পারিপার্শ্বিক জটিলতা উচ্চ রক্তচাপের অন্যতম কারণ

আগামী ১৭ মে বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন দিবস। এই রোগ বর্তমান সময়ের মস্তবড় সমস্যা। বয়স্কদের পাশাপাশি আক্রান্ত হচ্ছে কমবয়সিরাও। কারণ কী? কীভাবে সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকা যায়? ডাঃ অজয় বিশ্বাস-এর সঙ্গে কথা বলে জেনে নিলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

উচ্চ রক্তচাপ কেন হয়?
শিরা-উপশিরায় আমাদের রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। কোনও কোনও সময় রক্তপ্রবাহ শিরার দেওয়ালে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। এটাই উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন। এটা হয় রক্ত চলাচলের রাস্তায় প্রতিরোধ ঘটলে। যেমন, কোনও মানুষের শরীরে খারাপ কোলেস্টেরল মাত্রা বেশি থাকলে বোঝাই যায়, রক্ত চলাচলের রাস্তায় স্তরে স্তরে তা জমতে থাকে। ক্রমশ সরু হচ্ছে ধমনি। যেভাবে পলি জমে নালি সরু হয়। পথ সরু হবার ফলে কমে যায় প্রবাহ। তখন প্রবাহ বাড়াতে হার্টকে বেশি চাপ দিতে হয়। বেড়ে যায় রক্তচাপ। আর একটা বিষয় বলি, সুস্থ মানুষ বিপাকীয় ক্রিয়ার মাধ্যমে খাবার জ্বালিয়ে শরীরে শক্তি উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু যেহেতু ডায়াবেটিক মানুষের সেই জায়গাটা কমজোরী, সেহেতু পুরোটা শক্তি উৎপাদনে ব্যবহার করতে পারে না। অব্যবহৃত জ্বালানি যেটা শরীরে থেকে যায়, সেটা চর্বিতে কনভার্ট হয়। শরীরে চর্বি জমা মানেই রক্ত চলাচলের সমস্যা। এর ফলে বাড়ে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক। যারা ঠ্যালা বা রিকশা চালায়, তাদের হাতের মাসলগুলো ফুলে থাকে। একই ঘটনা ঘটে যারা ব্যায়াম করে তাদের ক্ষেত্রেও। মাসল যত মোটা হয়, তত বেড়ে যায় তার অক্সিজেন চাহিদা, কমে যায় রক্তের আদান-প্রদান ক্ষমতা। তাই রক্তচাপ যত বাড়ে, হার্টের মাসল মোটা হয় আর তার মধ্যে রক্ত চলাচলও তত কমে যায়। এর ফলেও হতে পারে হার্ট অ্যাটাক। ক্লটগুলো ছিটকে গিয়ে মস্তিষ্কের নালিতে জমা হলে হয় সেরিব্রাল অ্যাটাক। মনে রাখতে হবে, উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনির সমস্যাও দেখা দিতে পারে।

আরও পড়ুন-ভ্রাম্যমাণ আদালতে আদায় ট্রাফিক জরিমানা

উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ কী?
উচ্চ রক্তচাপের আলাদা কোনও লক্ষণ নেই। ম্যালেরিয়া হলে জ্বরের সঙ্গে কাঁপুনি হয়, ইউরিন ইনফেকশন হলে মূত্রদ্বারে জ্বালা করে, লুজ মোশন হলে বোঝা যায় পেটখারাপ। কিন্তু উচ্চ রক্তচাপ হলে অল্পতেই ক্লান্তি লাগা বা হাঁফ ধরা ছাড়া কিছুই বোঝা যায় না। এই সমস্যা ধরা পড়ে কোনও না কোনও ঘটনার মধ্যে দিয়ে। কীরকম? সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে হঠাৎ বুকে যন্ত্রণা, ইসিজিতে ধরা পড়ল গেল হার্ট অ্যাটাক। আবার চলতে গিয়ে মাথা টলে গেল। খানিকক্ষণ অজ্ঞান। স্ক্যান করে বোঝা গেল স্ট্রোক। যদি প্রথম পর্যায়ে উচ্চ রক্তচাপ শনাক্ত করা যায় এবং চিকিৎসা শুরু করা যায় তাহলে সমস্যা এড়ানো সম্ভব। দূর করা যায় হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, কিডনির জটিলতা। একটা কথা মনে রাখতে হবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি হয়েছে। এখন ভ্যাকসিন নিয়ে আমরা অনেক ইনফেকশনকে কন্ট্রোল করতে পারি। ইনক্লুডিং কোভিড। ইনফেকশন কমাতে প্রয়োগ করতে পারি বিভিন্ন রকমের অ্যান্টিবায়োটিক। তবে মনে রাখতে হবে, প্রতিদিন যত মানুষ মারা যাচ্ছে, তারমধ্যে বেশিরভাগ মানুষ মারা যাচ্ছে নন-ইনফেকশন ডিজিজে। এই তালিকায় আছে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হাঁপানির সমস্যা, কিডনির সমস্যা। এইগুলোই বৃহত্তর মারণব্যাধি। হার্ট অ্যাটাকের হাত থেকে বাঁচতে হলে আমাদের সুগার, প্রেসার, লিপিড প্রোফাইল ইত্যাদির উপর ফোকাস করতে হবে।

