মলিকিউলার ইকোলজি পুরস্কার

‘আমি নারী, আমি পারি’— এই কথনটি যে কতশত সৃষ্টি ও কৃষ্টির সম্ভাবনা বয়ে চলেছে! গোটা বিশ্বের সম্মুখে সম্প্রতি তার উজ্জ্বল সাক্ষ্য দিয়েছেন আরও এক ভারতীয় মহিলা বিজ্ঞানী। এ-বছর আন্তর্জাতিক মলিকিউলার ইকোলজি প্রাইজ পেলেন বিজ্ঞানী ড. উমা রামাকৃষ্ণন। লিখছেন তুহিন সাজ্জাদ সেখ

Must read

একটি নতুন পালক
আন্তর্জাতিক মলিকিউলার ইকোলজি প্রাইজ-২০২৩ সম্মানে ভূষিত হলেন ভারতীয় বিজ্ঞানী ড. উমা রামাকৃষ্ণন। বিজ্ঞানের গবেষণায় মেয়েদের অগ্রণী ভূমিকার নজির তুলে ধরলেন তিনি। তিনি বর্তমানে ভারতবর্ষের বেঙ্গালুরুতে অবস্থিত দ্য ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস-এ অধ্যাপনার কাজে নিয়োজিত।

আরও পড়ুন-বার্বাডোজে এক সপ্তাহের শিবির ভারতের, বিচ ভলিবল দিয়ে যাত্রা শুরু দ্রাবিড়দের

মলিকিউলার ইকোলজি সম্মান-২০২৩
মলিকিউলার ইকোলজি বা আণবিক পরিবেশসংক্রান্তবিদ্যা বিজ্ঞানের একটি নতুন এবং গুরুত্বপূর্ণ শাখা। তবে এই বিষয়ের গুরুত্ব তুলে ধরতে তেমন কোনও প্রচার, প্রসার বা অগ্রগতি লক্ষণীয়ভাবে দেখতে পাওয়া যায় না। তাই বেশ কয়েক বছর আগে ‘মলিকিউলার ইকোলজি’ নামে জার্নালের সম্পাদকমণ্ডলী একটি কমিটি গঠন করে এই ‘মলিকিউলার ইকোলজি প্রাইজ’-এর সূচনা করেন। এ-বছর এই বিশেষ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন ভারতীয় বিজ্ঞানী ড. উমা রামাকৃষ্ণন।

আরও পড়ুন-নিরাপত্তা থেকে যাবতীয় ব্যবস্থাপনা যখন সম্পন্ন শেষ মুহূর্তে বকেয়া ৪৮৫ কোম্পানি বাহিনী মোতায়েনের কথা জানালো কেন্দ্র

মলিকিউলার ইকোলজির স্বরূপ
মলিকিউলার ইকোলজি বা পরিবেশসংক্রান্তবিদ্যা বা বাস্তুসংস্থানবিদ্যা আদতে বিবর্তনীয় জীববিদ্যার আধুনিকতম, উন্নততর এবং অগ্রণী কর্মক্ষেত্র। এই বিষয়টি তত্ত্বগত ও ব্যবহারিক দিক থেকে মলিকিউলার পপুলেশন জেনেটিক্স বা আণবিক জনসংখ্যাগত প্রজননশাস্ত্রে এবং মলিকিউলার ফাইলোজেনেটিক্স বা জাতিগত বংশগতিবিদ্যায় প্রয়োগের মাধ্যমে পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের বিবর্তনের ধারাবাহিকতার হদিশ পাওয়া যায় নিখুঁত ভাবে। মনে করা হয় মলিকিউলার ইকোলজি হল ইকোলজিক্যাল জেনেটিক্স বা পরিবেশসংক্রান্ত প্রজননশাস্ত্রের সমার্থক। এই বিষয়টি নিয়ে সর্বপ্রথম আলোচনা করেন রাশিয়ান-ইউক্রেনীয় বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানী থিওডোসিয়াস ডোবানস্কি, ব্রিটিশ বিবর্তনীয় বংশগতিবিদ এডমান্ড ব্রিস্কো হেনরি ফোর্ড এবং ব্রিটিশ বিবর্তনীয় বংশগতিবিদ গডফ্রে ম্যাথু হিউবিট। ভারতবর্ষেও এই বিশেষ ধরনের বিজ্ঞানের চর্চা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে এগিয়ে চলেছে। আন্তর্জাতিক স্তরে আমাদের দেশ এখন বিজ্ঞান গবেষণার একটি অন্যতম সাধনপীঠ হিসেবে পরিগণিত।

