নকশি-কাঁথায় অদ্বিতীয়া
সাফল্য সহজে আসে না। এর পিছনে থাকে কঠোর পরিশ্রম, ত্যাগ, অধ্যবসায়। সেইসঙ্গে যোগ্যতা, হার না-মানা মানসিকতা। এই সবকিছুর মিশেলে একজন সাধারণ মানুষ হয়ে ওঠেন অসাধারণ। উজ্জ্বল উদাহরণ প্রীতিকণা গোস্বামী। সূচিশিল্পী হিসেবে শুরু করেছিলেন জীবন। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন সেলাই দিদিমণি। চমৎকার হাতের কাজ। তাঁর বোনা নকশি-কাঁথা উচ্চ-প্রশংসিত হয়েছে। দেশের সীমানা পেরিয়ে গেছে বিদেশেও। স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। এবার পাচ্ছেন পদ্মশ্রী সম্মান। নীরবে কাজ করে গেছেন। কিছুদিন আগেও খুব বেশি মানুষ জানতেন না তাঁর কথা। এখন তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। সাধারণের চর্চায়।
আরও পড়ুন-‘সাহিত্য জগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি’, ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ মুখ্যমন্ত্রীর
ছবি আঁকার পাঠ
বাবা ছিলেন নির্মলজ্যোতি ঘোষ। ওপার বাংলার মানুষ। দেশ ভাগের পরে চলে আসেন এপারে। ওঠেন বালিগঞ্জে। কয়েকবার বাসা বদল। প্রীতিকণার জন্ম যাদবপুরে। পাঁচ বোনের মধ্যে দ্বিতীয়। তিন ভাই চিরতরে হারিয়ে গেছে। কষ্টেসৃষ্টেই কেটেছে শৈশবের দিনগুলি। মনের মধ্যে শিল্পের বীজ বপন হল কীভাবে? প্রীতিকণা জানালেন, ‘‘এর পিছনে রয়েছে বাবার অবদান। তিনি চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ক্যামেরার হাত ছিল চমৎকার। বহু ছবিতে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন মহানায়ক উত্তমকুমারের সঙ্গেও। বাবা দারুণ ছবিও আঁকতেন। নানারকম ছবি। পশু, পাখি, ফুল। দেখতাম এবং মুগ্ধ হতাম। নিজেও আঁকার চেষ্টাও করতাম। বাবা দেখিয়ে দিতেন। বলা যায়, ছবি আঁকার প্রাথমিক পাঠ পেয়েছি বাবার কাছেই। উৎসব ও পুজোর দিনে ঘরে আলপনা দিতাম। হয়তো এইভাবেই তৈরি হয়েছে আমার শিল্পীমন।’’
আরও পড়ুন-প্রয়াত প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ‘জলুবাবু’, শোকপ্রকাশ মুখ্যমন্ত্রীর
প্রাণে গান
কিছুদিন গান শিখেছেন প্রীতিকণা। উচ্চাঙ্গ সংগীত। কাকার কাছে। ছোট কাকা পণ্ডিত নিখিলজ্যোতি ঘোষ ছিলেন বিখ্যাত তবলাশিল্পী। পেয়েছেন পদ্মভূষণ সম্মান। জ্যাঠামশাই ছিলেন বংশীবাদক পণ্ডিত পান্নালাল ঘোষ। প্রীতিকণা জানালেন, ‘‘বেশিদিন গানবাজনা ধরে রাখতে পারিনি। হঠাৎ পরিবারে নেমে আসে অন্ধকার। আমার যখন দশ বছর বয়স, বাবা মারা যান। সংসারে অনটন দেখা দেয়। আমাকে নিয়ে যান জ্যাঠামশাই। তাঁর কাছে থেকেই উত্তীর্ণ হই স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায়। তারপর ফিরে আসি মায়ের কাছে।’’
আরও পড়ুন-প্রয়াত সাহিত্যিক ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
হাতেখড়ি
