গোড়ালির ব্যথায়

সারাদিন ধরে মাথার কাজ করতে করতে আমরা পায়ের কথা এক্কেবারে ভুলে যাই।যে পায়ের জোরে আমাদের সবকিছু তার প্রতি হয়ে যায় অবহেলা আর ঠিক তখনই পায়ের বা গোড়ালির ব্যথা হয়ে যায় মাথাব্যথার বড় কারণ। গোড়ালিতে টান পড়া, অসম্ভব ব্যথা, পা ফেলতে না পারা খুব কমন অথচ জটিল দীর্ঘস্থায়ী একটি সমস্যা। এই সমস্যাকে অবহেলা নয়। বিশিষ্ট হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ডাঃ প্রকাশ মল্লিক দিলেন গোড়ালি ব্যথার সমাধান। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

গোড়ালি ব্যথাজনিত সমস্যাকে গুরুত্ব না দিয়ে বরং হার্ট, লাং, লিভার, প্রেশার, সুগার এই রোগগুলো নিয়েই আমরা বেশি ভাবি কিন্তু গোড়ালির ব্যথা যে কোনও জটিল রোগের লক্ষণ হতে পারে ভাবনাটা আমাদের মধ্যে থাকে না। মানুষের পায়ে ২৬টা হাড় রয়েছে যার মধ্যে গোড়ালির হাড় সবচেয়ে বড়। পা বা পায়ের পাতাই আমাদের পুরো শরীরের ওজনকে ধরে রাখতে সাহায্য করে। সারাদিন আমরা মাথার কাজ বেশি করলেও পায়ে চাপ কিন্তু কম নয়। বরং দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। ফলে গোড়ালির ব্যথার সমস্যাগুলোও বাড়ছে। এই ব্যথা এতটাই মারাত্মক হয় যে ঠিকমতো পা পর্যন্ত ফেলা যায় না। এটি একটি অ্যাকিউট সিনড্রোম।

আরও পড়ুন-পাটখেতে বোমা ফেটে মৃত ১

কারণ
গোড়ালির ব্যথার বিভিন্ন কারণ হতে পারে। আচমকা পা মচকালে গোড়ালির ব্যথা হতে পারে।
শরীরে কোলেস্টেরল বাড়লে গোড়ালির ব্যথা হতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যন্ত্রণা হয় লাল হয়ে গোড়ালি ফুলে যায়। দেখা যায় আঙুল দিয়ে চাপ দিলে ওই অংশ ডেবে যাচ্ছে। কোলেস্টেরল দু’রকম হয়। গুড বা ভাল কোলেস্টেরল এবং ব্যাড বা খারাপ কোলেস্টেরল। হঠাৎ করে দেহে খারাপ কোলেস্টেরল বা এলডিএল-এর মাত্রা বেড়ে গেলে রক্তে কোলেস্টেরল জমতে থাকে। তখন রক্ত প্রবাহিত হতে বাধা পায়, সেখান থেকেও গোড়ালির ব্যথা হতে পারে।
এ-ছাড়াও ওজন যদি প্রয়োজনের তুলনায় খুব বেড়ে যায় অর্থাৎ ওবেসিটিতে ভুগছেন যাঁরা, তাঁদের ক্ষেত্রে খুব গোড়ালির ব্যথা হয় কারণ শরীরের ভর নিয়ন্ত্রিত হয় এই দুই পায়ের সাহায্যে।
পায়ের গোড়ালির হাড় বাড়লেও ব্যথা হতে পারে। পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের এই ব্যথার প্রবণতা বেশি হয়। ভুল মাপের জুতো ব্যবহার করলেও গোড়ালির ব্যথা হতে পারে বা পায়ের পাতা ঠিকমতো না পড়লে আবার ফ্ল্যাট ফিট বা পায়ের গঠনগত সমস্যা থাকলেও গোড়ালির ব্যথা হয়।

