গেরুয়া পক্ষের গান্ধী বিরোধিতা

গান্ধীজিকে স্রেফ স্বচ্ছ ভারত অভিযানের প্রতীক করে রাখা আসলে গেরুয়া সংঘের কালাগত রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা। আজ যতই তারা মুখে গান্ধীজির প্রতি আনুগত্য ও দেশাত্মবোধের ভড়ং দেখাক না কেন, আদতে এরা গান্ধী বিরোধী ও ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অনুগত এক উত্তরাধিকার। লিখছেন সাংসদ জহর সরকার

Must read

গান্ধীজয়ন্তীর দিন মনে পড়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) আর হিন্দু মহাসভা কীভাবে ক্রমাগত তাঁর বিরুদ্ধে কাজ করেছিল। শুধু তাই না, তারা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের থেকে সব সময় দূরত্ব বজায় রেখেছে। এমনকী ১৯৪২-এ গান্ধীজির ডাকা ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন, যাকে দেশের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে সংকটময় মুহূর্ত বলা হয়, সেই সময়ও এই দুই সংস্থা ব্রিটিশ সরকারেরই পাশে ছিল, গান্ধীর দিকে নয়। মহাসভার সাভারকর ইংরেজদের সরাসরি সাহায্য না করলেও পরোক্ষ ভাবে মদত জুগিয়েছেন।

আরও পড়ুন-বাঙালিকে জুড়তে বড় উদ্যোগ চিকিৎসকের

কিন্তু তাঁরই দলের নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় অগাস্ট বিপ্লবকে ব্যর্থ করার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। তিনি তখন ফজলুল হক মন্ত্রিসভার বরিষ্ঠ সদস্য ছিলেন। ’৪২-এর জুলাই মাসে তিনি লিখিত ভাবে সাম্রাজ্যবাদ সরকারকে পূর্ণ সমর্থন জানান এবং আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার জন্যে সওয়াল করেন। পরবর্তীকালে তিনি আজকের ভারতীয় জনতা পার্টির পূর্বসূরি ভারতীয় জনসংঘের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পূজিত। বিশেষ করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর। কিন্তু যখন শাসকেরা তাঁকে কোনও গুরুত্বই দিলেন না, তিনি তখন অন্য সুরে লিখলেন। কয়েক মাস পরে ওই মন্ত্রিসভা থেকে তিনি পদত্যাগ করলেন আর সেই সময় ব্রিটিশ রাজের অনেক গালমন্দ করলেন। যেই হিন্দু মহাসভা গান্ধীকে দেশ বিভাজনের জন্যে দোষী সাব্যস্ত করে তাঁকে হত্যা করল, সেই দলের নেতা শ্যামাপ্রসাদ কিন্তু এই মহাদেশের পূর্ব অঞ্চলে বঙ্গভঙ্গের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন।

আরও পড়ুন-জয়দীপ, মৌমাদের সংবর্ধনা ইন্ডোরে, বিওএ-র শতবর্ষ

আরএসএসএর গান্ধী বিদ্বেষ আরও ধারালো ছিল আর সাংগঠনিক শক্তি অনেক বেশি ভয়াবহ। এই সংঘের প্রতিষ্ঠাতা হেডগেওয়ার কিন্তু এক সময় গান্ধীকে অনুসরণ করতেন এবং তার জন্যে শাস্তিও পেয়েছিলেন। তিনি অবশ্য গান্ধীর মুসলমান প্রীতি একেবারেই মানতে নারাজ, তাই সাভারকরের কাছে চলে গেলেন। আগেই বলা হয়েছে যে, তাঁর সংঘ জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে কোনও ভূমিকা নেয়নি। এবং গান্ধীর পথকে সর্বনাশী ভুল পথ বলে বহু সমালোচনা করেছিল।

আরও পড়ুন-সাত বছরের প্রসাদ গড়ছে দুর্গা প্রতিমা

এখন অবশ্য আরএসএস দাবি করে যে ১৯৩৪ সালে ওয়ার্ধা আশ্রম থেকে গান্ধী গিয়েছিলেন তাঁদের একটি শাখা দেখতে আর তাঁদের অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। কিন্তু গান্ধীর সঙ্গে সম্পর্ক যে কখনওই মধুর ছিল না, তা নথি ঘাঁটলেই স্পষ্ট হয়ে যায়। যাওয়া যাক সরাসরি ১৯৪৭-এর অগাস্ট মাসে। আরএসএস-এর মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’ জানাল যে নতুন ভারতের জাতীয় তেরঙ্গা পতাকা কখনওই হিন্দুদের আপন, শ্রদ্ধার হয়ে উঠবে না। ‘তিন’ শব্দটাই অশুভ এবং তিন বর্ণবিশিষ্ট জাতীয় পতাকা নিশ্চিত ভাবেই খুব খারাপ, যা দেশের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে। ‘অর্গানাইজার’-এর ১৭ ও ২২ জুলাই সংখ্যাতেও এমন আরও অনেক জাতীয় বিষয়ে আরএসএস-এর বিরোধিতার কথা লেখা। এমনকী, আরএসএস-এর দ্বিতীয় সংঘ-চালক, এম এস গোলওয়ালকর তাঁর বই ‘বাঞ্চ অব থটস’-এ আক্ষেপ করেছেন ভারত কেন আরএসএস-এর গৈরিক চেরা পতাকাকে রাষ্ট্রীয় বলে মেনে নিচ্ছে না। আরএসএস আরও চেয়েছিল মনুস্মৃতিকে ভারতের সংবিধান বলে গ্রহণ করা হোক।