শৈশবে তৈরি হয়েছিল শিল্পীমন। তবে সুযোগ ঘটেনি প্রকাশের। তবে ছাইচাপা আগুন চাপা থাকে না। প্রীতিকণা ছিলেন তেমনই এক ছাইচাপা আগুন। নিজেকে মেলে ধরার অপেক্ষায় ছিলেন। এই প্রসঙ্গে তিনি একটি ঘটনার উল্লেখ করলেন, ‘‘এক বান্ধবী সেলাইয়ের কাজ করত। ওর কাজ দেখেই সেলাইয়ের প্রতি আমার আগ্রহ তৈরি হয়। একদিন ওর অনুপস্থিতিতে আমি কিছুটা সেলাই করেছিলাম। বান্ধবী খুশি হয়ে জানতে চেয়েছিল, আমি সেলাইয়ের ব্যাপারে আগ্রহী কি না। কিছু না ভেবেই সম্মতি জানিয়েছিলাম। বান্ধবীর মাধ্যমেই যোগাযোগ একটি মাড়োয়ারি কোম্পানির সঙ্গে। সেখানে হত নানা রকমের শাড়ির কাজ। তখনকার দিনে ৫০ টাকা ডিপোজিট দিয়ে শাড়ি আনতে হত। ৩০ টাকা জমা দিয়েই কিছু শাড়ি এনেছিলাম। এই ভাবেই আমার হাতেখড়ি হয় সেলাইয়ের কাজে। জরির কাজ, চুমকির কাজ, এমব্রয়ডারি, রিফু ইত্যাদি। পাশাপাশি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম কলেজের পড়াশোনা।’’
আরও পড়ুন-রান্নার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে বিক্ষোভে তৃণমূল
বিয়ের ফুল
পড়াশোনা চলাকালীন বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় প্রীতিকণাকে। স্বামী অমলেন্দু গোস্বামী। প্রতি মুহূর্তে ছিলেন স্ত্রীর সঙ্গে। সমর্থন জুগিয়ে গেছেন। আগলে রেখেছিলেন সাংসারিক রাজনীতি থেকে। কিছুদিন পর কোল আলো করে আসে দুই মেয়ে। একদিকে সংসার, অন্যদিকে সেলাই, প্রীতিকণার তখন দম ফেলার সময় নেই। মাড়োয়ারি কোম্পানির সঙ্গে সম্পর্ক ছিল ৭ বছর। মাঝে পড়েছিলেন এক পাঞ্জাবি ভদ্রমহিলার খপ্পরে। তিক্ত অভিজ্ঞতা। তারপর যুক্ত হন যোধপুর পার্কে আত্মীয়া কঙ্কণা বসুর সংস্থার সঙ্গে। সেখানে সমাদৃত হয় তাঁর কাজ। বিক্রি, প্রদর্শনী, সবমিলিয়ে দারুণ অভিজ্ঞতা।
আরও পড়ুন-পরকীয়ার অভিযোগ বিজেপি কর্মীর বিরুদ্ধে
বাঁক বদল
মেশিনে উল বোনা শেখানো হচ্ছে একটি জায়গায়, একদিন জানতে পারেন প্রীতিকণা। পরীক্ষা দিয়ে সেখানে ভর্তি হন। ক্লাসে একদিন একটি বই থেকে পছন্দের ডিজাইন নিয়ে বোনার চেষ্টা করছিলেন। পাশ থেকে লক্ষ করেন টিচার। বলেন, ‘‘তোমার হাতের কাজ চমৎকার। ট্রেনারের চাকরি করবে?’’ হাতের মুঠোয় চাঁদ পান প্রীতিকণা। বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি চাকরির সন্ধানে ছিলেন। রাজি হয়ে যান। ঘটে যায় জীবনের বাঁক বদল। শুরু হয় এক নতুন জীবন। প্রীতিকণা স্মৃতিচারণ করলেন, ‘‘লেকটাউনে সেলাই শেখাতাম সাত-আটজন মহিলাকে। তখন আমার দুই মেয়ে খুব ছোট। তাদের কোনওরকমে সামলে বেরিয়ে যেতাম। ফিরতে হতো রাত। থাকতাম গাঙ্গুলিবাগানে আমার শ্বশুরবাড়িতে। স্বামী বরাবর আমার পাশে থেকেছেন। তাঁর জন্যই হয়তো এতটা পথ এগোতে পেরেছি। কম বয়স থেকেই ছিলাম দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। জেদ ছিল অদম্য। ঘরে আটকে না থেকে চেয়েছিলাম নিজের পায়ে দাঁড়াতে। দিনের পর দিন করেছি হাড়ভাঙা পরিশ্রম। প্রায় অভুক্ত থাকতে হয়েছে বহু সময়। হাল ছাড়িনি, হার মানিনি। মনে মনে ঠিক করেছিলাম, যেভাবেই হোক রোজগার করতেই হবে। বাঁচতে হবে সৎ পথে। চেষ্টা এবং লড়াই চালিয়ে গেছি। মন দিয়ে করছিলাম চাকরি। নতুনদের শেখাচ্ছিলাম সেলাইয়ের খুঁটিনাটি।’’
