কৃষ্ণকথায় তাল
ভাদ্রমাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে পালিত হয় কৃষ্ণজন্মাষ্টমী। শাস্ত্রীয় বিধিতে বলা হয়েছে এই তিথির রোহিণী নক্ষত্রে জন্ম হয়েছিল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের। এই বছর শুক্রবার ১৯ অগাস্ট হল সেই শুভদিন। তাঁর জীবনকাহিনি নিয়ে মানুষের উৎসাহ অন্তহীন। এই জন্মাষ্টমীর আরও অনেক নাম রয়েছে— গোকুলাষ্টমী, কৃষ্ণাষ্টমী, শ্রীকৃষ্ণজয়ন্তী ইত্যাদি। আর কৃষ্ণের জন্মের সঙ্গে তালের বড়ার রয়েছে গভীর সম্পর্ক। ভগবান বিষ্ণুর অষ্টম অবতার রূপে তিনি বসুদেব-গৃহিণী দেবকীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আর এইদিনে মথুরা থেকে তিনি এসেছিলেন গোকুলে নন্দরাজার গৃহে। সেই দিনটি ছিল গোকুলের নন্দ উৎসব উদযাপনের দিন যেদিন প্রথম তালের বড়া খাওয়া হয়েছিল গোকুলে। তাই নন্দ উৎসব আর কৃষ্ণ জন্মাষ্টমীর দিনে তালের বড়া খাওয়ার মাহাত্ম্য অন্য। এইদিন দুধ, ঘি, মধু দিয়ে স্নান করে নতুন জামা পরে ফুলে ফুলে সেজে ওঠেন হরি।
তালেরই ভোগ
আরও পড়ুন-অন্যতম সেরার স্বীকৃতি পেল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, গর্বিত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
জন্মাষ্টমীতে শ্রীকৃষ্ণকে ৫৬ রকমের ভোগ দেওয়া হয়। যার মধ্যে থাকে মাখন, মিছরি, খিচুড়ি, শাক, দই, রাবড়ি, দুধ, কাজু, তালের বড়া এবং আরও অনেক কিছু। তবে অনেকেই এইদিন শুধুমাত্র তালের বড়া, তালের লুচি, তালের ক্ষীর, তালের মালপোয়া আর সুজি দিয়েও ভোগ নিবেদন করেন গোপালকে। তালের কদর তাই ঘরে ঘরে।
তালগোত্র
এহেন তালের স্বাদের যেমন কমতি নেই তেমনই গুণেরও খামতি নেই। তাল গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Borassus flabellifer। যাকে ইংরেজিতে বলে পাম (palm)। এশিয়া এবং আফ্রিকার গ্রীষ্মকালীন গাছ। এরিকাসি পরিবারভুক্ত বরাসসু গণের একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ। তাল ভারতীয় উপমহাদেশে খুব জনপ্রিয় গাছ কারণ এর প্রতিটা অংশই কাজের কোনও কিছুই ফেলা যায় না। তালের ফল আর বীজ দুই খাদ্যযোগ্য। পাকা তালের ফলের ঘন ক্কাথ দিয়ে তৈরি হয় তালসত্ত্ব, তালের জুস, তালের বড়া, তালের কেক, তালের পিঠে, তালের লুচি, মালপোয়া ইত্যাদি অনেক সুস্বাদু মিষ্টিজাতীয় পদ। তালের বীজ হল তালশাঁস। তাল গাছের কাণ্ড থেকে রস সংগ্রহ করে গুড়, পাটালি, মিছরি তৈরি হয়।
আরও পড়ুন-১৩১তম ডুরান্ড কাপ টুর্নামেন্ট উদ্বোধন করলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
তালে রয়েছে
তালে রয়েছে ডায়েটরি ফাইবারের প্রচুর উৎস। এই ফলে রয়েছে জিঙ্ক, ভিটামিন কে এবং এ। রয়েছে প্রচুর পরিমাণে বিটাক্যারোটিন, প্রোটিন, পটাশিয়াম, ফসফরাস, কপার, জিঙ্ক, ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ফোলেট। তালে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি আর রয়েছে অনেক খনিজ উপাদান, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টিইনফ্লামেটরি বা প্রদাহনাশক উপাদান।
প্রতি ১০০ গ্রামে
পাকা তালের প্রতি ১০০ গ্রামে রয়েছে মোটামুটি ৮৭ কিলোক্যালরি, জলীয় পদার্থ ৭৭.৫ গ্রাম, শর্করা ১০.৯ গ্রাম, খাদ্য আঁশ বা ফাইবার ১ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ২৭ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ৩০ মিলিগ্রাম, আয়রন ১ মিলিগ্রাম, থায়ামিন .০৪ রাইবোফ্লবিন.০২, নিয়াসিন .৩ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ৫ মিলিগ্রাম।
আরও পড়ুন-জম্মু-কাশ্মীরে বাস উল্টে মৃত ৬ জওয়ান, শোক প্রকাশ মুখ্যমন্ত্রী- অভিষেকের
গুণাতীত
তালের রস শ্লেষ্মানাশক। এটি কোষ্ঠকাঠিন্য নিবারণ করে। হজমশক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে, স্টমাক বা পাকস্থলীর সমস্যায় দারুণ কার্যকরী। অ্যাসিডিটি দূর করে। আলসার প্রতিরোধ করে।
