বঙ্গ রঙ্গমঞ্চে শ্রীরামকৃষ্ণের পদার্পণ
১৮৮৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর বাংলা থিয়েটারের পক্ষে এক স্মরণীয় দিন। কারণ ওই দিনে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এসেছিলেন ৬৮ নম্বর বিডন স্ট্রিটে অবস্থিত (অধুনালুপ্ত) স্টার থিয়েটারে। সেখানে রমরমিয়ে চলছিল গিরিশচন্দ্র ঘোষ রচিত, পরিচালিত নাটক ‘চৈতন্যলীলা’। নামভূমিকায় শিল্পী নটী বিনোদিনী। সে নাটক দেখে ঠাকুর অভিভূত। মাঝে মাঝে সমাধিস্থ হয়ে পড়ছিলেন। শিল্পী কলাকুশলীদের সঙ্গে পরিচয়ের সময় ঠাকুরকে প্রণাম করলেন বিনোদিনী। ঠাকুরের অভিব্যক্তি— ‘আসল নকল সব এক দেখলাম’। ঠাকুরের আশীর্বাণী— ‘মা তোর চৈতন্য হোক’। অশ্রু ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বিনোদিনী ঠাকুরকে বললেন, ‘অহেতুক এত দয়া তোমার দীনবন্ধু পতিতপাবন। আমি মহাপাপী। আমাকেও তোমার এত কৃপা।’ ঠাকুর আশ্বস্ত করে বললেন, ‘পাপ নয় গো পাপ নয়, বুড়ি ছুঁয়ে থাকো। আর কিছু দেখতে হবে নি।’ ঠাকুরের পদস্পর্শে সেদিন বাংলা রঙ্গালয় তীর্থে পরিণত হল। সেখানে নটী বিনোদিনীর একটা অন্য মর্যাদা থাকলেও পাশাপাশি আরও তিন প্রতিভাময়ী নটীর কথা বলতেই হবে যাঁরা বিনোদিনীর আগে-পরে জন্মগ্রহণ করে নটগুরু গিরিশচন্দ্র ঘোষের সংস্পর্শে এসে নাট্যজগতে স্বনামধন্য হয়ে উঠেছিলেন।
আরও পড়ুন-মঞ্চে সৌমিত্রর জন্মান্তর
গঙ্গামণির কথা
বিনোদিনীর যখন মাত্র ৯ বছর বয়স, তখন গঙ্গামণি বিনোদিনীর দিদিমার বাড়িতে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে ওঠেন। বিনোদিনীর মা-দিদিমা গঙ্গামণিকে নিজেদের মেয়ে বলেই স্নেহ করতেন। বিনোদিনী গঙ্গার সঙ্গে ‘গোলাপ ফুল’ পাতিয়েছিলেন। দুজনে দুজনকে গোলাপ বলেই ডাকতেন। গঙ্গামণি খুব ভাল গান গাইতে পারতেন। বিনোদিনী তাঁর সংগীত শিক্ষার তালিম নিতে শুরু করলেন এই গঙ্গামণির কাছে। ওই মহল্লায় গঙ্গামণি ‘গঙ্গাবাঈ’ নামে পরিচিত ছিলেন। গঙ্গামণির কাছেই আসতেন বাবু পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও ব্রজনাথ সেন মহাশয়। এঁদের দৌলতে গঙ্গামণির ন্যাশনাল থিয়েটারে প্রবেশ। ১৮৮১-’৮২ পর্যন্ত তিনি ওই নাট্যশালার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৮৮৩ থেকে ১৮৮৭ সাল পর্যন্ত তিনি ৬৮ নম্বর বিডন স্ট্রিটের স্টার থিয়েটারে যুক্ত ছিলেন। ১৮৮৮ সালে হাতিবাগানে যখন স্টার থিয়েটার উঠে আসে, তিনি সেখানেও যোগদান করেন। গঙ্গামণি অভিনীত নাটকগুলির মধ্যে রয়েছে অভিমন্যু বধ (সুভদ্রা), সীতাহরণ (মন্দোদরী), রামের বনবাস (গুহক পত্নী), দক্ষযজ্ঞ (ভৃগুপত্নী), কমলে কামিনী (লহনা), নল দময়ন্তী (রাজমাতা), শ্রীবৎস চিন্তা (লক্ষ্মী), চৈতন্য লীলা (শচী), বৃষকেতু (পরিচারিকা), প্রভাসযজ্ঞ (যশোদা), বিল্বমঙ্গল (পাগলিনী), বুদ্ধদেব চরিত (গৌতমী), বেল্লিক বাজার (ললিতের মা), নসীরাম (সোনা), সরলা (শ্যামা), প্রফুল্ল (উমা সুন্দরী) হারানিধি ( কাদম্বিনী), তরুবালা (ঠান দিদি) বনবীর (ধাত্রী পান্না), রূপ সনাতন (করুণা) কালাপাহাড় (মুরলা) ইত্যাদি। ঠাকুরের কাছে দক্ষিণেশ্বরে এক পাগলিনী নিয়মিত আসতেন। তাঁকে দেখে তেমনি এক চরিত্র গিরিশচন্দ্র তৈরি করেছিলেন ‘বিল্বমঙ্গল’ নাটকে। সেই চরিত্রে অভিনয় ও গানে গঙ্গামণি সবাইকে মাতিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর কণ্ঠের গান ‘ও মা কেমন মাতা কে জানে’ এবং ‘ওঠা নামা প্রেমের তুফানে’ এক সময় খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। গঙ্গামণি ছিলেন চৌকস অভিনেত্রী। নাচ-গান-অভিনয় এই তিনের সমাহার তাঁর মধ্যে ছিল। সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সাহস এবং শিক্ষার গুণ। তাঁর চেহারায় একটা বাড়তি চটক ছিল। ছিল সুন্দর গানের গলা। নানান ধরনের নৃত্যের শারীরিক সক্ষমতাও ছিল। অভিনয়ের বহুমুখীন ও বহুমাত্রিক অভিনয় ক্ষমতায় তিনি তাঁর যুগের অন্যতম সেরা অভিনেত্রী ছিলেন তা নিঃসন্দেহে বলা চলে।
আরও পড়ুন-কোনও জেট নয় একটা গোটা ট্রেনের মালিক লুধিয়ানার কৃষক! কীভাবে হল এমনটা
তিনকড়ির কথা
তিনকড়ি আরেক স্বনামধন্য অভিনেত্রীর নাম। নিষিদ্ধপল্লিতে জন্ম। ছোটবেলা থেকেই থিয়েটারের প্রতি আকর্ষণ ছিল। আর সেই সময় তো ভদ্রঘরের মেয়েরা নাটকে অভিনয় করতে আসতে পারতেন না। নিষিদ্ধপল্লি থেকেই অভিনেত্রী সংগ্রহ করা হত। সেই ভাবেই যোগ দেন ‘বিল্বমঙ্গল’ নাটকে সখীর ভূমিকায়। গিরিশ ঘোষের সমসাময়িক নাট্যকার রাজকৃষ্ণ রায় ৩৮ নম্বর মেছুয়াবাজার রোডে প্রতিষ্ঠা করলেন বীণা থিয়েটারের। তিনি অভিনেত্রী বর্জন করে নাট্যশালা খুলেছিলেন। ফলে নাট্যশালাগুলিতে দর্শক সমাগম হতই না। দ্বিতীয়বারের জন্য যখন তিনি বীণা থিয়েটার খুললেন, তখন স্থির করলেন অভিনয়ে স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনেত্রীর সাহায্য নেবেন। সেই উদ্দেশ্যে তিনি নিয়ে এলেন তিনকড়ি দাসীকে মাসিক কুড়ি টাকা বেতনে। এই বিষয় নিয়ে বলতে গিয়ে তিনকড়ি জানাচ্ছেন, ‘এই সময় মাহিনা ছিল কুড়ি টাকা। কোন ধনী ব্যক্তির আশ্রয়ে মাসিক ২০০ টাকায় থাকিবার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করার জন্য নিজমাতা কর্তৃক প্রহৃত হই।’ বীণা থিয়েটারে রাজকৃষ্ণ-রচিত নির্দেশিত ‘মীরাবাঈ’ নাটকের নামভূমিকায় তিনকড়ি অবতীর্ণ হলেন। কুম্ভের চরিত্রে অভিনয় করলেন অক্ষয়কালী কোঙার। অসাধারণ অভিনয় করলেন তিনকড়ি। এ ছাড়া তাঁর গাওয়া ‘খেলার ছলে হরি ঠাকুর গড়েছেন এই জগৎ খানা’ গানটি সেই সময় খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
আরও পড়ুন-কলকাতা থেকে উঠে গেল বেটারমেন্ট ফি
