ভারতের চেতন-প্রদীপ এখনও অনির্বাণ

চেষ্টা তো কম হল না। তবু ভারতের বহুধর্মী রাষ্ট্রচরিত্র এখনও চুরমার করতে পারেনি ওরা। দেশপ্রেম আর সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার ফারাক ঘুচিয়ে একধর্মীয় রাষ্ট্রের ভিত-নির্মাণ ধাক্কা খেয়েছে বাংলার নির্বাচনে ও কৃষক আন্দোলনের জয়ে। ভারতীয় সভ্যতার প্রাণশক্তি লুকিয়ে আছে তার সমাজজীবনের অভ্যন্তরে, সেই রাবীন্দ্রিক বীক্ষার শক্তি পুনঃপ্রমাণিত। লিখছেন অধ্যাপক উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়

Must read

ভারত কি অন্দর থেকে হিন্দু-রাষ্ট্র হয়ে গেছে? পণ্ডিতমহলে এমন একটি আলোচনা শুরু হয়েছে যে, এখন আর ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আরএসএস কিংবা করসেবকদের প্রয়োজন নেই, মোদি জমানায় একা তিনিই রাষ্ট্রশক্তিকে কাজে লাগিয়ে হিন্দু-রাষ্ট্র বানিয়ে ফেলেছেন। তার কয়েকটি নমুনা হ’ল অযোধ্যার রামমন্দির নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী মোদির সাগ্রহ উপস্থিতি ও ভাষণ, কাশী বিশ্বনাথ করিডর উদ্বোধনের দিন তাঁর উপস্থিতি এবং ভাষণ, সংখ্যালঘু মনে ক্রমাগত ভীতি সঞ্চার, একমাত্রিক আচরণ ইত্যাদি। ঘটনাপরম্পরার মধ্যে কোথাও ভুল নেই। যেভাবে প্রধানমন্ত্রী মোদি এই ধরনের কাজগুলিতে পারদর্শিতা দেখাচ্ছেন তাতে আমাদের সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতার বাতাবরণটি একটু হলেও ধাক্কা খেয়েছে কি না তা নিয়ে চর্চা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই চর্চা চললেও চট করে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়ার অর্থ হল ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরাও হিন্দুত্ববাদীদের মতোই অন্ধের হস্তিদর্শন করছেন। এর দুটি অত্যন্ত স্পষ্ট কারণ রয়েছে। প্রথমত, সম্প্রদায় সচেতনতা (community consciousness) আর সরাসরি সাম্প্রদায়িকতা এক বস্তু নয়। যেমন দেশপ্রেম আর সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার মধ্যে ফারাক রয়েছে। দেশপ্রেম নিজের জন্মভূমির প্রতি অনুরাগের কথা বলে। অন্য দেশের প্রতি আগ্রাসী মনোভাব তার অভীষ্ট হতে পারে না। ভারত এখনও অবধি তেমনই একটি রাষ্ট্র এবং ভারতীয়রা সেই দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়ে চলেছেন। অন্তরে অনেক বিকৃতি আছে। সীমাবদ্ধতা আছে। রাষ্ট্র পরিচালকদের সমালোচনা করলে জেলে যেতে হচ্ছে, রাষ্ট্রশক্তির অপব্যবহার চলছে, দেশপ্রেমের একটি অলীক একমাত্রিক কাঠামো নির্মাণের চেষ্টা চলছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ-কথা অনস্বীকার্য যে ভারত এখনও একটি আগ্রাসী রাষ্ট্র হয়ে ওঠেনি। পাকিস্তান নিয়ে নানা বিষোদ্গার করা হলেও তা একটি বিশেষ রাজনৈতিক প্রবণতা হিসেবেই থেকে গেছে। সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ভোটে কাজে লাগলেও, কাকপক্ষী ছাড়া আর কেউ টের পায়নি।
ঠিক তেমনি সম্প্রদায়-সচেতনতা আর সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এক নয়। হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভিত্তি এদেশে তৈরি হয়েছে, এ-কথা সত্যি। কিন্তু প্রতিরোধও আসছে। যে সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যায় রামের জন্মস্থান নির্ধারণ করে দিয়েছিল, সেই সুপ্রিম কোর্টই তিনটি কৃষি আইনে স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। ২০২১ শুরুই হয়েছে এই স্থগিতাদেশ দিয়ে। আবার এই বছরেই মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন যে, সরকারের সমালোচনা করা বাক্‌স্বাধীনতার অঙ্গ। তা কোনও অবস্থাতেই দেশ-বিরোধিতা নয়। সুতরাং মোদি–শাহদের ইচ্ছা যা-ই থাকুক না কেন, ভারতীয় বিচার ব্যবস্থা এখনও তাতে লক্ষ্মণরেখা টেনে চলেছে।
আমরা যদি সবটা বিচার করতে বসি তবে নানা জটিলতাকে সামনে রেখেই তা করতে হবে। দুটো মন্দির নির্মাণ আর প্রধানমন্ত্রীর গঙ্গায় ডুব দেওয়া দেখে কিছুই বোঝা যাবে না। হ্যাঁ, তাই দিয়ে মিম হতে পারে, ফেসবুকে নিরন্তর হাবিজাবি চর্চা হতে পারে, কিন্তু তার মাধ্যমে প্রকৃত অবস্থা বোঝা সম্ভব নয়।