আরও পড়ুন-বনগাঁয় বিজেপির গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে
নকশি-কাঁথার হাতছানি
মিসেস গুপ্ত নামে এক ভদ্রমহিলা প্রীতিকণার পাশে দাঁড়ান। নিয়ে যান ক্রাফ্টস কাউন্সিল অফ ওয়েস্ট বেঙ্গলের অফিসে। এই প্রতিষ্ঠানের সেক্রেটারি ছিলেন রুবি পাল চৌধুরি। প্রীতিকণা বলেন, ‘‘রুবিদি আমার হাতের কাজ দেখে তিনি আমাকে নকশি-কাঁথা বোনার পরামর্শ দেন। ১৯৯০ সালে রুবিদির উৎসাহে চার-পাঁচজন মহিলাকে নিয়ে তৈরি করলাম একটি সেন্টার। গাঙ্গুলিবাগানে ছোট্ট ঘরে। ডেকে নিলাম আরও কয়েকজন মহিলাকে। রুবিদি বাংলাদেশের একটা স্যাম্পল দেখালেন। বাংলার নকশি-কাঁথা। বোনা শিখলাম। শেখালাম দলের মেয়েদের। আমেরিকা থেকে অর্ডার নিয়ে এলেন রুবিদি। নাওয়া-খাওয়া ভুলে দিনরাত বুনতে থাকলাম। একদিন আমাদের কাজ প্রথমবার গেল বিদেশে। আসতে থাকল আরও অর্ডার। ধীরে ধীরে দেখলাম আলোর মুখ, সুখের মুখ। জুটতে লাগল পেট ভরা খাবার। উৎসাহিত হয়ে এগিয়ে এলেন আরও অনেক মহিলা। নকশি-কাঁথার পাশাপাশি বুনতে শুরু করলাম ওয়াল হ্যাংগিং, ওয়াল ম্যাট, কুশন কভার ইত্যাদি। বিভিন্ন মিউজিয়াম ঘুরে কাজ দেখেছি। নানাভাবে নিজেদের সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছি। জোগাড় করেছি ডিজাইনের বই। সেইগুলো দেখে ফোঁড় তুলেছি সেলাইয়ের।
আরও পড়ুন-রান্নার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে বিক্ষোভে তৃণমূল
পাশাপাশি চলছিল সংসার। দুই মেয়ে কীভাবে যে বড় হয়েছে, নিজেই জানি না। ঈশ্বর তাদের রক্ষা করেছেন। ক্রাফট কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার উদ্যোগে দিল্লিতে আয়োজিত হয় প্রদর্শনী। সেখানে আমরা যোগদান করি। নিজেদের কাজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিই সবার সঙ্গে। বহু বিখ্যাত মানুষের সমাদর পেয়ে বেড়ে যায় আমাদের আগ্রহ। ঘুরে ঘুরে পুরনো নকশি কাঁথার সন্ধান করেছি। গেছি বহু মানুষের বাড়িতে। সেইসব নকশি কাঁথার ডিজাইন দেখে তৈরি করেছি নতুন নকশি কাঁথা। এক একটি নকশি-কাঁথা বিক্রি হয়েছে প্রচুর টাকায়। চেষ্টা করেছি কোয়ালিটি বজায় রাখতে। অস্বীকার করার উপায় নেই, রুবিদির জন্যই ঘুরে যায় আমাদের ভাগ্যের চাকা।’’
ঘুরে ঘুরে সোনারপুরে
গাঙ্গুলিবাগানের পরে প্রীতিকণা উঠে আসেন বাঘাযতীনে। নতুন সেন্টারের জন্ম দেন। সেন্টারটি আজও চলছে।
আরও পড়ুন-মেয়েদের শিক্ষা বন্ধ করতে স্কুলে গ্যাস-হামলা!