এ ছাড়া তিনি এই মঞ্চে অভিনয় করলেন শ্রীকৃষ্ণের অন্নভিক্ষা, রুক্মিণীহরণ, হরধনু ভঙ্গ প্রভৃতি পৌরাণিক নাটকে। গানে ও অভিনয়ে মাতিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বীণা থিয়েটার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর মহেন্দ্রলাল বসু তাঁকে এমারেল্ড থিয়েটারে ডেকে নিয়ে যান। সেখানে তাঁর মাসিক বেতন ৪০ টাকা। সেখানে তিনি অভিনয় করলেন নন্দ বিদায় (বলরাম), বিদ্যাসুন্দর (নাগরিকা), রাসলীলা (বৃন্দা)। গিরিশচন্দ্র ঘোষের আহ্বানে তিনি এলেন মিনার্ভা থিয়েটারে। সেখানে তিনি ‘ম্যাকবেথ’ নাটকে নামভূমিকায় অভিনয় করে বিশেষ খ্যাতি পান। এরপর ‘মুকুল মুঞ্জরা’ নাটকে তিনকড়ি অভিনয় করেন তারা চরিত্রে। সে-অভিনয় দেখে গিরিশচন্দ্র উচ্চপ্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘বঙ্গরঙ্গমঞ্চে শ্রীমতী তিনকড়ি এখন সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী’। গিরিশচন্দ্র রচিত ‘জনা’ নাটকে তিনি জনার চরিত্রে অভিনয় করলেন। একমাত্র পুত্র প্রবীরকে হারিয়ে জনার ক্রন্দন অভিমান তেজ প্রভৃতি তিনকড়ি অসাধারণ ভাবে তুলে ধরেছিলেন। গৈরিশ ছন্দে লেখা সংলাপ উচ্চারণে তিনি সবাইকে চমকৃত করেছিলেন। ‘করমেতিবাই’ নাটকের নামভূমিকায় তিনকড়ির অভিনয় কলকাতার ধনী-রসিক মহলে চাঞ্চলের সৃষ্টি করেছিল। জীবনে বহু অর্থ উপার্জন যেমন করেছেন, তেমনি দান করেছেন অনেক। তাঁর দুটি বাড়ি তিনি বড়বাজারের হাসপাতালকে এবং আরেকটি বাড়ি বাবুর পুত্রকে উইলের মাধ্যমে দান করে দিয়ে যান।
আরও পড়ুন-স্বর্ণযুগের দুই মধুকণ্ঠী
ওই উইলের শর্তানুসারে তাঁর অলঙ্কার ও আসবাবপত্র বিক্রির টাকা থেকে বাড়ির ভাড়াটেদের প্রত্যেককে ৫০ টাকা করে দেওয়ার পর বাকিটা তাঁর শ্রাদ্ধকার্যাদিতে খরচ করা হয়। তিনকড়ি দাসী ছিলেন সুন্দরী, দীর্ঘ আকর্ষণীয় চেহারা, তীক্ষ্ণ ধাতব অথচ সুরেলা কণ্ঠস্বরের অধিকারিণী, ব্যক্তিত্বব্যঞ্জক অভিব্যক্তি— সে-যুগের সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেত্রী। মীরাবাঈ-এর গান, সুভদ্রার গান, সীতার গান, পাগলিনীর গান— সবই যেন তিনকড়িকে মনে রেখেই রাজকৃষ্ণ রায় বা গিরিশচন্দ্র ঘোষ রচনা করে গেছেন। আবার ‘আবু হোসেন’-এ নাচ-গানের চমৎকারিত্ব ও মৌলিকতা, ‘মুকুলমুঞ্জরা’র নৃত্যগীতের পারদর্শিতাতেই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল তাঁর অভিনয়। ঐতিহাসিক, ট্র্যাজেডি এবং গীতিনাট্য— এই তিন ধরনের নাটকে তিনকড়ি শ্রেষ্ঠ ছিলেন। তবে সামাজিক এবং ভক্তিভাবাবেগের নাটকে তাঁর কিছুটা সীমাবদ্ধতা ছিল। তাই অনেকের কাছে মনে হয়েছে যে, সূক্ষ্ম শান্ত কোমল ভাব প্রকাশে তিনকড়ি তেমন সার্থকতা লাভ করেননি। কিন্তু যেখানে জীবনের চরিত্র গাঢ় বর্ণে উজ্জ্বল, দুর্দম প্রকৃতি এবং প্রবৃত্তিতে চরিত্র বিক্ষুব্ধ, প্রচণ্ড শোক ও আঘাতে জর্জরিত তিনকড়ির অভিনয় সেখানেই সার্থক হয়ে উঠতে পেরেছে। তিনকড়ির আকৃতি অবয়ব, গঠন, কণ্ঠস্বর ও ব্যক্তিত্ব, এসব চরিত্রের রূপদানে তাঁর ক্ষমতা ও প্রতিভার দোসর হয়ে উঠত।
আরও পড়ুন-অভিন্ন দেওয়ানি বিধি, সমাধান না সমস্যাবর্ধক উপাদান
তারাসুন্দরীর কথা