গ্রীষ্মকালীন ফল তাই ত্বকের যে কোনও সমস্যায় খুব কার্যকরী তাল। গরমের ঘামাচি প্রতিরোধে, অ্যালার্জি জাতীয় সমস্যা, গরমে স্কিন রাশ থেকে প্রতিরোধ করে তাল। তালের ক্কাথ ত্বকে সরাসরি রাশে বা ঘামাচিতে লাগালে একটা কুলিং বা ঠান্ডা অনুভূতি তৈরি হয়। অনেক সময় ত্বকে একটা লালচে ভাব আসে যেটা কমাতে সাহায্য করে। ডার্মাটাইটিস প্রতিরোধ করে। শিশুদের ত্বকের জন্যও তালের ক্কাথ উপকারী।
শরীরের ভিতরের উত্তাপ কমায় তাল। শুষ্ক ত্বকের জন্য উপকারী তাল। এই ফলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে মিনারেল, সোডিয়াম, পটাশিয়াম। যা থাকার ফলে শরীরে কখনও জলের ঘাটতি হয় না। এর ফলে ডিহাইড্রেশন কমায়, শরীরকে হাইড্রেটেড থাকে। তেষ্টা পায় না। হিট থেকে তৈরি হওয়া যে কোনও সমস্যা থেকে বাঁচাতে তাল অনবদ্য। অতিরিক্ত ঘামের ফলে দেহে যে ইলেকট্রোলাইট এবং নিউট্রিয়েন্টের ক্ষয় হয় তার পরিপূরক হিসেবে কাজ করে তাল বা তালের নির্যাস। গোটা দিন জুড়ে প্রচুর এনার্জি সরবরাহ করে মুহূর্তে তালের জ্যুস।
আরও পড়ুন-জয় দিয়ে শুরু রিয়ালের
তাল হল লো ক্যালরি সমৃদ্ধ একটি ফল। এই ফলে রয়েছে প্রচুর জলীয় পদার্থ। তালের শরবত বা জ্যুস পেট ভর্তি রাখে অনেকক্ষণ ফলে বারবার খাবার খেতে হয় না বা খিদে পায় না। এতে সহজেই ওজন কমে। তাল দেহে রোগপ্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি করে।
সমীক্ষা বলছে তাল মাইগ্রেন বা যে কোনও মাথার যন্ত্রণা কমাতে খুব কার্যকরী একটি ফল। তালপাটালি একটা টুকরো খেলেই মুহূর্তে মাথার যন্ত্রণার উপশম ঘটে। তালপাটালিতে রয়েছে বি১, বি২, বি৩, বি৬ এবং সি। যা শরীরে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টির জোগান দেয়।
তালমিছরিতে রয়েছে লো গ্লাইসেমিক ইনডেক্স। যা শরীরে গ্লুকোজের মাত্রাতিরিক্ত নিয়ন্ত্রিত করে। ব্লাডসুগার কমাতে সাহায্য করে। চিকিৎসকেরা ডায়াবেটিস রোগীদের সাধারণ চিনির পরিবর্তে অল্পমাত্রায় তালমিছরি খাওয়ার পরামর্শ দেন।
আরও পড়ুন-রুশদি-হামলায় জড়িত নয় ইরান
তালমিছরিতে রয়েছে অ্যান্টিইনফ্লামেটরি প্রপার্টি। যা ত্বকের যে কোনও প্রদাহ কমায় সঙ্গে বমি-বমি ভাব প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। মুখের অরুচি দূর করে। লিভারের সমস্যায় কার্যকরী দাওয়াই তাই তাল লিভারটনিক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
তালে রয়েছে ফাইটো নিউট্রিয়েন্ট, শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা আমাদের বার্ধক্য রোধ করে বা এজিং প্রসেসকে ধীর করে ত্বক দ্রুত বুড়িয়ে যায় না।
পাকা তাল প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় হার্ট ডিজিজ বা হার্টের সমস্যাকে রোধ করে, ক্যানসারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধি প্রতিরোধ করে।
বহুদিনের পুরনো কাশি সারাতে তালের রসের জুড়ি নেই। ৩-৪ চামচ তালের রস দুধের সঙ্গে মিশিয়ে সকালে বিকেলে নিয়মিত কয়েকদিন খেলে কাশির উপশম হবে দ্রুত। অনিদ্রার সমস্যা থাকলে দূর করে তাল।
আরও পড়ুন-খেলা হবে দিবস: শুভেচ্ছাবার্তা মুখ্যমন্ত্রীর
তালের শাঁস যা একটি লো ক্যালরি যুক্ত ফল। এটি কার্বোহাইড্রেট, ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট এবং ক্যালশিয়াম আর রয়েছে সামান্য পরিমাণে ফাইবার। এতে রয়েছে ভিটামিন এ, সি, বি৭, কে এবং আয়রন যেগুলো শরীর সুস্থ রাখতে ভীষণ জরুরি উপাদান। দাঁতের সুরক্ষায় পাকা তাল যেমন উপকারী তেমনই তালের শাঁস উপকারী। তালশাঁসে পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম ছাড়াও রয়েছে সেলসশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, কপার, ম্যাগনেশিয়ামের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তালের শাঁস আমাদের চোখের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ। চোখের অ্যালার্জি থেকে নানারকম চোখের রোগ কমাতে কার্যকরী।
কচি তালের শাঁস রক্তশূন্যতা দূরীকরণে দারুণ সহায়ক। হাড় মজবুত করতে সাহায্য করে। স্মৃতিশক্তি বাড়াতে কার্যকরী।
তালের শাঁস রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এটি খেলে শরীরে নাইট্রেটের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা প্রাকৃতিক উপায়ে আমাদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।