২০০০ সালে সোনারপুরে বাড়ি তৈরি করে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। সোনারপুর অঞ্চলের বহু মহিলা তাঁর কাছে আসেন। শেখেন সেলাই। এইভাবে তাঁরা ধীরে ধীরে উপার্জনের মুখ দেখছেন।
বয়স তো সংখ্যা মাত্র
শেখানোর পাশাপাশি এখনও নিয়মিত সেলাইয়ের কাজ করেন প্রীতিকণা। পাশে পেয়েছেন দুই মেয়েকে। তিনি জানালেন, ‘‘মনের বয়স হয়নি। তবে শরীরের বয়স হয়েছে। জানি না আর কতদিন পারব। একদিন আমার বড় মেয়ে মহুয়া লাহিড়ীকে বলছিলাম সেই কথা। সে থাকে দুবাইয়ে। ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে বিশেষ পরিচিতি তৈরি করেছে। ২০১৭ সাল থেকে হাসনুহানা সংস্থার মাধ্যমে আমার কাজ সে তুলে ধরেছে পৃথিবীর বিভিন্ন ফ্যাশন শো, প্রদর্শনীতে। এর ফলে পেয়েছি সমাজের একটা বড় অংশের প্রশংসা। ছোট মেয়ে অঙ্কিতা রায়ও আমার সঙ্গে করে সূচিশিল্পের কাজ।’’
আরও পড়ুন-মেঘালয় : বিজেপিকে হারাল তৃণমূল
স্বীকৃতি
ফুল কখনও জানান দেয় না, সে ফুটেছে। মৌমাছিরা এমনিতেই জেনে যায়। ঢাকঢোল পেটাতে হয়নি প্রীতিকণাকেও। তাঁর কাজের কথা ঠিকই মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। আড়াল থেকে এসেছেন আলোয়। সূচিশিল্পের জন্য পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. এপিজে আবদুল কালাম তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দিয়েছেন। গেছেন আমেরিকা, ইউরোপ, দুবাই সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, রাজ্যের বাইরে দিল্লি, হায়দরাবাদ, মুম্বাই, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, আমেদাবাদ, ওড়িশা প্রভৃতি জায়গায়। অংশ নিয়েছেন সরকারি ও বেসরকারি মেলা, প্রদর্শনী, কর্মশালায়। পেয়েছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী-সহ বহু মানুষের শুভেচ্ছা।
আরও পড়ুন-পালযুগের ত্রিবিক্রম বিষ্ণুমূর্তি উদ্ধার কাটোয়ায়
এবার পদ্মশ্রী
খবরটা পেয়ে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন প্রীতিকণা। প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি নিজের কানকে। তিনি জানান, ‘‘খুব সাধারণ মহিলা আমি। শুরু করেছি শূন্য থেকে। কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে দিয়েই কেটেছে জীবন। কোনওদিন ভাবিনি পদ্মশ্রী পাব। এই সম্মান যেন আমার সততা, নিষ্ঠা ও একাগ্রতার স্বীকৃতি। তবে এখানেই থেমে থাকব না। নিজেকে ডুবিয়ে রাখব নিত্যনতুন কাজে। তুলে আনব নতুন নতুন মেয়েদের। তাদের করে তুলবব স্বনির্ভর। এটাই আমার আগামী দিনের লক্ষ্য।’’