আরও পড়ুন-NCP-র ভাঙন নিয়ে মোদিকে তোপ দেগে অভিষেক বললেন দুর্নীতিগ্রস্তরাই বিজেপির সম্পদ

মোডাস অপারেন্ডি
মলিকিউলার ইকোলজি বিজ্ঞানের জগতে তাঁর বহুমুখীতার জন্য আলাদা ভাবে চিহ্নিত। পরিবেশের প্রাকৃতিক উপাদানের বৈচিত্র্য ও তাদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার সঠিক পর্যালোচনা করতে আণবিক বাস্তুসংস্থানবিদ্যা ‘মাইক্রোঅ্যারেস’ ও ‘ডিএনএ মার্কার’ পদ্ধতির অনুশীলন করে। প্রকৃতির মধ্যস্থিত সমস্ত উপাদানের প্রত্যেকেই হাজার হাজার জিন ও প্রোটিন বহন করে; এইগুলো একটি নির্দিষ্ট হারে নির্দিষ্ট সময় অন্তর বিবর্তিত হয়। উপরিউক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করে এই বিজ্ঞান জীববৈচিত্রের নানাসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে। এই বিজ্ঞানের গবেষণায় ‘পিসিআর’ বা পলিমারেজ চেইন রি-অ্যাকশনের সাহায্যে ডিএনএ-এর একটি নির্দিষ্ট ভগ্নাংশের লক্ষ কোটি প্রতিলিপি তৈরি করে আকার ও শক্তির ভিত্তিতে দর্শন কোশলী অবলম্বন করে কোনও একটি উপাদানের বংশগতির ধারা নির্ধারণ ও চিহ্নিত করা হয়।

আরও পড়ুন-বকেয়া আদায়ে মোদিকে চ্যালেঞ্জ করে অভিষেক জানলেন ‘দম হ্যায় তো রোখকে দিখাও’

ড. রামাকৃষ্ণন ও তাঁর কর্মযজ্ঞ
ড. উমা রামাকৃষ্ণন একজন ভারতীয় আণবিক বাস্তুসংস্থানবিদ। তিনি বর্তমানে অধ্যাপনার সঙ্গে নিযুক্ত। তাঁর গবেষণা ভারতবর্ষের স্তন্যপায়ী প্রাণীদের জীবন ও তাদের বিবর্তন নিয়ে। যার মধ্যে অন্যতম বিষয় হল ভারতবর্ষে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি করা। এই প্রকল্পে তিনি ভারতবর্ষের ওয়াইল্ডলাইফ কনসারভেশন সোসাইটির ভূতপূর্ব নির্দেশক মিঃ কে উল্লাস কারান্থ মহাশয়ের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। বৃহত্তর স্তন্যপায়ী প্রাণীদের বিবর্তন নিয়ে কাজ করতে তিনি তাদের জিনগত তারতম্য, জিনগত ধারা, বংশগত বৈশিষ্ট্য, জাদুঘরে সংরক্ষিত জিনগত তথ্য, সংযুক্ত ক্যামেরা-জালে পৃক্ত পরিসংখ্যান ইত্যাদি তথ্যের ব্যবহার করেছেন। বান্দিপুর জাতীয় উদ্যানের বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করতেও তিনি জিনগত নমুনা ব্যবহার করেছিলেন। তাঁর গবেষণা সুপ্রিম কোর্টে পেশ করে কানহা-পেঞ্চ ব্যাঘ্র করিডরের মধ্যগামী জাতীয় সড়ক-৭-এর প্রসারণের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর গবেষণা ভারতবর্ষের প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণের বহু মূল্যবান কাজে ব্যবহৃত হয়েছে।

আরও পড়ুন-বিজেপি শাসিত যে কোনও রাজ্যে মহিলাদের হাজার টাকা দিয়ে দেখাক, সুকান্তকে চ্যালেঞ্জ অভিষেকের