আরও পড়ুন: পঁচিশ বছর ভাবতে হবে না বিধাননগরকে

১৯৯২-তে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময়ে স্লোগান উঠেছিল, ‘ইয়ে তো পহেলা ঝাঁকি হ্যায়/মথুরা, কাশী বাকি হ্যায়’। কেউ হয়তো ভাবছেন যে বাকি আর নেই। এ-বছর অর্ধেক হয়ে গেল। তাঁদের আশঙ্কার কারণটি বোধগম্য। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যদি কাশী বিশ্বনাথ করিডর উদ্বোধনের দিন উপস্থিত থাকেন তবে আশঙ্কা হবে তো বটেই। কিন্তু আশার দীপটিকে নিভিয়ে ফেলতে নেই। The places of worship act, 1991-তে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে যে ১৯৪৭ সালের পর সব ধর্মের উপাসনাস্থল অটুট থাকবে। তার কোনও ক্ষতিসাধন করা যাবে না। পূর্ণ আইনি রক্ষাকবচ রয়েছে। তাই আশা করা যায় যে মথুরা-কাশী-সহ সর্বত্রই সব ধর্ম সম্প্রদায়ের উপাসনাস্থল অটুট থাকবে। শীর্ষ আদালতও এই বিষয়টি অযোধ্যা মামলার রায়ে উল্লেখ করেছেন।
দ্বিতীয়ত, ভারতীয় সমাজের নিজস্বতাকে আমরা কখনওই অস্বীকার করতে পারি না। এই সমাজজীবনে রয়েছে এক প্রবল আত্তীকরণের শক্তি। সবাইকে আপন করে নেওয়ার এক সহজিয়া মনোভাব। কোনও উগ্র একদেশদর্শী রাজনৈতিক বয়ান তার এই স্বাভাবিকতাকে বিনষ্ট করতে পারবে না। রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন যে ভারতীয় সভ্যতার প্রাণশক্তি লুকিয়ে আছে তার সমাজজীবনের অভ্যন্তরে। রাষ্ট্রীয় জীবনে নয়। তাই সম্প্রদায়-সচেতন ভারতবাসী বারবার উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিরোধ করেছেন। এই বছরেই একটি নতুন ঐক্য তৈরি হল। কৃষক আন্দোলন নির্মাণ করল জীবন ও জীবিকার ঐক্য। এই বছরেই বাংলায় প্রবল প্রতাপশালী হিন্দুত্ববাদী শক্তির রাজনৈতিক পরাজয় ঘটল। এ-রাজ্যে যাবতীয় প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে প্রতিষ্ঠিত হল মা-মাটি-মানুষের সরকার।
তার মানে কি মানুষের ধর্মাচরণ পাল্টে গেল? উপাসনাস্থলে কি আর কেউ ভিড় করছেন না? সেকুলার সরকার এসেছে মানে সবাই বুঝি ধর্মবিমুখ হয়ে পড়লেন?
সেসব কিছুই তো হল না। শুধু ভয়টা কেটে গেল। এখন বাংলার পল্লিতে কেউ শান্ত ভাবে ‘রামনাম’ করলেও অন্য বিশ্বাসের মানুষ ভয় পাবেন না। এটাই সামগ্রিক ভারতীয় সত্তা। কলকাতার দুর্গাপুজো ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেল। কেউ তাকে সাম্প্রদায়িক বা হিন্দু-রাষ্ট্রের পত্তন হয়ে গেল, বলবেন কি? কখনওই বলবেন না— কারণ তাতে বিদ্বেষ মিশে নেই। আছে উৎসবের আনন্দ।

Latest article