তাঁর ভ্যালেন্টাইনরা
সম্প্রতি একটি ঘটনা খবরের কাগজে প্রকাশিত হয় যা পড়ে বহু মানুষ অভিভূত হয়েছিলেন, হৃদয় নাড়া দিয়ে গিয়েছিল যেন। একটি সদ্যোজাত পথশিশুর পুনর্জন্ম ‘ভ্যালেন্টাইন’ হয়ে। হ্যাঁ, তার নাম ‘ভ্যালেন্টাইন’। স্মরণীয় দিনে শিশুটির এক স্মরণীয় নামকরণ। নামকরণ করেছিলেন সল্টলেকের সমাজসেবী এবং নৃত্যশিল্পী ইন্দ্রাণী গঙ্গোপাধ্যায়। মেয়েটির জন্ম হয়েছিল নামকরণের ঠিক একমাস আগে। খুব অসুস্থ ছিল সে আর তার মা। বাবা বছর পঁচিশের গৌতম গায়েন আর মা চন্দ্রিমা গায়েনের সন্তান ছোট্ট ভ্যালেন্টাইন। যাঁদের ঠিকানা হল অস্থায়ী গড়িয়াহাটের আধাঝুপড়ি। শুনতে অবাক লাগলে এটাই জীবনের চরম সত্য। এই দুই ঝুপড়িবাসীর চরম সংকটের মুহূর্তে যেন ঈশ্বরের মতো তাঁদের দরজায় এসে হাজির হয়েছিলেন ইন্দ্রাণী গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি পেশায় শিক্ষিকা, নেশায় নৃত্যশিল্পী। সমাজসেবাও শুরুর দিন থেকেই। আসলে সমাজসেবা কোনও শখ নয়, এটা মনের গভীরে কোথাও প্রোথিত থাকে। যেমনটা ছিল ইন্দ্রাণী গঙ্গোপাধ্যায়ের মনে।
আরও পড়ুন-টাইব্রেকার অনুশীলন মোহনবাগানে, ফাইনাল ভেবেই নামবেন বুমোসরা
নাচ ভালবেসে
নাচের প্রতি ভাল লাগা আর ভালবাসা সেই ছোট থেকেই আর সেই নাচের মধ্যে দিয়ে অনাবিল আনন্দ আরোহণ এবং সমাজসেবা দুই করেছেন ইন্দ্রাণী। মায়ে অনুপ্রেরণাতেই ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়া। বর্ধমানের পদ্মজা নাইডু মিউজিক কলেজে বিশ্বভারতীর পণ্ডিত শঙ্করনারায়ণজি আসতেন, তাঁর কাছেই প্রথম ভরতনাট্যমে হাতেখড়ি। উচ্চশিক্ষার শেষে নাচের প্রশিক্ষণ নিতে দু’বছরের জন্য বিশ্বভারতী যান। লোকনৃত্যের তালিম নিয়েছেন, তারপর গোবিন্দনারায়ণ কুট্টি, থাঙ্কমণি কুট্টির কাছেও প্রশিক্ষণ নেন। গানেও রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে সংগীত বিশারদ করছেন। না, প্রথাগত ছকবাঁধা কাজ তিনি কখনও করতে চাননি। তাই চেয়েছিলেন অন্যপথে হাঁটতে। একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করতে করতে ভাবনাচিন্তার শুরু।
আরও পড়ুন-আমজনতার সঙ্গে মিশে গেলেন জঙ্গলকন্যা বীরবাহা
পথশিশুদের লড়াইতে শামিল