আরও পড়ুন-বইতে এবার ব্যাপক বদল ঐতিহাসিক শাহী হুঙ্কার

বর্তমানে বেশির ভাগ সমস্যার জন্য দায়ী আমাদের জীবনযাত্রা, যাকে আমরা লাইফস্টাইল বলি। অতিরিক্ত তেল মশলাদার খাবার খাওয়া, স্ট্রেস, দিনের মধ্যে ৬ ঘণ্টার কম ঘুম হলে শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। কোলেস্টেরল হল একধরনের মোম জাতীয় পদার্থ যা তৈরি হয় আমাদের শরীরেই লিভারের মধ্যে। ভিটামিন ডি এবং শরীরে ভারসাম্য রক্ষাকারী নানা হরমোনের মাধ্যমেই তৈরি হয়ে এই কোলেস্টেরল। কোলেস্টেরল জলে অদ্রবণীয় এবং লাইকোপ্রোটিন নামক একপ্রকার কণার মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে । এই কোলেস্টেরল পরবর্তী সময় চর্বি এবং লাইকোপ্রোটিনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে লো-ডেনসিটি লাইকোপ্রোটিন গঠন করে তখনই তা শরীরের জন্য ক্ষতিকারক। কারণ এই লো ডেনসিটি লাইকো প্রোটিন ধমনীর রক্তপ্রবাহকে আটকে দেয় যা হৃদরোগের অন্যতম কারণ। অতিরিক্ত খাবার খেলে এটি বৃদ্ধি পায়।
তাই বছরে অন্তত দু’বার কোলেস্টেরল পরীক্ষা খুব জরুরি। আর হোমিওপ্যাথিতে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রিত রাখার এবং গোড়ালির ব্যথার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন অনবদ্য চিকিৎসা রয়েছে। যা খুব কার্যকরী।

আরও পড়ুন-অ্যাসিড পোকার হানা

গোড়ালি ব্যথার অন্যতম কারণ যেহেতু কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়া। তাই স্বাস্থ্যসম্মত খাওয়াদাওয়া করতে হবে, তেল মশলাদার খাদ্য, বাইরের জাঙ্ক ফুড চিনি বা বেশি নুন খাওয়া বন্ধ করতে হবে। কোলেস্টেরল যেই নিয়ন্ত্রিত হবে গোড়ালি ব্যথাজনিত সমস্যার উদ্ভব কম হবে।
দ্বিতীয় হল কোনও আঘাতজনিত কারণে গোড়ালির ব্যথা হলে দেখতে হবে আঘাত কীভাবে হয়েছে সেই অনুযায়ী চিকিৎসা করলে ফল পাওয়া যাবে। কারণ লক্ষণ এবং মায়াজম অর্থাৎ হোমিওপ্যাথির থিওরি অনুযায়ী চিকিৎসা করা হলে দ্রুত ফল মিলবে।
গোড়ালিতে কোনও কারণে যদি বেশি পরিমাণে ক্যালসিয়াম ডিপোজিশন হয় সেক্ষেত্রে তাকে গোড়ালির হাড়-বাড়া বলে। সেই হাড়টা বেড়ে গিয়ে যন্ত্রণা শুরু হতে পারে যাকে চিকিৎসার পরিভাষায় বলে ক্যালকেনিয়ান স্পার। বিশেষ করে মহিলাদের মেনোপজ হলে অনেক সময় তাঁরা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ক্যালসিয়াম খাওয়া শুরু করে দেয় হয়তো তাঁর শরীরে ক্যালসিয়ামের দরকারই নেই ফলে গোড়ালিতে ক্যালসিয়াম ডিপোজিশন হয় এবং গোড়ালি ব্যথা শুরু হয়।

আরও পড়ুন-পর্যটন জেলার লক্ষ্যে প্রশাসনিক বৈঠক

আরও একটি কারণ হল প্ল্যান্টার ফেসিয়াটিস। প্ল্যান্টার ফেসিয়াটিস লিগামেন্ট গোড়ালির হাড়ের সঙ্গে জুড়ে থাকে। এই লিগামেন্টে যখনই চাপ পড়ে তখনই গোড়ালির টিস্যুগুলোতে প্রদাহ সৃষ্টি হয়। এই কারণে সকালে ঘুম থেকে উঠে বা এক জায়গায় অনেকটা সময় বসার পর উঠে হাঁটতে গেলে গোড়ালি পেতে হাঁটা যায় না যন্ত্রণা শুরু হয়। আবার খানিক পর ধীরে ধীরে ঠিক হয়। গর্ভবতী মহিলাদের সন্তান জন্মের শেষের দিকে এই প্ল্যন্টার ফাসাইটিস হতে পারে।
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে যাঁদের কাজ, নাচ শেখেন বা করেন যাঁরা, তাঁদের পায়ের পিছনদিকের নার্ভগুলোয় অতিরিক্ত চাপ পড়লে এই সমস্যা দেখা দেয়। খুব বেশি পরিমাণে হাঁটাচলা করলে সেই থেকে ঘর্ষণের কারণে হাড়ক্ষয় হলে অনেক সময় ওই অংশে অনেক নতুন হাড় তৈরি হয় এর ফলেও গোড়ালিতে ব্যথা হয়।
যাঁরা রিউমাটয়েড আথ্রাইটিসে ভুগছেন তাঁদেরও গোড়ালির ব্যথা হতে পারে। পাশাপাশি ইউরিক অ্যাসিড বাড়লে বা হাড়ের মধ্যে কোনও সংক্রমণ হলেও গোড়ালির ব্যথা হতে পারে।

