ছিঃ প্রধানমন্ত্রী, ছিঃ!

নির্বাচনী আদর্শ আচরণবিধি বা মডেল কোড অব কন্ডাক্ট এখন বিস্মৃতপ্রায় নিয়মাবলি। বেলাগাম, বেপরোয়া মোদি-শাহ এখন নোংরামির ফোয়ারা ছেটাচ্ছেন। এ-ছাড়া আর কী-ই বা করার ছিল ওঁদের। লিখছেন দেবাশিস পাঠক

Must read

প্রচারমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এখন যারপরনাই বেপরোয়া। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও লাগামছাড়া ঘৃণা ভাষণ উদ্গীরণ করে চলেছেন। আচমকা ভ্রষ্টাচারী জুমলাবাজ পার্টি (বিজেপি)-র আচার-আচরণে, বিস্ময়াবিষ্ট। কিন্তু, সত্যি কথা বলতে কী, এই অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত উদ্গারে বিস্মিত বা ব্যথিত হওয়ার কিছু নেই, বরং, এমনটাই প্রত্যাশিত।
মোদি-ম্যাজিক উধাও। রামনামে কাজ হচ্ছে না একফোঁটাও। মোদি জমানার আর্থিক দুষ্টিমিগুলো মানুষ ধরে ফেলেছেন। সন্দেশখালিতে কুভেন্দু মিথ্যাচারীর কীর্তিকলাপ ফাঁস হতেই আরও চাপে ভারতের জঞ্জাল পার্টি (বিজেপি)। এমতাবস্থায় না আছে বালকোট, না আছে শক্তপোক্ত এনডিএ জোট। অসহায় বিজেপি তাই মিথ্যাচারিতা আর ঘৃণাভাষণকেই চরম অস্ত্র জেনে নির্বাচনী রণাঙ্গণে। ফল যা হওয়ার, তাই হচ্ছে।
১৯৯৬ সালের কথা। একের পর এক রায়ের মাধ্যমে দেশের শীর্ষ আদালত বুঝিয়ে দিয়েছিল, ভোটারদের প্রভাবিত করতে পারে এরকম ধর্মীয় বিষয়ে বক্তৃতা বা বিকৃতি নির্বাচনী বিধির নিরিখে দুষ্টকর্ম বই অন্য কিছু নয়। সেবার বাল থ্যাকারে বলেছিলেন, ‘‘আমরা এই নির্বাচন লড়ছি হিন্দুত্বকে রক্ষা করার স্বার্থে। তাই আমরা মুসলমানদের ভোটের পরোয়া করি না। দেশটা হিন্দুদের আর তাই-ই থাকবে।” সুপ্রিম কোর্ট সেই বক্তব্যে অনুমোদন দেয়নি।
সাল ২০১৭। সুপ্রিম কোর্ট জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, ১৯৫১-র ১২৩ নং ধারা ব্যাখ্যা করল। বিচারপতি ড. ঠাকুর রায় দিলেন, “An appeal in the name of religion, race, caste, community or language is impermissible under the Representation of People Act, 1951 and would constitute a corrupt practice sufficient to annul the election in which such an appeal was made …” [ধর্ম, জাতি, বর্ণ, সম্প্রদায় কিংবা ভাষার নামে কোনও আবেদন জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, ১৯৫ অনুমোদন করে না এবং এরকম আবেদন যে নির্বাচনে করা হয় সেটি দূষিত কাজকর্মের কারণে বাতিল হওয়ার উপযুক্ত …] এর থেকে কয়েকটা বিষয় স্পষ্টভাবে অনুভব করা যায়।
এক, ধর্ম, বর্ণ, জাতি, সম্প্রদায় কিংবা ভাষা আদর্শ নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে কোনও প্রভাব ফেলতে পারে না।
দুই, এগুলোকে সামনে রেখে কোনও প্রচার কিংবা নির্বাচনী কার্যকলাপ দূষিতজ্ঞানে বাতিলযোগ্য।
কিন্তু, বেচারা বিজেপি আর তার প্রধানমন্ত্রী কী করে? তাদের কাছে পাকিস্তান নামক জুজু নেই। বালাকোটের মতো সামরিক অভিযানের ধুয়ো তুলে জাত্যাভিমান ফুলিয়ে তোলার সুযোগ নেই। উন্নয়নের এমন কোনও দিশা নেই যার সুবাদে অনতি আগামীতে দেশের প্রান্তিক মানুষের উন্নয়ন পরিস্ফুট হতে পারে। সে কারণেই নিরুপায় বিজেপি ধর্মের তাস আঁকড়ে ধরেছে। আস সেটা করতে গিয়ে একের পর এক মিথ্যে কথা বলছে কিংবা বলতে বাধ্য হচ্ছে, অকুণ্ঠিত চিত্তে।