পথশিশু বা রাস্তায়-বস্তিতে থাকে যেসব বাচ্চারা, একমুঠো ভাতের জন্য যাদের দিনরাতের লড়াই, তারা নাচ-গান শিখবে এমন কথা ভাবাটাও তো বাতুলতা। সেই সুযোগটা কে দেবে তাদের। কিন্তু এরাই সুযোগ পেলে হয়তো ফিরতে পারে জীবনের মূলস্রোতে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। দুর্ভাগ্য, নিপীড়িত জীবন থেকে মিলতে পারে মুক্তি। এমন ভাবনা থেকেই ইন্দ্রাণী গঙ্গোপাধ্যায় প্রথম শুরু করলেন নাচের একটি ছোট্ট স্কুল। তখনও সৃষ্টি ডান্স অ্যাকাডেমি নামকরণ হয়নি সেই স্কুলের। বাড়িতে বিনা পারিশ্রমিকে পথশিশুদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করলেন। তারপর একটি মন্তেসরি স্কুলের ছোট পরিসরে সেখান থেকেই এই সৃষ্টি ডান্স অ্যাকাডেমির পথচলা শুরু হয়। ধীরে ধীরে ডানা মেলে তার এই ডান্স অ্যাকাডেমি। বিগত কুড়ি বছর ধরে তিনি চালাচ্ছেন এই স্কুল।
আরও পড়ুন-প্রয়াত সাহিত্যিক ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
বিশেষ চাহিদাসম্পন্নরা
শুধু পথশিশু নয়, সঙ্গে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন বা স্পেশাল চাইল্ডদের নিয়েও তাঁর লড়াই। নিজের ডান্স অ্যাকাডেমিতে তো বটেই, উত্তর কলকাতায় ‘সংবেদন’ নামক একটি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের সংস্থা রয়েছে যেখানে গিয়ে নৃত্যের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন নিয়মিত। তাদের নাচের তালিম দেওয়া খুব সহজ কাজ ছিল না। এই সব বাচ্চাদের সঙ্গে রীতিমতো কমিউনিকেট করেছেন এবং দক্ষতার সঙ্গে নাচ শেখাতে সক্ষম হয়েছেন। মূলত শিশুকন্যা ও কিশোরীরাই তাঁর স্টুডেন্ট। মেয়েদের জন্যই কিছু করতে চেয়েছিলেন কারণ তিনি নিজে একজন নারী। তিনি মনে করেন সমাজের যে কোনও বাধা মেয়েরাই যেন বেশি পায়। প্রতিটা কষ্ট, যন্ত্রণা আপসের জীবনসংগ্রাম যেন তাদের ভাগ্যেই লেখা থাকে। তাই মেয়েদের জন্যই কিছু করতে হবে, তাদের উন্নতির কথাই প্রথম মাথায় এসেছিল। যদিও পরের দিকে মেনস্ট্রিম একটা নাচের গ্রুপ তৈরি করেছেন তিনি। যারা সুস্থ এবং আর্থিকভাবে সম্পন্ন। তাদের কাছ থেকে সামান্য পারিশ্রমিক নেন ইন্দ্রাণী কারণ যে কোনও লড়াইয়ে অর্থ একটা বড় বিষয়। তথাপি মূল কেন্দ্রবিন্দুতে পথশিশু এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা।
আরও পড়ুন-অব্যাহত প্রতিহিংসার নীতি
নানা কর্মযজ্ঞে
