বিষবৃক্ষ

না, বঙ্কিমচন্দ্রের 'বিষবৃক্ষ' নয়। এ একেবারে আক্ষরিক অর্থে বিষগাছ। দেখতে সুন্দর, আকর্ষণীয় এইসব গাছ বা উদ্ভিদের মূল থেকে ফুল—সবের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে মরণফাঁদ। যার ভয়াবহতা শুনলে স্তম্ভিত হতে হয়। পৃথিবীর এমন কিছু বিষাক্ত উদ্ভিদ বা গাছের কথা লিখলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

জলের মতো গাছও তো আমাদের জীবন। প্রাণবায়ু দেয় যে সেই গাছই কি না বিষের আকর! কেড়ে নিতে পারে প্রাণও। শুনতে খুব অবাক শোনালেও এটাই সত্যি। বিশ্বের এমন অনেক উদ্ভিদ আছে যা ভয়ঙ্কর, প্রাণঘাতী। সেই সব বৃষবৃক্ষ বা পয়জেনাস ট্রি-র কথা শুনলে হয়ে যেতে পারে হাড়হিম।

আরও পড়ুন-হাতির হামলায় জখম শিশুর পাশে বীরবাহা

মোটেও গোবেচারা নয়
সুন্দর, সরল আর বেশ উপকারী বন্ধুর মতো দেখতে লাগলেও মোটেও গোবেচারা গাছ নয় মানচিলেন। জানেন কি বিশ্বের সবচেয়ে বিষাক্ত গাছেদের অন্যতম এই বৃক্ষটি। এইজন্য, গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম রয়েছে এই গাছের। মৃত্যুগাছ মানচিলেন ট্রি। দক্ষিণ ফ্লোরিডার ম্যানগ্রোভের অরণ্য দ্য ক্যারিবিয়ান, মধ্য আমেরিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরভাগের বিভিন্ন অংশে এই গাছটি জন্মায়। দেখলে বোঝার উপায় নেই যে এটি একটি বিষবৃক্ষ। গাছের ফলগুলো দেখতে টুকটুকে আপেলের মতো। ফলকে স্প্যানিশ ভাষায় বলে মানজানিটিমা ডি লা মুয়ের্তে। এর অর্থ মৃত্যুর ছোট আপেল। এই ফলে এক কামড়ই যথেষ্ট। মুহূর্তে বিষ ঢুকে যায় শরীরে এবং শুরু হয় জ্বালা, বমি, রক্তপাত। মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে। এই গাছের সাদা রসে থাকে বিষাক্ত একটি জৈব যৌগ। ফ্লোরিডা ইনস্টিটিউট অফ ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারের দাবি, শুধু ফল নয়, এই গাছের পাতা, শাখাপ্রশাখা, রস সবটাই বিষাক্ত।

আরও পড়ুন-শিশুদের মাঝে শিক্ষিকার ভূমিকায় সাংসদ

আত্মহত্যার ইচ্ছে জাগানীয়া
এ কেমন গাছ যা স্পর্শ করলে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে! এমন ভয়ঙ্কর ইচ্ছে! ‘ড্রেনডকনাইড মরইডেস’ নামের এই গাছটির আস্তানা অস্ট্রেলিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রেনফরেস্ট। এই গাছটি আত্মহত্যার গাছ নামে পরিচিত। একে ছুঁলেই নাকি মরতে ইচ্ছে জাগে। এই গাছের পাতার হুল শরীর একবার স্পর্শ করলে বিদ্যুতের শক লাগে এবং এতটা জ্বালা-যন্ত্রণা শুরু হয় যে সেই ব্যক্তির মনে হয় আত্মহত্যা না করলে মুক্তি পাব না। সেই কষ্টে মৃত্যু অবধি ঘটতে পারে। কারণ এর হুল থেকে বেরোয় নিউরোটক্সিন। ঝোপঝাড়ে বেড়ে ওঠা এই গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদটি গেম্পি গেম্পি, দ্য সুইসাইড প্ল্যান্ট, মুনলাইট নামেও খ্যাত।

