মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গে তৃতীয়বারের সরকার দু’বছর পার করল। রাজ্য সরকারের ১২ বছর পূর্ণ হল। ১০ বছর একটানা উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরকার দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী কাজ করেছে। যা দিয়ে দেশে-বিদেশে বহু আলোচনা হয়েছে এবং এমনও আলোচনা চলছে। একদিকে সমালোচনার বাঁকা সুর, তো অন্যদিকে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা। সব মিলিয়ে শেষ বিধানসভা নির্বাচনে বাংলা দখলে উঠে পড়ে লাগা বিজেপিকে বড় ব্যবধানে পরাজিত করে পরপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃতীয়বারের সরকার গঠন অনেককেই অবাক করে দিয়েছিল। প্রমাণ হয়েছিল, বাংলা তার নিজের মেয়েকেই চায়। বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বিজেপিকে চায় না, তা আর একবার প্রমাণ হল। এক্ষেত্রে সরকারের সামাজিক প্রকল্পগুলির একটা বিশেষ ভূমিকা যেমন আছে, তেমনই আছে বিজেপি-বিরোধিতার বঙ্গীয় স্বকীয়তা এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপুল জনপ্রিয়তা। প্রকৃত সত্য হল, সিপিএম-কংগ্রেস বিজেপির অশুভ আঁতাঁত— সিপিএম-কংগ্রেসকে বিধানসভায় শূন্য করে দিয়েছে। ভোট ট্রান্সফার হয়েছে বিজেপিতে।
আরও পড়ুন-চার্লস ফিলিপ আর্থার জর্জের অভিষেক অনুষ্ঠানে থাকছেন সোনম কাপুর
সারা ভারতে বিজেপির অপশাসন ও বাংলার উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ডের যুগপৎ ভূমিকাকে স্বীকার করে নিয়েও বলতে হবে মানুষের ভূমিকা ছিল নির্ণায়ক। ‘নো ভোট টু বিজেপি’ ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনের কথা।
বাংলা আজ দেশের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানে রয়েছে। আমরা ১ নম্বর জায়গায় আছি— একশো দিনের কাজে, ক্ষুদ্র শিল্পে, গ্রামে বাড়ি তৈরির ক্ষেত্র, গ্রামে রাস্তা তৈরির ক্ষেত্র, সংখ্যালঘু বৃত্তি প্রদানের ক্ষেত্রে, স্কিল ডেভেলপমেন্টের ক্ষেত্র, ই-টেন্ডারিং ও দারিদ্র দূরীকরণের ক্ষেত্র। রাজ্যের ৯০ শতাংশেরও বেশি মানুষ বিভিন্ন সরকার কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার পৌঁছে যাচ্ছে পাড়ায় পাড়ায় মানুষের দোরে। এ এক অভিনব কর্মসূচি।
সরকারের অন্যায় সমালোচনায় বিরোধী দলগুলি এই সময়ে যত ব্যস্ত থেকেছে, তার থেকে কম গুরুত্ব দিয়েছে মানুষের ভাবনাকে। ব্যাপক মানুষের আস্থা এমনও মমতার দিকে।
আরও পড়ুন-বেথুন স্কুলের ১৭৫ বছর, রাজপথে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা
গত দু’বছরে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে এবং ব্যক্তি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে বাড়তি উৎসাহ নিয়ে বিরোধীরা ছোট পরিসরে রাস্তায় নেমেছে। দুর্নীতি হল তাদের প্রধান ইস্যু। কলকাতাকে কেন্দ্র করে তাঁরা হইহট্টগোল পাকাচ্ছে। দুর্নীতি হয়। আইনি কার্যক্রম চলে। বিচারও হয়। এটা কোনও নতুন কথা নয়। নতুন বিষয় হল, সিবিআই-ইডির বিশাল তৎপরতা। এবং তার সিংহভাগই বিরোধী দলগুলির বিরুদ্ধে। সংবাদমাধ্যম প্রতিদিনই বিচার করছে। দুর্নীতি হয়ে থাকলে তার বিচার হোক। এতে তো কেউ আপত্তি করছে না। আপত্তি উঠছে সকলকে ‘চোর’ বলায়। এটা মানুষ বিশ্বাস করে না। সমালোচক দলগুলি কেউই দুর্নীতিমুক্ত নয়। মানুষ সেকথাও জানে।
আরও পড়ুন-তৃণমূল সরকারের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি: ‘লড়তে হবে, জিততে হবে’,বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর
যথাযথ যুক্তি না থাকলে, বড় গণআন্দোলন গড়ে ওঠে না আর ব্যাপক মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনও আন্দোলন নির্ণায়ক হয়ে উঠতে পারে না। বিরোধীরা সেটা না বুঝে বেশি বেশি করে আদালত নির্ভর হয়ে পড়ছে এবং আদালতের অতিতৎপরতাও লক্ষ করা যাচ্ছে।