ইন্দ্রাণী গঙ্গোপাধ্যায় এবং তাঁর সৃষ্টি ডান্স অ্যাকাডেমির পাশাপাশি দিনে দিনে তাদের বিস্তার ঘটাল আরও নানা ধরনের কর্মযজ্ঞে শামিল হল। একটি ক্যানসার আক্রান্ত শিশুর চিকিৎসার সমস্ত বন্দোবস্ত করেছিলেন ইন্দ্রাণী। কাজ করেছেন শহরের বিভিন্ন রেডলাইট এরিয়াতে। এরাও তো ব্রাত্যই। কোভিডের সময় কালীঘাট অঞ্চলের যৌনপল্লি, সোনাগাছিতে গিয়ে খাদ্য, পানীয়, বস্ত্র ও নানা প্রয়োজনীয় সামগ্রী দিয়েছেন। এই সব নিষিদ্ধপল্লিতে পৌঁছে গিয়ে সেখানকার বাচ্চাদের নৃত্যের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। যাতে এই সব ছেলেমেয়েরা ভবিষ্যতে চাইলে মূলস্রোতে ফিরে আসতে পারে। ওখানকার মহিলাদের পাশেও দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের সুবিধা-অসুবিধা জেনে চেষ্টা করেছেন প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করার। এখানেই শেষ নয়, রাতে বাড়ি ফিরে রোজ এলাকার বস্তিবাসীর বাচ্চাদের বিনামূল্যে পড়ান ইন্দ্রাণী। তাঁদের পড়াশুনোর সামগ্রীর জোগান দেন। যাতে খানিকটা এগোতে পারে এই সব ছেলেমেয়েরা।
আরও পড়ুন-ভাঙলেন লিয়ন, জয়ের মুখে অস্ট্রেলিয়া
ভালবাসার উপহারে
ভ্যালেন্টাইন ডে, যাকে বলে ভালবাসার দিন। সেই দিনটায় তিনি দিয়েছেন অমূল্য, ভালবাসার উপহার ছোট্ট ভ্যালেন্টাইন এবং তার ছোট ছোট সঙ্গীসাথীদের। তার জীবনে এই ঘটনা নিছকই কাকতালীয় হলেও পরে আর তা কাকতালীয় হয়েই থেকে যায়নি। এমনটাই জানালেন ঝুপড়িবাসী গৌতম গায়েন ও তাঁর স্ত্রী চন্দ্রিমা গায়েন। তাঁদের কথায়, সেদিন দিদির সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়াটা যেন ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছিল। যদিও ইন্দ্রাণী বলেন, তাঁর জীবনে এটা এক আকস্মিক ঘটনা। সত্যি সেই ঘটনা বড় মর্মভেদী। ভাল পরিবারের ছেলে হয়েও কোনও এক দুর্বিপাকে গৌতমের জন্মকর্ম রাস্তার ফুটপাথ, ব্রিজের তলা, পার্কে ধার। অপূর্ব গানের গলা। রাজমিস্ত্রির কাজ করা গৌতম নিজের জমার পুঁজি দিয়ে একটি গিটার কিনছিলেন। নিজের চেষ্টায় শিখেছিলেন সেই গিটার বাজানো। পথের ধারে গিটার বাজিয়ে তাঁর জীবনধারণ। স্ত্রী চন্দ্রিমা তখনও গৌতমের জীবনে আসেননি। এক পূর্ণ ভালবাসার গল্প যেন। জীবন নিয়ে একটা বড় জুয়া খেলে ফেলেছিলেন গৌতমকে ভালবেসে চন্দ্রিমা। বলে না টাকা না থাকলে ভালবাসা জানলা দিয়ে গলে পালায়। কিন্তু এ তো বড় আলাদা ছবি! গান শুনেই ভালবেসে সর্বত্যাগী হয়ে চন্দ্রিমা ফুটপাথকে করলেন তাঁর ঘর- বাড়ি। গড়িয়ায় ভাল বাড়ির মেয়ে কোনও সম্পর্ক রাখেননি, তাঁর সঙ্গে যথারীতি বিতাড়িত হলেন। কিন্তু হাল ছাড়েননি তাঁরা। স্বপ্ন ছিল একদিন সুখের মুখ দেখবেনই আর গৌতমকে তিনি নিজের পায়ে দাঁড় করাবেন। তখন