আরও পড়ুন-নাবালিকাকে ধর্ষণের দায়ে জেল ৩ জওয়ানের

বিষের জ্বালা বড়
ওলেন্ডার হল পৃথিবীর আরও একটি অন্যতম বিষাক্ত উদ্ভিদ। এর বৈজ্ঞানিক নাম নেরিয়াম ওলেন্ডার। ইউরেশিয়া ও উত্তর আফ্রিকায় মূল জন্মস্থান। এর শিকড় থেকে পাপড়ি সবটাই বিষাক্ত। এই গাছের ভয়াবহতার কারণ ওলেন্ড্রিন নামক বিষ যা এই গাছেই থাকে। এই গাছের কোনও কিছু সংস্পর্শে এলে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠতে পারে হৃদস্পন্দন, হতে পারে বমি, শ্বাসকষ্ট, হতে পারে সারা শরীরে জ্বালা। এই গাছের একটা পাতা একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষকে মুহূর্তে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে নিয়ে যেতে পারে।
রূপের ফাঁদেই মৃত্যু
কেউ যদি স্বেচ্ছামৃত্যু চান অবশ্যই গাছটিকে ছুঁয়ে দেখতে পারেন। আসলে এই গাছের ফুল দেখতে এত অপরূপ সুন্দর যে কেউ প্রেমে পড়ে যেতে পারে। কিন্তু সেই রূপে ভুললেই বিপদ। গাছটির নাম ওয়াটার হেমলক। বৈজ্ঞানিক নাম সিকুটা ম্যাকুলাটা। পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত গাছের তালিকার অন্যতম এটি। ফুল দেখে প্রতারিত হলেই বড় ভুল। ওয়াটার হেমলকের প্রতিটি অংশে থাকে সিকুটক্সিন নামক বিষ। যার প্রভাবে মুহূর্তে শরীরে হয় বিষক্রিয়া, আসে খিঁচুনি। পেশির অনবরত কম্পন থেকে ঘটতে পারে মৃত্যু। এই গাছের সবচেয়ে বেশি বিষ থাকে শিকড়ে। গাছটি দেখতে পাওয়া যায় উত্তর আমেরিকায়।

আরও পড়ুন-উন্নয়নে ভোল বদলাবে জেলা হাসপাতালের

শুধু গন্ধেই যাবে প্রাণ!
দারুণ সুন্দর ফুল অ্যাকোনাইট। কিন্তু জানেন কি এই উদ্ভিদের ফুল অত্যন্ত বিষাক্ত! এর বৈজ্ঞানিক নাম অ্যাকোনাইট ন্যাপেলাস। প্রধানত উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ এবং এশিয়ার উত্তর গোলার্ধ এবং হিমালয় সমভূমিতে প্রায় ১০০০০ ফুট উচ্চতায় মেলে। ফুল হাতে তোলার দরকার নেই, শুধু গন্ধ শুঁকলেই চলে যেতে পারে প্রাণ। স্পর্শ করলেই শরীর অসাড় হয়ে যেতে পারে। এমনকী দেখা দিতে পারে হার্টের প্রবল সমস্যা। এটি কোনওভাবে পেটে গেলে হতে পারে বমি, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়েরিয়া।
ছুঁলেই বিপদ
ছোট-বড় সকলের কাছে আকর্ষণীয় এই ফল কিন্তু আসলে মৃত্যুদূত। উদ্ভিদটি দেখতে ঠিক ছোট ছোট জামের মতো। নামটাও ভারী সুন্দর– নাইশেড। এর বৈজ্ঞানিক নাম হল ‘অ্যাট্রোপা বেলাডোন্না’। কথিত আছে, ম্যাকবেথের সৈন্যদল ডেনসের আক্রমণকারী সৈন্যদের একটি মিষ্টি ফল থেকে তৈরি ওয়াইন খাইয়ে হত্যা করেছিল। সেই মিষ্টি ফলের উদ্ভিদটিই হল এই প্রাণঘাতী নাইটশেড। দক্ষিণ ও মধ্য ইউরেশিয়ার বন এবং পরিত্যক্ত এলাকায় জাম জাতীয় ফলের গাছটির দেখা মেলে। এই গাছের পাতা হল ধূসর সবুজ রঙের। নাইটশেডের কাণ্ড, পাতা, ফল এবং মূলে রয়েছে রয়েছে এট্রোপিন এবং স্কোপোলামাইন যা হৃৎপিণ্ডে পক্ষাঘাতের সৃষ্টি করে। শুধু এই উদ্ভিদটির স্পর্শমাত্র শুরু হয়ে যায় অসম্ভব জ্বালা-যন্ত্রণা।