তিনি তাঁর কর্মজীবনে সহ-গবেষকদের সহযোগিতায় ভারতবর্ষের পশ্চিমঘাট পর্বতমালার মালেনাড়-মহীশূর ব্যাঘ্র-ভূখণ্ডে অবস্থিত সমস্ত বাঘ ও চিতাবাঘের প্রজাতি, লিঙ্গ ও অন্যান্য সকল বৈশিষ্ট্য আলাদা করে চিহ্নিত করেন। পশ্চিমঘাট পর্বতমালা ও নীলগিরি পর্বতমালার স্থানীয় কিছু পাখিদের জীবনধারা এবং তাদের বিপদ ও বিপদের কারণ খতিয়ে লক্ষ্য করেন।
তাঁর স্বীকৃতি
তিনি ২০১০ সালে ভারত সরকারের অধীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ থেকে রামানুজন ফেলোশিপ পান এবং ২০১২ সালে পারমাণবিক শক্তি বিভাগ কর্তৃক ‘আউটস্ট্যান্ডিং সায়েন্টিস্ট অ্যায়ার্ড’-এ ভূষিত হন। ২০১১ সালে তিনি সিঙ্গাপুরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে (ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর) ডিপার্টমেন্ট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস-এ একজন সিনিয়র গবেষক হিসেবে নিযুক্ত হন। এরপর তাঁকে ২০১৬ সালে বাঘ সংরক্ষণের উপর গবেষণার জন্য আমেরিকার শিকাগো শহরস্থিত ফিল্ড মিউজিয়াম থেকে পার্কার/গেন্ট্রি পুরস্কার প্রদান করা হয়। তিনি ২০১৯ সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমির ফেলো নির্বাচিত এবং এ-বছর তিনি মলিকিউলার ইকোলজি প্রাইজ-এ সম্মানিত হন।

আরও পড়ুন-পঞ্চায়েত নির্বাচন: ১০হাজারের কম বুথ স্পর্শকাতর, জানাচ্ছে কমিশন

আরও যাঁরা পেয়েছেন এই পুরস্কার
আন্তর্জাতিক স্তরে মলিকিউলার ইকোলজির প্রচার ও প্রসার নিয়ে যে-সকল বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক নিরন্তর কাজ করে চলেছেন সেই তালিকায় তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এর আগে যে-সকল বিজ্ঞানী এই মলিকিউলার ইকোলজি প্রাইজ পেয়েছেন তাঁরা হলেন কার্স্টিন জোহানেসান (২০২২), ফুনবেন ওয়ে (২০২১), ভিক্টোরিয়া সর্ক (২০২০), স্কট এডওয়ার্ডস (২০১৯), রবিন ওয়াপলস (২০১৮), ন্যান্সি মোরান (২০১৭), লুই বার্নাসেফ (২০১৬), ফ্রেড এলেনডর্ফ (২০১৫) প্রমুখ। সত্যিই বিজ্ঞানের গবেষণা ও বিজ্ঞান জ্ঞাপনের উপর ড. উমা রামাকৃষ্ণনের কাজ দৃষ্টান্তমূলক, তিনি ভারতবর্ষ তথা গোটা বিশ্বের বিজ্ঞানীমহলে একজন রোল মডেল হয়ে থাকবেন।

আরও পড়ুন-পঞ্চায়েত নির্বাচন: ১০হাজারের কম বুথ স্পর্শকাতর, জানাচ্ছে কমিশন

এই বিজ্ঞানের আশীর্বাদ
আণবিক বাস্তুসংস্থানবিদ্যা পরিবেশসংক্রান্ত সকল প্রকার প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে সবসময়। পরিবেশের মধ্যস্থিত সকল উপাদানের প্রজাতি নির্ধারণ, তাদের অস্তিত্বের সংকট ও তার সংরক্ষণ, জীববৈচিত্রের খেয়াল রাখা, পরিবেশে উপাদানের চারিত্রিক পরিব্যক্তি— সবই এই বিজ্ঞান দেখাশোনা করে। কোনও নির্দিষ্ট এলাকায় ব্যাকটেরিয়াজনিত বৈচিত্র, ওই এলাকায় উপস্থিত অন্যান্য অণুজীব ও ভাইরাসের ধারা এবং তাদের বিবর্তনের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে এই বিজ্ঞান। কোনও অঞ্চলের ছত্রাকজনিত বৈচিত্র্য, তাদের বেড়ে ওঠা, অন্যান্য উদ্ভিদের বসবাস, তাদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া এবং পচা-গলা উদ্ভিদ ও গুল্মের পরিণতি, এসব কিছুই পর্যবেক্ষণ করে আণবিক বাস্তুসংস্থানবিদ্যা। প্রাকৃতিক উপাদানের সংগঠন, সম্প্রদায়, জনসংখ্যা ও বাস্তুতন্ত্রগত সকল বিষয়ের পরিদর্শন করে মলিকিউলার ইকোলজি। এই বিজ্ঞান মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ককে সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলে; যা আমাদের খাদ্য উৎপাদন, মাটি, জল ও হাওয়া পরিষ্কার রাখতে এবং এই পরিবর্তনীয় মরশুমে জীববৈচিত্রকে সুসংহত রাখতে দারুণভাবে সাহায্য করে।

Latest article