আরও পড়ুন-নিউটাউনে নতুন উড়ালপুল চালু হচ্ছে আগামী বছর

রেগুলার চেকআপ করানো উচিত?
যে কোনও মানুষের নিয়মিত প্রেসার মাপা প্রয়োজন। থাকতে হবে চিকিৎসকের নিয়মিত তত্ত্বাবধানে। সমস্ত চেক আপ করতে হবে অন্তত বছরে একবার।
আর কী করতে হবে?
কমাতে হবে প্রতিদিন নুন খাওয়ার মাত্রা। প্রথমে অন্তত এক-তৃতীয়াংশ কমানোর চেষ্টা করতে হবে। খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রাও কমাতে হবে। এমন কোনও খাবার খাওয়া উচিত নয় যেটা কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায়। দূরে থাকতে হবে তেল এবং চর্বিযুক্ত খাবার থেকে। যাঁরা ধূমপান এবং মদ্যপান করেন, তাঁদের বেশি সাবধানে থাকতে হবে। নাহলে যে কোনও সময় সমস্যা দেখা দিতে পারে।
এই নিয়ন্ত্রণ কত বছর বয়স থেকে করা উচিত?
বয়স যত বাড়ে, তত উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা দেখা দেয়। চল্লিশ পেরোলেই বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। বিশেষত যাঁদের উচ্চ রক্তচাপ, লিভার, থাইরয়েড, কিডনির সমস্যা আছে। লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষা করে দেখতে হবে। উচ্চ রক্তচাপ যাঁদের বেশি তাঁদের নিয়মিত পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে। এখন বিভিন্ন রকমের যন্ত্রপাতি বেরিয়েছে। চাইলে নিজে নিজেই প্রেসার মাপা যায়। ঠিক রাখতে হবে লিভার। অনিয়মিত জীবন যাবনের জন্য অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা এই সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে। জীবনের দ্বিতীয় বা তৃতীয় দশকের ছেলেমেয়েদের মধ্যেও দেখা দিচ্ছে হার্টের সমস্যা। ফার্স্ট ফুড, জাঙ্ক ফুড এড়িয়ে চলতে হবে। জীবনকে চালাতে হবে স্বাভাবিক পথে।

আরও পড়ুন-স্কুল নিরাপত্তায় সেফটি অডিট

উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা কি জিনগত?
কিছুটা জিনগত তো বটেই। পাশাপাশি অন্যতম কারণ পারিবারিক এবং পারিপার্শ্বিক জটিলতা। ধরা যাক, একটি জটিলতা সম্পন্ন পরিবারে একটি সন্তান দেখল বাবা-মায়ের মধ্যে রোজ ঝগড়া হয়। সেই সন্তান কিন্তু উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় পড়তে পারে। কর্মক্ষেত্রে বিতর্ক, প্রতিকূল পরিবেশ এই সমস্যার বড় কারণ হতে পারে। অ্যাড্রিনালিন গ্রন্থির ক্ষরণের ফলে বেড়ে যায় রক্তচাপ। তাই শুধু জিনগত নয়, সমস্তকিছু নির্ভর করে জীবনশৈলীর উপর।
সুস্থ-স্বাভাবিক থাকা যায় কীভাবে?
নিয়মিত খাদ্যাভ্যাস, পরিমিত খাদ্যাভ্যাস, সুষম খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। খেতে হবে প্রচুর পরিমাণে ফল, সবজি, পর্যাপ্ত জল। উপযুক্ত ঘুম, বিশ্রাম প্রয়োজন। চাই মানসিক প্রশান্তি। অবসাদ দূর করতে হবে। নিয়মিত হাঁটাচলা, ব্যায়াম করতে পারলে খুব ভাল। মোটকথা শরীর থেকে ঘাম ঝরাতে হবে। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এইগুলো মেনটেন করলে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা কম দেখা দেয়। পরিশেষে বলি, প্রতিদ্বন্দ্বী না ভেবে সবার সঙ্গে স্থাপন করতে হবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। লড়াই করে বাঁচা যায় না। তাই যেভাবে হোক, লড়াই থেকে দূরে থাকতে হবে। মনের মধ্যে করতে হবে আনন্দের সঞ্চার। তবেই সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকা যাবে।

Latest article