আরও পড়ুন-বিজেপিকে ভোট দিতে কেন্দ্রীয় বাহিনী ভয় দেখাল মহিলাদের

ভয়ঙ্কর সুন্দর
এই উদ্ভিদটির জন্মস্থান উত্তর আমেরিকা। সাদা রঙের মধ্যে শান্তির বার্তা লুকিয়ে থাকলেও হোয়াইট স্নেকরুটের ফুল শান্তির প্রতীক নয়। রীতিমতো প্রাণঘাতী। বেশ সুন্দর দেখতে এই ফুলগুলোতেই থাকে একধরনের বিষাক্ত অ্যালকোহল, যার নাম ট্রিমাটল। নিরীহ মানেই নিরীহ নয়, তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত এই উদ্ভিদ। কথিত আছে, এই স্নেকরুট উদ্ভিদটিই নাকি আব্রাহাম লিংকনের মা ন্যান্সি হ্যাংকসের মৃত্যুর জন্য দায়ী। ন্যান্সি শুধু একটি গরুর দুধ পান করেছিলেন। যে গরুটি ঘটনাক্রমে এই স্নেকরুট উদ্ভিদটি খেয়েছিল। ফলে তার দুধও বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল। উদ্ভিদটি এতটাই বিষাক্ত যে এটি যে প্রাণী খাবে তার মাংসও বিষাক্ত হয়ে পড়বে। স্নেক রুটের বৈজ্ঞানিক নাম হল (Ageratina altissima) আগ্রেটিনি আলটিসিমা। এটা মুখে চলে গেলে ক্ষুধামান্দ্য শুরু হয়। তারপর বমি বমি ভাব, শারীরিক দুর্বলতা, পেট ফুলে যায়, জিভ লাল হয়ে যাওয়া, রক্তে অ্যাসিডিটি এবং সবশেষে মৃত্যু হয়।

আরও পড়ুন-গ্রিন করিডর করে পরীক্ষার্থীকে কেন্দ্রে

ঘুম নেবে কেড়ে
ফিলোডেনড্রন নামে মূলত দক্ষিণ আমেরিকার এই পাতাবাহারটি। অনেকেরই এই গাছটি খুব চেনা। সাধারণভাবে মানিপ্ল্যান্ট বা পাতাবাহার হিসেবে পরিচিত আপাতনিরীহ এই গাছটির সংস্পর্শে এলে নানা স্বাস্থ্য জটিলতা তৈরি হতে পারে। সুইডেনের ইনস্টিটিউট অফ হেলথের অণুজীব রোগতত্ত্ব বিভাগের পরিচালক ফিলিপ রস জানান, বিরল এক ব্যাকটিরিয়ার কারণে এই গাছের সংস্পর্শে থাকলে ত্বকে জ্বালাপোড়া হতে পারে। এছাড়া গলা ও মাথাব্যথা, শ্বসনতন্ত্রে সমস্যাও দেখা দেয়। এই গাছটি বাড়িতে থাকলে দেখা দিতে পারে অনিদ্রা ও স্নায়ুতন্ত্রের রোগ।

Latest article