দেশ বেচছেন মোদি

Must read

এভাবে জাতীয় সম্পদ বিক্রি করার কোনও যুক্তি নেই। এভাবে জাতীয় সম্পদ বিক্রি করলে সমস্যায় পড়বে আমজনতা। কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই মোদি সরকারের। সম্পদ বিক্রি করে এই সরকার রাজকোষে ঘাটতি মেটাতে চাইছে। সে উদ্দেশ্যও পূরণ হবে না। লাভ শুধু ক্রোনি ক্যাপিটালিস্টদের।
লিখছেন অধ্যাপক দেবনারায়ণ সরকার

আরও পড়ুন- বিশিষ্ট সাংবাদিক চন্দন মিত্রর মৃত্যুতে মুখ্যমন্ত্রীর শোকবার্তা

বিশ্ববিখ্যাত নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়র তাঁর ম্যাকবেথ নাটকে লিখেছেন, ‘‘False face must hide what the false heart doth know।” অসত্য হৃদয় যেটা জানবে অসত্য মুখ তো সেখানে লুকোবেই।
কথাটা বলছি কারণ, ২৩ অগাস্ট দেশের অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন অ্যাসেট মনিটাইজেশন পাইপলাইন এই স্কিমে আগামী চার বছরে ছয় লক্ষ কোটি টাকা তোলা হবে। বিষয়টা পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যাক।
আমাদের অর্থমন্ত্রী যেটা করতে চাইছেন সেটা হল ২০২১-’২২ থেকে ২০২৪-’২৫, এই চারটি অর্থবর্ষে আমাদের জাতীয় সম্পদ বেসরকারি সংস্থাগুলোর হাতে তুলে দিয়ে সরকারের অর্থ সংস্থান করা। এই জাতীয় সম্পদগুলোর মধ্যে কী কী আছে? জাতীয় সড়ক, রেল, বিদ্যুৎ পরিবহণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন, গ্যাসের পাইপলাইন, তেলের পাইপলাইন, টেলি-যোগাযোগ, খনি, বন্দর। এর প্রত্যেকটা জিনিস আমাদের, সাধারণ মানুষের রোজকার জীবনের সঙ্গে জড়িত।
প্রথমেই একটা বিষয় বুঝে নেওয়া দরকার। সরকার এই যে সম্পদ বিক্রির কাজে নেমেছে, কখন একটি সরকার এরকম কাজ করে? কিছু কিছু স্ট্রাটেজিক জিনিস আছে যেগুলো কখনওই বেসরকারি হাতে তুলে দিতে নেই। বিশেষ করে খনি, তেল, রেল আর বিদ্যুতের মতো বিষয়সমূহ। কারণ, এই সম্পদগুলো নিছক এখন আয় দেয় তেমনটা নয়, এগুলো ভবিষ্যতের স্থায়ী সম্পদ গঠনে সাহায্য করে। এগুলো তখনই বিক্রির পথ নিতে হয়, যখন আয়ের অন্য সব সূত্র অকেজো হয়ে পড়ে, অন্য আর কোনও সূত্র থেকে আয় করা যাচ্ছে না, তখন, কেবল তখনই।

আরও পড়ুন- বিজেপির “উইকেট বাঁচাও” বৈঠকে “নন প্লেয়িং” ১১!

এ সব বিক্রির উপযুক্ত সময় কোনটা? যখন দেশের অর্থনীতি মজবুত, বেশ ভালর দিকে, তখনই সরকার এইসব সম্পদ বিক্রির কথা ভাবতে পারে। বেসরকারি হাতে এইসব ক্ষেত্র তুলে দিয়ে সরকার তখন প্রতিযোগিতার সুযোগ উন্মুক্ত করে দেয়।

