে এক অন্ধকার ঘটনা। পুজো শুরুর ঠিক আগের রাতে গণধর্ষণের শিকার হয় দশ বছরের মূক ও বধির এক বালিকা। পরবর্তী ঘটনাবলি যা কিছুই ঘটছে, দুর্গাপুজোকে কেন্দ্রে রেখেই। আমার মনে হয়েছিল, এই যে মৃন্ময়ী মাকে যখন পুজোর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল, পাশাপাশি ছোট্ট জলজ্যান্ত ‘দুর্গা’কে লালসার শিকার হতে হচ্ছিল, দুটোই জোরালোভাবে কী করে পর্দায় ধরা যায়! কারণ মাটির নারীপ্রতিমা তৈরি করে একদিকে তাঁকে পুজো করছি আবার রক্তমাংসের নারীকে নির্দ্বিধায় অপমান করছি! কী ভীষণ দ্বিচারিতা। তখনই মনে হয়, ছোট থেকে শুনেছি, আগেকার দিনে জমিদারবাড়ির নাটমন্দিরে যেমন পুজোর আয়োজন হত তেমনই পুজোকে ঘিরে নানা অনুষ্ঠান, থিয়েটারও মঞ্চস্থ হত। তখনই মাথায় আসে, এই ঠাকুরদালান বা বাড়ির উঠোনকেই যদি স্টেজ হিসেবে ব্যবহার করি! ভাবামাত্র শুরু করি চিত্রনাট্যের কাজ।’’
নাটকে যেমন অঙ্ক থাকে, তেমনভাবেই চিত্রনাট্য সাজিয়েছিলেন রঞ্জন। সাতটি অঙ্কে নাটক ভাগ করা থাকে। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’তে সেই সাতটি অঙ্কের মাধ্যমেই পুরো গল্পটি বলেছেন তিনি। শুধু একটি ধর্ষণ নয়, আমাদের সাজানো জীবনের আড়ালে নিত্য চলতে থাকে গার্হস্থ্য হিংসা, মানসিক নিপীড়ন, জাতি-ধর্ম নিয়ে অবমাননাকর আচরণ কিংবা অ্যাসিড আক্রমণের মতো ঘটনা। প্রতিটিই সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। রঞ্জন জানিয়েছেন, তিনি চেষ্টা করেছিলেন সব বিষয়গুলিকেই এক ছাদের নিচে নিয়ে আসার। এর আগে আলাদা এক-একটি বিষয়ে ছবি হলেও একত্রে গেঁথে সমস্যাগুলোকে তুলে ধরা হয়নি। তাই সেই চেষ্টাটাও ছিল। একই সঙ্গে নারীর ক্ষমতায়নের মতো জরুরি বিষয়টিকেও ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে বোনা হয়েছে। সবটা মেলানো এতটাই কঠিন ছিল, তাতে সময় একটু বেশি লেগেছে। ছবিতে ঋতুপর্ণার চরিত্রটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কাহিনি আবর্তিত হয়েছে তাঁকে ঘিরেই। সিঙ্গাপুরে লকডাউন কাটিয়ে কলকাতায় ফিরে ছবিটির শ্যুটিং সেরেছিলেন ঋতুপর্ণা। ঋতুপর্ণার পাশাপাশি আরও যাঁরা অভিনয় করেছেন— শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, শ্রীতমা দে, সাহেব ভট্টাচার্য, পৌলোমী দাস, কৌশিক কর, অরুণিমা হালদার প্রমুখ। তালিকা দেখেই বোঝা যাচ্ছে কাহিনির সঙ্গে অভিনয়ের যোগ্য সংগত হয়েছে। দর্শক-মনে দাগ কাটার পাশাপাশি এখন যখন বিশিষ্টদের স্বীকৃতি আসছে, টিমের তরফে খুশি সকলে।

আরও পড়ুন- প্রয়াত কাজী নজরুল ইসলামের কনিষ্ঠ পুত্রবধূ, শোকজ্ঞাপন মুখ্যমন্ত্রীর

বরাবরই ভিন্ন স্বাদের গল্প বলতে ভালবাসেন রঞ্জন। ‘হৃদমাঝারে’, ‘রং বেরঙের কড়ি’, ‘আহা রে’ বানিয়েছেন তিনি আগে। তবে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ (Mahishasur marddini) হয়ে উঠছে বিশেষ। রঞ্জন জানালেন, “যে ঘটনাটি প্রথম আমায় নাড়া দিয়েছিল, গত বছর, আইএইচসি থিয়েটার ফেস্টিভ্যালে দেখানো হয়েছিল ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। প্রথমবার কোনও নাট্যোৎসবে জায়গা করে নিয়েছিল কোনও ছবি! এটা আমরা ভাবতেও পারিনি। আসলে হ্যাবিট্যাট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল-এ প্রদর্শনের জন্য আমি ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ (Mahishasur marddini) জমা দিই। কিন্তু ইন্ডিয়া হ্যাবিট্যাট সেন্টারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ওঁরা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের পরিবর্তে থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল-এ দেখাতে চান ছবিটি। ছবির কাহিনি, প্রেক্ষাপট, শৈলী— সবকিছুর উচ্ছ্বসিত প্রশংসাও করেছিলেন। কাজেই পরিশ্রম সার্থক মনে হয়েছিল তখন। আসলে সবাই জানেন আইএইচসি থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল ভারতের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ নাট্যোৎসবগুলোর অন্যতম। তাই ওই স্বীকৃতি আমার কাছে খুব আনন্দের ছিল।”
আপাতত সকলেই আশা রাখছেন ফেস্টিভ্যালে ছবিটি ভাল কিছু পারফর্ম করবে।

Latest article