বাঙালির শেষ পাতে মহারাজ মিষ্টি

মিষ্টি ছাড়া কোনও উৎসব সম্পূর্ণ হয় না। তাই স্বাস্থ্য সচেতনতার কথা মাথায় রেখে মিষ্টি খান এবং মিষ্টি দিয়ে সম্পর্ক আরও মিষ্টি করে তুলুন। লিখলেন রিনিকা দাস

Must read

বাঙালির কাছে মিষ্টি (Sweets) মানেই জিভে জল। শেষ পাতে মিষ্টি থাকবে না মানতে চায় না বাঙালির মন। কিন্তু স্বাস্থ্য সচেতনতার যুগে মিষ্টি মানুষের শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংগীত জগতে ফিউশন কথাটা শোনা যায়, তাই বলে সন্দেশের ফিউশন। মিষ্টির সঙ্গে মানুষের অনবদ্য মিষ্টি সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখার এক অনন্য উদ্যোগে কলকাতার বহু ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মধ্যে ভীম নাগ’স ব্রাদার শ্রীনাথ নাগ (Bhim Nag’s Brother Sreenath Nag) অন্যতম।

‘চিনি’ স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক। ফলে কিছুটা বাধ্য হয়েই মিষ্টি থেকে বিরতি নিচ্ছে মানুষ। স্বাস্থ্য সচেতনতার কথা মাথায় রেখেই সন্দেশের ফিউশন ঘটিয়ে নতুন নামে, নতুন সাজে মিষ্টি এনেছে বাঙালির পাতে। এই অভিষেকেই যাবতীয় আকর্ষণের কেন্দ্রে নিজেদের মেলে ধরতে প্রস্তুত এই ঐতিহ্যশালী মিষ্টি প্রস্তুতকারী সংস্থা। ভীম নাগ’স ব্রাদার শ্রীনাথ নাগের (Bhim Nag’s Brother Sreenath Nag) অন্যতম কর্ণধার রূপা নাগ বলছেন, ‘‘এখন সুগার ও ফিগার কনসাস যুগে কীভাবে সন্দেশকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা যায় ও সন্দেশের ফিউশন ঘটানো যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছি আমরা। আমাদের তৈরি সন্দেশে রয়েছে নানা বৈচিত্র। দিলখুশ, আবার খাব, প্রাণহারা, মনোহরা, বসন্ত বাহার, পারিজাত, প্যারাডাইস, রোজক্রিম— এই পদগুলো প্রায় দেড় শতাব্দী ধরে বানিয়ে বিক্রি করছি। পাশাপাশি আমাদের বিশেষত্ব নলেন গুড়ের ‘মটকা মালাইকারি’। রসগোল্লার ক্রাঞ্চকে ঘন দুধের মালাইতে ফুটিয়ে মটকাতে করে সার্ভ করা হচ্ছে। তার ওপরে থাকছে পিস্তাচিও।”

আরও পড়ুন: কবিগুরুর জন্মজয়ন্তীতে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের

ভীম নাগ মানেই সন্দেশ। ১৮২৬ সালে ভীম নাগের বাবা পরানচন্দ্র নাগ জনাই থেকে এসে বউবাজারে মিষ্টির দোকান করেন। পরে ভীম নাগ সেই ব্যবসাকেই এগিয়ে নিয়ে যান। ভীম নাগের একমাত্র ভাই ছিলেন শ্রীনাথ নাগ। পরবর্তীকালে ভীম নাগ’স ব্রাদার শ্রীনাথ নাগ আলাদা সংস্থা হিসাবে মিষ্টির ব্যবসা শুরু করে।

এখানের সেরা চমক হল লোভনীয় স্বাদের ও লোভনীয় নামের মিষ্টি। শুধু এখানেই শেষ নয়, মিষ্টির নামে জড়িয়ে রয়েছে এক অনন্য বিষয়। ইতিহাসের পাতায় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নাম তো আমরা পাই, কিন্তু মিষ্টির মধ্যেও বিপ্লবীদের নাম বিরল ব্যাপার। মিষ্টির নামকরণের মধ্য দিয়েও যে ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখা যায়— এমন সৃজনশীল চিন্তাধারা হয়তো বাংলার বুকেই সম্ভব।