নিষিদ্ধপল্লিতে জন্ম আরেক স্বনামধন্য অভিনেত্রীর। নাম তারাসুন্দরী। কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট হাতিবাগান সংলগ্ন রাজাবাগানে তারাসুন্দরীর প্রতিবেশিনী ছিলেন বিনোদিনী। বিনোদিনীর হাত ধরে বিডন স্ট্রিটের স্টার থিয়েটারে তারাসুন্দরীর প্রবেশ মাত্র ৭ বছর বয়সে গিরিশচন্দ্রের ‘চৈতন্যলীলা’ নাটকে। হাতিবাগানের স্টার থিয়েটারের উদ্বোধনী নাটক গিরিশচন্দ্রের ‘নসীরাম’ নাটকে তিনি করেন ভিল বালকের একটি ক্ষুদ্র চরিত্রে। অমৃতলাল মিত্র তারাসুন্দরীর শিক্ষাগুরু। রসরাজ অমৃতলাল বসু তারাসুন্দরীর অভিনয়ধারাকে সংস্কৃত ও পরিশোধিত করলেন। সংগীতে তালিম নিয়েছিলেন রামতারণ সান্যালের কাছে। নৃত্যশিক্ষা করেছেন কাশীনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। এসব যোগফলে অচিরেই তিনি প্রথিতযশা অভিনেত্রীতে পরিণত হয়েছিলেন। ‘চন্দ্রশেখর’ নাটকে শৈবালিনী রূপে প্রথম অভিনয়ে তিনি দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। ওইদিন নাটক দেখতে এসেছিলেন নাট্যজগতের কিংবদন্তি শিল্পী অমরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি এত মুগ্ধ হলেন তারাসুন্দরীর অভিনয় দেখে যে, তিনি তাঁর বাগমারির বাগানবাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুললেন তারাসুন্দরীকে। ফলে তারাসুন্দরীর সঙ্গে তৎকালীন কোনও সাধারণ রঙ্গমঞ্চের আর যোগ ছিল না।
আরও পড়ুন-বাংলায় আরও বেশি পরিবেশ-বান্ধব গাড়ি ও বাস
অমরেন্দ্রনাথ দত্ত এমারেল্ড থিয়েটার ভাড়া নিয়ে যখন ‘পলাশীর যুদ্ধ’ নাটক মঞ্চস্থ করছেন তখন সেখানে তারাসুন্দরী সিরাজ-মহিষী ও ব্রিটানিয়া এই দুটি ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের বাহবা পেয়েছিলেন। অমরেন্দ্রনাথ দত্ত যখন ক্লাসিক থিয়েটার খুললেন, তখন ‘নলদময়ন্তী’ নাটকে তারাসুন্দরী দময়ন্তীর চরিত্রে অভিনয় করেন। ক্লাসিক থিয়েটারে আর যেসব নাটকে তিনি অভিনয় করলেন সেগুলি হল তরুবালা (নাম ভূমিকায়), বিল্বমঙ্গল (চিন্তামণি), দেবী চৌধুরানী (প্রফুল্ল), হারানিধি (সুশীলা) প্রভৃতি। জনৈকা অভিনেত্রীকে কেন্দ্র করে অমরেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় তিনি ক্লাসিক থিয়েটার ছেড়ে ছিলেন। পরে অবশ্য অমরেন্দ্রের সঙ্গে তাঁর মিটমাট হয়ে যাওয়ায়, তারাসুন্দরী আবার ক্লাসিক থিয়েটারে ফিরে এলেন। এরপর যেসব উল্লেখযোগ্য অভিনয় তিনি করলেন তার মধ্যে রয়েছে— সরলা (প্রমদা), ভ্রমর (রোহিণী), কপালকুণ্ডলা (মতিবিবি), প্রফুল্ল (জ্ঞানদা), নির্মলা (নাম ভূমিকায়) প্রভৃতি। অরোরা থিয়েটার তারাসুন্দরীকে ভাঙিয়ে নিয়ে এল ক্লাসিক থেকে।
আরও পড়ুন-চন্দ্রযান-৩ যেন নক্ষত্র! ধরা পড়ল টেলিস্কোপে
ফলে সাময়িকভাবে অমরেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হয়। অর্ধেন্দুশেখর যখন অরোরা থিয়েটারে যোগ দিলেন তখন তাঁর নির্দেশনায় তারাসুন্দরী ‘রিজিয়া’ নাটকের নামভূমিকায় অভিনয় করে যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করলেন। বস্তুত ক্লাসিক থিয়েটার ছাড়ার পর কোনও থিয়েটারেই তিনি দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন না। তখনকার সব থিয়েটারেই (অরোরা, মিনার্ভা, কোহিনুর, স্টার) তিনি অভিনয় করেছেন। ইতিমধ্যে বাংলা রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হলেন আচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ী মশাই। পাশাপাশি তারাসুন্দরীর কনিষ্ঠ পুত্র নির্মল অকালে মারা গেলেন। তারাসুন্দরীকে তাঁর এই দুঃখ থেকে মুক্তি দিতে শিশিরকুমার ভাদুড়ী তাঁকে সসম্মানে মনোমোহন থিয়েটারে নিয়ে এলেন। সেখানে শিশিরকুমারের বিপরীতে তারাসুন্দরী গিরিশচন্দ্রের ‘জনা’ নাটকে জনা-চরিত্রে অভিনয় করে সবাইকে চমৎকৃত করেন। তখন তারাসুন্দরীর বয়স ৪৭ বছর। নীলধ্বজের চরিত্রে শিশিরকুমার।
আরও পড়ুন-ইন্ডিয়ার ধাক্কায় এনডিএ-র নাম বদলে তৎপরতা
এই সময়কালে আরেকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র রূপায়ণ করলেন তারাসুন্দরী ‘আলমগীর’ নাটকে উদিপুরীর চরিত্রে। নামভূমিকায় শিশিরকুমার। প্রথম জীবনে তিনি অমরেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে বছর আটেক অতিবাহিত করেন। ১৯০৭ সাল থেকে বাকি জীবন অতিবাহিত করেন প্রখ্যাত নট ও নাট্যকার অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। অপরেশচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর সমাজবহির্ভূত দাম্পত্যসম্পর্ক স্থাপিত হয়। অমরেন্দ্রনাথের সাহায্যে সাহিত্য সম্বন্ধে তারাসুন্দরীর যে আগ্রহ জেগেছিল তার প্রমাণ আছে তাঁর রচিত দুটি কবিতায়। কবিতা দুটি প্রকাশিত হয়েছিল গিরিশচন্দ্রের সম্পাদনায় অমরেন্দ্রনাথ দত্তের ‘সৌরভ গ্রন্থে’। তারাসুন্দরী গাম্ভীর্যপূর্ণ অভিনয়ে সেরা ছিলেন, তা সকলেই স্বীকার করেছেন। শৃঙ্গার এবং করুণরসের ভাবাভিব্যক্তির ক্ষমতাও তাঁর ছিল। গৃহলক্ষ্মী, স্বভাবপ্রবণ ভাবনার চরিত্রে তিনি নিরূপমা ছিলেন। সামাজিক, পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, গীতিনাট্য— সব ধরনের নাটকের অভিনয়ে তিনি সমান সফল ছিলেন। তাঁর অভিনয় সম্পর্কে ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন— ‘নটীদের মধ্যে প্রথমে তিনকড়ি পরে তারাসুন্দরী। এঁরাই সত্যকার প্রথম শ্রেণির, অন্যের পটুত্ব ছিল বিশেষ অংশের’। তাঁর বাচনভঙ্গি, সুস্পষ্ট শুদ্ধ উচ্চারণ, স্বরপ্রক্ষেপণ অতুলনীয় ছিল। তাই চেহারায় অন্যদের থেকে ন্যূন হলেও শুধু অভিনয়-ক্ষমতাতে তিনি সেরা হতে পেরেছিলেন। নৃত্যগীত ও চটুল অভিনয়ে তিনি হয়তো তেমন পারদর্শী ছিলেন না, তবে সিরিয়াস চরিত্রাভিনয়ে তাঁর কৃতিত্ব সকলেই স্বীকার করেছেন। বিপিনচন্দ্র পাল, অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং গিরিশচন্দ্র ঘোষও তাঁর অভিনয়ের যথেষ্ট সুখ্যাতি করেছেন সবসময়। তারাসুন্দরীর গাম্ভীর্যপূর্ণ অভিনয় সেরা ছিল একথা সকলেই স্বীকার করেছেন।
আরও পড়ুন-টিম ইন্ডিয়া আজ মণিপুরে
শেষ কথা
এই যে তিন তারা— এঁরা নটী বিনোদিনীর মতো অতখানি জনপ্রিয়তা পাননি ঠিকই, কিন্তু বাংলা রঙ্গমঞ্চে তাঁদের অবদানের কথা কখনওই বিস্মরণের নয়। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তাঁরা যে কীর্তি রেখে গেছেন তা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়।