একদিকে যখন ‘দুর্নীতি-দুর্নীতি’ করে একধরনের অতিসক্রিয়তা সমাজকে বিরূপ করে দিচ্ছে, অন্যদিকে এই দু’বছরে সরকার তার উন্নয়নমূলক কাজ অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিশ্রুতিমতো খাদ্যসাথীর আওতায় প্রায় ৯ কোটি মানুষকে বিনামূল্যে রেশন দেওয়া হচ্ছে। ‘মা’ প্রকল্পে গরিব মানুষদের দুপুরের খাবার মাত্র ৫ টাকায় দেওয়া হচ্ছে। ২১টি মেডিক্যাল কলেজে মা ক্যান্টিন সাফল্যের সঙ্গে চলছে।
আরও পড়ুন-মানুষের স্বার্থে কাজ করে চলেছে, মা-মাটি-মানুষের সরকার
‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার সম্পূর্ণ নতুন প্রকল্প। মহিলাদের সম্মান জানিয়ে এই প্রকল্পের শুরু। অতিদ্রত এই প্রকল্পে প্রায় ১ কোটি ৯০ লক্ষ মহিলা প্রতিমাসে প্রকল্পের টাকা পাচ্ছেন। ৬০ বছর বয়স হয়ে গেলে তারা বার্ধক্য ভাতা পাবেন। প্রমাণ হচ্ছে মহিলাদের জন্য এই প্রকল্প কতটা প্রয়োজনীয় ছিল।
নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কৃষকবন্ধু প্রকল্পের সহায়তার পরিমাণ ৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে বছরে ১০ হাজার টাকা করা হয়েছে। ন্যূনতম সহায়তা ২ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪ হাজার টাকা করা হয়েছে। নথিভূক্ত চাষির সংখ্যা প্রায় ৯২ লক্ষ। ৭১ হাজার ৮০৫টি কৃষক পরিবার মৃত্যুজনিত সহায়তা পেয়েছেন প্রায় ১৫৫০ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন-লালন শেখ মামলায় রাজ্য পুলিশেই আস্থা কোর্টের নির্দেশ সিবিআইকে
‘স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড’ প্রকল্প চালু হওয়ার পর ৫০ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ১৫০০ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর হয়েছে। এসবই সরকারের কথা দিয়ে কথা রাখার দৃষ্টান্ত। কত মানুষ কোন কোন ক্ষেত্রে সরকারি সুবিধা নিয়মিত পাচ্ছেন সেসব লিখতে বিরাট পরিসরের প্রয়োজন। তবে একটা কথা বলতে হবেই যে, ১১ সালের পর থেকে চালু হওয়া জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব প্রকল্পই চলছে। বন্ধ হয়নি একটাও।
বিজেপি সংবিধান মানছে না। দেশের গণতন্ত্র, সংবিধান, যুক্তরাষ্ট্রীয়তা আজ ‘বিপন্ন’। এই অবস্থায় সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন। ২৪ সালে লোকসভার ভোট এবং ২৬ সালে আবার বিধানসভা নির্বাচন। বিজেপি আবারও বাংলা দখলের লক্ষ্যে সক্রিয়। যে কোনও মূল্যে তারা বাংলা দখল করতে চায়। তাদের বিভাজনের রাজনীতি নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে। রামনবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে যে দাঙ্গা বাধানোর পরিকল্পনা তারা নিয়েছিল, তা স্পষ্ট। বিভিন্ন জায়গায় গোলমাল পাকিয়ে বিশেষ করে সংখ্যালঘু মানুষকে তারা ভয় পাইয়ে দিতে চায়। মিথ্যা প্রচার এবং নানাপ্রকার ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে আরএসএস-বিজেপি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিপরীতে বিজেপি গা-জোয়ারি দেখাচ্ছে নানা জায়গায়। সঙ্গে সঙ্গে চলছে উসকানি এবং মৃতদেহের রাজনীতি। সিপিএম-কংগ্রেসের ভূমিকা বিজেপিকে মদত জোগাচ্ছে। বামফ্রন্টের ‘জবরদস্ত’ উত্থানের গল্প ফেঁদে সিপিএম তার পাপ ঢাকতে চাইছে এরাজ্যে তৃণমূলকে প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে। দেশব্যাপী বিজেপি-বিরোধী শক্তির এগিয়ে যাওয়ার পথে তারা বাধা তৈরি করছে। কংগ্রেসের ভূমিকাও তথৈবচ। এরাজ্যে বিরোধী রাজনীতিকে নেতিবাচকতা গ্রাস করেছে। সরকারের কোনও ভাল কাজকে এরা ‘ভাল’ বলতে পারে না। কোনও ইতিবাচক মনোভাব নেই তাদের।
আরও পড়ুন-টার্মিনাল থেকে আয় দু’শো কোটি
দেশের সংবিধান ও গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার লক্ষ্যে দেশব্যাপী ‘বিজেপি হঠাও, দেশ বাঁচাও’ আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিজেপি-বিরোধী সমস্ত শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করাটাই এখন সময়ের ডাক। সেই ডাকে যারা সাড়া দেবে না, তারা ইতিহাসে আস্তাকুঁড়ে স্থান পাবে।