রূপা বলছেন, ‘‘স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে আমরা জড়িয়ে রয়েছি। সেই কারণে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নামেও রয়েছে সন্দেশ। নেহরু, সুভাষ, দেশবন্ধু আমাদের জনপ্রিয় কিছু সন্দেশ। সন্দেশের বাইরে গিয়ে রসের মিষ্টিও বানাচ্ছি। লেডিকেনি আমাদের বিশেষ আইটেম। পাশাপাশি ঐতিহ্যশালী ছানার পায়েস থাকছে। যা কাঁচাগোল্লা থেকে তৈরি। খুড়ি করে সার্ভ করা হয়।”

স্বাধীনতার পরে ১৯৬৬ সালে বউবাজার থেকে বেরিয়ে কসবা, মনোহরপুকুর রোড, ভবানীপুর ও লেক মার্কেটে চারটি আলাদা দোকান করেন ভবানীচরণ নাগ। ভবানীচরণ নাগের মৃত্যুর পর তাঁর বড় ছেলে কানাইলাল নাগ ব্যবসার হাল ধরেন। এখন পরবর্তী প্রজন্মের হাতে ব্যবসার ভার। কসবা, এন্টালি, পাটুলি, কালিকাপুর, বাঁশদ্রোণী, কসবা রথতলা ও পিকনিক গার্ডেনে এখনও পর্যন্ত তার পরিধি বিস্তৃত।

রূপা নাগ আরও বলছেন, ‘‘বেকড রসগোল্লা, বেকড চমচম, মিহিদানা তো রয়েইছে, সেই সঙ্গে আমরা এনেছি বেকড গোলাপজাম। বাদশাভোগ, মালাইভোগ আমাদের খুব ভাল কিছু আইটেম। বাঙালি এখন শরীর সচেতন। আগে মিষ্টি তৈরিতে যে পরিমাণ চিনি ব্যবহার করা হত, এখন তা অনেকটাই কমানো হয়েছে। যাতে শরীর সচেতন প্রজন্মও মিষ্টিবিমুখ না হয়।” যোগ করছেন, ‘‘আমরা সাধারণ মানুষের কাছে থাকার চেষ্টা করি। ক্রেতাদের আবদার মেনে পুরনো আমলের সন্দেশও বিয়েবাড়ি বা অন্য কোনও অনুষ্ঠানের জন্য বানিয়ে দিই। দাম সাধারণের নাগালের মধ্যে রাখার চেষ্টা করি। এখনও দশ টাকায় রসগোল্লা পাওয়া যায় আমাদের কাছে। দশ টাকা পিস সন্দেশ বিক্রি করি। ঠাকুরঘরে পৌঁছনোর জন্য প্যাঁড়া বিক্রি করি ৫-৬ টাকা পিস হিসাবে। লকডাউন ও কোভিড পরিস্থিতিতেও মিষ্টির দাম বাড়াইনি। দাম যাতে বাঙালির মিষ্টিপ্রীতিতে বাধা না হয়ে দাঁড়ায়, সে ব্যাপারেও সচেতন ভীম নাগ’স ব্রাদার শ্রীনাথ নাগ।

বাংলার ঐতিহ্যবাহী বারোটি খ্যাতনামা মিষ্টির ভাণ্ডারগুলির মধ্যে একটি ভীম নাগ’স ব্রাদার শ্রীনাথ নাগ, যা রাজ্য সরকারের উদ্যোগে হিডকোয় ‘মিষ্টি হাব’- এ জায়গা করে নিয়েছে। কর্ণধারের কথায়, ‘‘আমাদের লক্ষ্য বাংলার ঐতিহ্যশালী এই দুর্লভ সন্দেশকে বিশ্ববাংলার দরবারে পৌঁছে দেওয়া। আমরা মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজ্য সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ আমাদের এই প্রয়াসকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। হিডকো মিষ্টি হাবে বিপনন ও প্রদর্শনের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। আগামী দিনে এই মিষ্টান্ন শিল্প বাংলার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে এই আমাদের অঙ্গীকার।”

মিষ্টির মধ্য দিয়েই বাংলার সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং ইতিহাসকেও বাহক হিসাবে বহন করে চলেছে এই প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। তাই যেকোনও মিষ্টির সম্পর্ককে আরও মিষ্টি করে তুলতে মিষ্টিমুখে লেগে থাকুক এমনই মিষ্টির স্বাদ। ফলে দুর্গাপুজো থেকে দীপাবলি হোক বা বারো মাসে তেরো পার্বণ-এ মিষ্টি ছাড়া কোনও উৎসব সম্পূর্ণ হয় না। তাই স্বাস্থ্য সচেতনতার কথা মাথায় রেখে মিষ্টি খান এবং মিষ্টি দিয়ে সম্পর্ক আরও মিষ্টি করে তুলুন।

Latest article