আরও পড়ুন-রক্তাক্ত আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস, বন্দুকবাজের হামলায় মৃত ৬, জখম ৩০

পায়ের এই ধরনের ব্যথা হলে সত্বর চিকিৎসা প্রয়োজন। এর পাশাপাশি প্রচুর জল খান সারাদিন। শর্করা কম খেতে হবে। ক্যালোরি কম গ্রহণ করতে হবে। ব্যায়াম করতে হবে। পরিমাণে কম, বারবার, অল্প-অল্প করে খেতে হবে।
সরাসরি নিজেই ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খেতে যাবেন না। চিকিৎসকের পরামর্শে খান।
কী করবেন
নিয়মিত ব্যায়াম করা জরুরি। পর্বতাসন করলে গোড়ালিতে একটা স্ট্রেচিং হয়, এতে ব্যথা ধীরে ধীরে কমে।
যে অংশে ব্যথা, নিয়মিত ম্যাসাজ করুন। ম্যাসাজ অয়েল ব্যবহার করতে পারেন যদিও ব্যথার উপশম দীর্ঘস্থায়ীভাবে হবে না এতে।
পায়ের ব্যথাযুক্ত জায়গায় বরফ বা আইসপ্যাক রাখতে হবে।
সরষের তেলের মধ্যে রসুন আর কালোজিরে দিয়ে বেশ গরম করে ওই তেল মালিশ করুন। এটি বহু প্রাচীন একটি টোটকা। যা খুব কার্যকরী। ব্যথা অংশে একটা আঙুল দিয়ে প্রেশার দিয়ে ম্যাসাজ করুন।

আরও পড়ুন-পুজোর আগেই খুলছে ভুটান গেট

শুকনো কাপড়ে নুনের পুঁটলি করে গরম চাটুতে তাতিয়ে নিয়ে পায়ে সেঁক দিন দিনে দু’বার।
দুটো টবে একটা ঠান্ডা জল এবং আরেকটায় গরম জল নিয়ে একবার গরম জল এবং একবার ঠান্ডা জল করতে হবে পনেরোবার। দিনে দু’বার করুন
ভুল চটি অর্থাৎ মাপ ঠিক নেই, খুব হিল জুতো পরা বন্ধ করতে হবে। বাড়িতে সবসময় পায়ে নরম চটি পরে থাকুন, খালি পায়ে হাঁটবেন না।
কোনও একজায়গায় বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন না।
প্রয়োজন ছাড়া ব্যথার ওষুধ খাবেন না। কিডনির সমস্যা দেখা দিতে পারে। কারণ লক্ষণ এবং মায়াজম অর্থাৎ হোমিওপ্যাথির থিওরি অনুযায়ী যদি চিকিৎসা করানো যায়, দ্রুত সুস্থ হওয়া সম্ভব।

আরও পড়ুন-করোনা মোকাবিলায় প্রস্তুত স্বাস্থ্য দফতর

যে ওষুধগুলো খাওয়া যেতে পারে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হল ক্যালকেরিয়া ফস, রেনালকিউলস বালবোসা অরাম মেট, ক্যালকেরিয়া ফোর, অ্যাসিড ফ্লোর। এছাড়া আর্নিকা, হাইপেরিকাম। এইসব ওষুধ রোগী ও তাঁর সমস্যা অনুযায়ী দিলে গোড়ালির ব্যথা সেরে যায়। হোমিওপ্যাথি হল একটি হোলিস্টিক চিকিৎসা। ধৈর্য ধরলে ফল অবশ্যই মেলে তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খাবেন।

Latest article