পার্ক স্ট্রিট, রবীন্দ্রসদন, নন্দন এইসব জায়গায় গান গেয়ে তাঁর ভিক্ষাবৃত্তি। বাস্কিন নামেই তাঁকে চিনতে শুরু করল সবাই। সেই লড়াইতেই কেটে যাচ্ছিল কোনওক্রমে। কিন্তু ফুটপাথে কি স্বস্তি পাওয়া যায়! ওটা যে বেআইনি বাসস্থান। তাই তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়ে গিটারটা গেল ভেঙে তখন আর কি কোনওমতে চলছিল অন্যের সাহায্যে।
আরও পড়ুন-সপ্তাহে পাঁচদিন খোলা থাকবে ব্যাঙ্ক, ব্যাঙ্ক পরিষেবার সময় বাড়তে চলেছে
এমতাবস্থায় জন্ম নিল গৌতম ও চন্দ্রিমার মেয়ে। জন্মে থেকেই বেশ অসুস্থ। বাচ্চাটির জন্ডিস যা বেশ বাড়াবাড়ি পর্যায়ে। কী করে হবে চিকিৎসা। এমন একটা সময় হঠাৎ ইন্দ্রাণী গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁদের দেখা। রাস্তায় পড়ে যাওয়া তাঁর টাকার ব্যাগ ফিরিয়ে দেন গৌতমের স্ত্রী। আলাপ হয়। তাঁদের গল্প শোনেন। খানিকটা স্তম্ভিত ইন্দ্রাণী। এরপর আর চিন্তা করেননি। পাশে এসে দাঁড়ান। প্রায় দুই দফায় হাসপাতালে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এর পাশাপাশি ব্যক্তিগত সাহায্য তো ছিলই। বাচ্চাটির জামা, দুধ সবকিছুর দায়িত্ব তুলে নেন। গৌতমের শখের গিটারটাও ফিরিয়ে দেবেন ভাবলেন ইন্দ্রাণী তাঁরই অনুরোধে। তখন তিনি গৌতমকে বলেন, আমি তোর গিটারটা ফেরত দেব এবং এই বস্তির বাচ্চাদের পড়াশুনো সামগ্রীও দেব। যেমন ভাবা তেমন কাজ ১৩ ফেব্রুয়ারি গৌতমের মেয়ে সুস্থ হয়ে ফেরার পর ১৪ ফেব্রুয়ারি একটি সুন্দর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হল গৌতমের থাকার জায়গায় রাস্তাতেই। সেখানকার ২৫টা বাচ্চাকে স্কুল ব্যাগ, টিফিনবক্স, ওয়াটার বটল, খাতা বই, পেনসিল বক্স, আঁকার খাতা, কালার পেনসিল, খাবারের প্যাকেট, ফল দেওয়া হল সঙ্গে। ইন্দ্রাণী ফিরিয়ে দিলেন গৌতমের শখের গিটারটিও। পাশে পেয়েছিলেন সৃষ্টি ডান্স অ্যাকাডেমি গ্রুপের ছাত্রীদের। তিনি ওইদিন মেয়েটির নামকরণ করলেন ‘ভ্যালেন্টাইন’। ভালবাসার সেই দিনে গৌতমের এলাকার ফুটপাথবাসী শিশুরাও পেল ভালবাসার উপহার।
আরও পড়ুন-কাপজয়ী সতীর্থদের সোনার আইফোন উপহার মেসির
মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ হয়েও তিনি প্রতিমুহূর্তে পাশে দাঁড়িয়েছেন সমাজে পিছিয়ে থাকা, অবহেলিত শিশুর পাশে। তিনি এবং তাঁর সৃষ্টি অ্যাকাডেমি ডান্স টিম আগামী দিনে আরও অনেক পরিকল্পনা রেখেছেন যা থেকে আরও অনেক মানুষ এবং পথশিশুরা পাবে নতুন পথের দিশা।