আরও পড়ুন-‘বিজেপিকে আবার চ্যালেঞ্জ করছি’ সাংবাদিকদের মুখোমুখি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়

এই ভাবে স্বাধীনতার পর প্রায় ১৮ মাস ধরে আরএসএস ও হিন্দু মহাসভা গান্ধী ও তাঁর সমর্থকদের প্রচণ্ড গাল দিয়ে তাদের বিরোধ চালিয়ে গেল। আরএসএস একদিকে উদ্বাস্তুদের মধ্যে কিছু সেবা করল ঠিকই কিন্তু তাঁদের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে খুনোখুনি শুরু করল। গান্ধী অবশ্য এই সময় ব্যস্ত ছিলেন পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের ক্ষোভকে একটু শান্ত করতে আর কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সামলাতে। সবাই স্বীকার করেছে যে স্বাধীনতা ও দেশ বিভাজন ঘোষণার ঠিক পরই যে কলকাতায় কোনও বিধ্বংসী খুনোখুনি হয়নি, তার জন্যে মহাত্মাকে কৃতিত্ব দিতে হবে।

আরও পড়ুন-সুখবর! এবার মাত্র দেড় ঘণ্টায় ডায়মন্ড হারবার থেকে পৌঁছে যাওয়া যাবে গঙ্গাসাগর

কিন্তু সংঘ পরিবার এই আত্মশক্তির অদ্ভুত নিদর্শনকে লিখিত ভাবে ব্যঙ্গ করেছিল আর গান্ধীকে ব্যক্তিগত ভাবে আক্রমণও। তা সত্ত্বেও যখন আরএসএসের প্রধান গুরু গোলওয়ালকর দেখা করতে চাইলেন, তিনি রাজি হলেন আর ১৯৪৭-এর ৯ সেপ্টেম্বর তাঁরা সামনে বসে আলোচনা করলেন। গান্ধী যখন সোজাসুজি তাঁকে বললেন যে সংঘের হাত রক্তে মাখা, গোলওয়ালকর উচ্চ সুরে তা অস্বীকার করলেন। ১৬ সেপ্টেম্বর তারিখে তিনি দিল্লির ভাঙি কলোনিতে অবস্থিত আরএসএসের একটি শাখায় গিয়ে তাঁর শান্তির বাণী প্রচার করেন, যা বর্তমান সরকার তাঁর মানপত্র হিসেবে বিবেচনা করে। ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ এই সময়কার পুলিশ দফতরের অগণ্য লেখা উত্থিত করে অবশ্য বলেছেন যে সংঘ পরিবার দাঙ্গায় শুধু নেতৃত্ব দেয়নি, তারা লাগাতার গান্ধী ও স্বাধীন সরকারের জুগুপ্সা চালিয়ে গিয়েছে।

আরও পড়ুন-বাংলার বিরুদ্ধে বঞ্চনা, অভিষেকের নেতৃত্বে রাজঘাটে তৃণমূলের সত্যাগ্রহ

১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধীর হত্যার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল আরএসএস ও মহাসভাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। তাঁদের নেতাদেরও কারারুদ্ধ করলেন দেড় বছর। প্রধানমন্ত্রী নেহরুর মৃদু আবেদন বা গোলওয়ালকরের প্রচুর ক্ষমাপ্রার্থনা তিনি মানলেন না। নেহরুকে লেখা তাঁর চিঠিগুলি থেকে দেখা যায় যে হিন্দু মহাসভার এক উগ্র সমর্থক এই হত্যা করেছে। কিন্তু এই ঘৃণ্য কাজ করতে সুবিধে করেছে আরএসএসের আর মহাসভার বিষাক্ত প্রচার আর দেশ বিভাজনের দায়িত্ব গান্ধীর ওপর ন্যস্ত করার অপপ্রচার।

আরও পড়ুন-গান্ধী জয়ন্তীতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রদ্ধার্ঘ্য

তিনি নেহরুর সর্বদলীয় সরকারের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিন্দু মহাসভার শ্যামাপ্রসাদবাবুকে বেশ কয়েকবার সাবধান করেছেন এবং রাগের সঙ্গে জানিয়েছেন যে সংঘ পরিবার মহাত্মার খুনের পর মিষ্টি বিতরণ করেছিল। প্যাটেল জুলাই, ১৯৪৯ অবধি এই দুই সংগঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করলেন না আর কাউকে জেল থেকেও ছাড়লেন না। সর্দার প্যাটেল অনড় রইলেন যতক্ষণ না সংঘ পরিবার মুচলেকা দিয়ে ভারতের জাতীয় পতাকার প্রতি আনুগত্য স্বীকার করল।

Latest article