এখন কি দেশের তেমন পরিস্থিতি? মোটেই না। অতিমারির সময় এখন। কোভিড পরিস্থিতি চারিদিকে। প্রতিযোগিতার সুযোগ কমে গিয়েছে। অর্থনীতিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। গত অর্থ বছরে আমাদের জাতীয় আয় সাত শতাংশেরও বেশি কমে গিয়েছে। এটা একটা রেকর্ড। মোদি ক্ষমতায় আসার পর আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন জাতীয় আয় আট শতাংশেরও বেশি হারে বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু আমরা যদি খেয়াল করি, তা হলে দেখব, নোটবন্দিপর্ব থেকে শুরু করে জাতীয় আয় আট থেকে কমতে কমতে গত অর্থবর্ষে সেটা সাত শতাংশের নিচে নেমে গিয়েছে। অর্থাৎ, মোদি সরকারের প্রতিটি পরিকল্পনায় গলদ। প্রথম ভুল পদক্ষেপ ছিল নোটবন্দি। লোকের হাত থেকে নগদ অর্থ চলে গেল। সঞ্চয়, বিনিয়োগ, রপ্তানি— সব জায়গায় আমরা মার খেলাম ওই নোটবন্দির কারণে। এর পর এল জিএসটি। এর ফলে দেড় কোটির কাছাকাছি এমএসএমই বসে গিয়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে সরকারের আয়ের সব পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মোদি সরকার বলেছিল বিলগ্নীকরণের মাধ্যমে আয় হবে ২ লক্ষ ১০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আসলে ওই পথে গত অর্থবর্ষে সরকারের আয় মোটে ৩২ হাজার কোটি টাকা। এর থেকে পরিষ্কার, এলআইসি-র মতো সংস্থা হোক বা আমাদের বেঙ্গল কেমিক্যালের মতো সংস্থা হোক, এই সংস্থাগুলোর একাংশ বাজারে শেয়ার হিসেবে ছেড়ে দিয়েও, বিলগ্নীকরণের পথে হেঁটেও ২ লক্ষ ১০ হাজার কোটি টাকার জায়গায় এসেছে মাত্র ৩২ হাজার কোটি টাকা। এ বছর বলা হচ্ছে, বিলগ্নীকরণের মাধ্যমে সরকারের আয় হবে ১ লক্ষ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি যা তাতে এর অর্ধেক টাকা সরকার তুলতে পারবে কি না সন্দেহ।

আরও পড়ুন- গ্যাস আরও মহার্ঘ দাম কমান, মোদিকে মুখ্যমন্ত্রী

গত বছর বলা হয়েছিল ফিসক্যাল ডেফিসিট বা আর্থিক ঘাটতি হবে জিডিপি-র ৩.৫ শতাংশ। শেষ পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯.৫ শতাংশে। এবার বলা হচ্ছে আর্থিক ঘাটতির পরিমাণ হবে জিডিপির ৬.৮ শতাংশ। কিন্তু শেষে আসলে তা বেড়ে কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, কেউ তা জানে না। অর্থাৎ, খাতায়-কলমে দেড় লক্ষ কোটি টাকা আর্থিক ঘাটতি বলা হয়, সেটাও কিন্তু বাস্তবে বিপুল আকার ধারণ করবে।

কোনও দিক থেকে আয় করতে পারছে না বলেই সরকার সম্পদ বিক্রির পথে হাঁটছে। রেল, সড়ক, বিদ্যুৎ, গ্যাস বিক্রি করা মানে তো গরিব মানুষদের আরও বিপন্ন করা। এগুলো তো শুধু ধনীরা ব্যবহার করেন না, গরিব মানুষরাও করেন। এখন বেসরকারীকরণের ফলে ট্রেনের ভাড়া যদি দশ গুণ বেড়ে যায়, তখন এই গরিব জনতা কী করবে? কীভাবে যাতায়াত করবে তারা? জাতীয় সড়ক বেচে আসবে ১ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকা। তা হলে রাস্তায় হাঁটতে গেলেও, বাসে চেপে যেতে গেলেও মানুষকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হবে। বর্তমান আর্থ–সামজিক পরিকাঠামোতে সেটা গ্রহণযোগ্য? বিদ্যুৎ আর গ্যাস ব্যবহার করতে হলে অনেক অনেক বেশি টাকা গুনতে হবে সাধারণ মানুষকে।

আরও পড়ুন- শুভেন্দুকে ছাড় কেন? ইডির দ্বিচারিতায় প্রশ্ন

উলটো দিকে এগুলো তো কিনবে ক্রোনি ক্যাপিটালিস্টরা। তারা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সস্তায় কিনবে জাতীয় সম্পদ। সেজন্য সরকার তার প্রয়োজনীয় অর্থ তুলতে পারবে না দেশের সম্পদ বেচে। আর মরবে সাধারণ মানুষ। তাদের জীবনধারণের খরচ যাবে মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে। অতিমারির সময়ে এরকম পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত মোদি সরকারের মতো জনবিরোধী সরকারই নিতে পারে।
মিথ্যা যুক্তি সাজিয়ে এরা যে কাণ্ডটা ঘটাতে চাইছে, তাতে শেক্সপিয়রের ওই কথাটাই বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে। অসত্য মুখের শেষ আশ্রয় অসত্য হৃদয়।
এদের বিসর্জনের বাজনা বাজানোর সময় এসেছে।

Latest article