তৃণমূল কংগ্রেসকে সনাতন ধর্মবিদ্বেষী হিসেবে দেখাতে গিয়ে বিজেপি বলছে, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের অবমাননার কথা। আর সেটা করতে গিয়ে ভুলে গিয়েছে, ওই কাণ্ডটি আসলে করেছিলেন তাঁদেরই অবতার অবলাকান্ত মজুমদার, কুকান্ত ওই ব্যক্তি জানতেন না কিংবা বিস্মৃত হয়েছিলেন, স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, গীতাপাঠের চেয়ে ফুটবল খেলা শ্রেয়। তাঁর সুবিখ্যাত উক্তি, ‘‘গীতা পাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলিলে তোমরা স্বর্গের আরও নিকটবর্তী হইবে।’’ ১৮৯৭ সালে চেন্নাইতে ‘ভারতীয় জীবনে বেদান্তের প্রয়োগ’ শীর্ষক বক্তৃতায় তিনি একথা বলেন। সেখানে তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘‘আমরা দুর্বল, অতি দুর্বল। প্রথমত আমাদের শারীরিক দৌর্বল্য, এই শারীরিক দৌর্বল্য আমাদের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ দুঃখের কারণ।’’ আর সে প্রসঙ্গেই তাঁর বক্তব্য, ‘‘তোমাদের শরীর একটু শক্ত হইলে তোমরা গীতা আরও ভাল বুঝিবে। তোমাদের রক্ত একটু তাজা হইলে তোমরা শ্রীকৃষ্ণের মহতী প্রতিভা ও মহান বীর্য ভাল করিয়া বুঝিতে পারিবে।’’ কিন্তু অবলাকান্ত ভ্যাবলাকান্ত বাজনদার না বুঝেছেন বিবেক বাণী, না পড়েছেন উপনিষদ। উপনিষদকারও যে বলেছেন, ‘‘নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্য’’ [অর্থাৎ, ‘বলহীনের দ্বারা আত্মজ্ঞান লাভ হয় না’] সে কথা তিনি জানেন না। ফলত, বিবেকানন্দকে অবার্চীন বামপন্থীর তকমা দিতে তিনি ইতস্তত করেননি। যে দলের রাজ্য সভাপতির এই হাল, সেই দল এখন মিথ্যার বেসাতি সাজিয়ে আঙুল তুলছে তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে।
তৃণমূল কংগ্রেসকে সনাতন ধর্মবিরােধী বলছে সেই দল, যে দলের প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি কু-lip (অর্থাৎ ওষ্ঠ) সম্পন্ন ঘোষক মহাশয় মা দুর্গার ঠিকুজি খুলে বসে দেবীকে পিতৃপরিচয়হীনা প্রতিপন্ন করে ছেড়েছিলেন।
রামনবমীকে রাজ্যে রক্ত নবমী করার তাগিদে এরা ভুলে যায় রামচন্দ্র কেবল বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্রর সহায়ক ছিলেন না, নিরামিষভোজী ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের প্রতিভূ ছিলেন না। তিনি দলিত, শূদ্র গুহকেরও বন্ধু ছিলেন, রাক্ষস বিভীষণেরও মিত্র ছিলেন। রামায়ণ, অন্য কোনও রামায়ণ না হোক নিদেনপক্ষে বাল্মীকি রামায়ণটুকুও অবলাকান্ত, কুভেন্দু, নিষ্প্রদীপদের পড়া নেই। পড়া থাকলে জানতেন, অশোকবনে সীতাদেবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ সেরে শ্রীরাম সমীপে আসার পর বীর হনুমান জানাচ্ছেন, রাম-বিরহে সীতাদেবী মাংস ত্যাগ করেছেন, ‘ন মাংসং রাঘবো ভুঙ্‌ক্তে।’ এসব জানেন না, বোঝেন না বলেই কেবল এ-রাজ্যের অপোগণ্ডের দল নয়, তাঁদের পালের গোদা প্রধানমন্ত্রী, থুড়ি প্রচারমন্ত্রীও, আমিষ ভক্ষণ নিয়ে কটাক্ষ করেন।
নির্বাচনী আদর্শ আচরণবিধি, জনপ্রতিনিধিত্ব আইনে ১২৩ নং ধারার সুপ্রিম কোর্ট কৃত ব্যাখ্যা, সব এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়ে তাই এঁরা ধর্ম, জাতি, সম্প্রদায় নিয়ে নির্বাচনী প্রচারের সাহস পায়।
গান্ধিজী বলতেন, অনেক লোক, বিশেষত অজ্ঞানীরা সত্যি বলার জন, সঠিক পথে থাকার জন্য, তোমাকে শাস্তি দিতে চাইবে। তা বলে সঠিক কথা, সত্য পথ অবলম্বনের জন্য কখনও দুঃখ প্রকাশ কোরো না।
আমরা তাই বিজেপির অপপ্রচারের মুখে কোনও দুঃখ প্রকাশ করছি না। পিছিয়ে আসছি না আমাদের পথ থেকে। শুধু বাংলার আপামর মানুষের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি, এমনভাবে আগামী পাঁচ দফায় ইভিএম-এর বোতাম টিপুন যাতে দিল্লিতে তার কাঁপুনি টের পায় ওরা।

Latest article