স্বেচ্ছায় অঙ্গদান

সঠিক পদ্ধতিতে অঙ্গ প্রতিস্থাপনে বেঁচে যেতে পারে বহু প্রাণ। তাই অঙ্গদানের প্রয়োজন অপরিসীম। কিন্তু আজকের দিনেও এইক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে অধিকাংশই। আগামী ১৩ অগাস্ট ওয়ার্ল্ড অরগান ডোনেশন ডে বা বিশ্ব অঙ্গদান দিবস। এই উপলক্ষে অঙ্গদান ও প্রতিস্থাপনের গুরুত্ব সম্পর্কে জানালেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

অঙ্গ প্রতিস্থাপন হল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে দাতার শরীর থেকে একটি সুস্থ অঙ্গ অপসারণ করা এবং এটি এমন একজন ব্যক্তির শরীরে প্রতিস্থাপন করা যার অঙ্গ বিকল হয়ে গেছে অথবা কোনও রকম আঘাতের কারণে অঙ্গ অকার্যকর হয়েছে।
অঙ্গ প্রতিস্থাপন খুব গুরুত্বপূর্ণ। সফল প্রতিস্থাপন নির্ভর করে রক্তের ধরন, অঙ্গের আকার, রোগী কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে, তাঁর অবস্থা কতটা গুরুতর এবং দাতা এবং গ্রহীতার মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্ব কতটা— এই বিষয়গুলির উপর। অঙ্গ প্রতিস্থাপনে বেঁচে যেতে পারে বহু প্রাণ। তাই অঙ্গদানের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্ব অঙ্গদান দিবসের (World Organ Donation Day) উদ্দেশ্য হল অঙ্গদান করতে মানুষকে উৎসাহিত করা এবং সেই সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া।

অঙ্গদানের শুরুর কথা
সফল ভাবে প্রথম জীবিত দাতার অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ঘটনাটি ঘটেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। শল্যচিকিৎসায় তাৎপর্যপূর্ণ সেই তারিখটা ছিল ১৯৫৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর। ২৩ বছর বয়সি রিচার্ড হ্যারিকের দেহে তাঁরই যমজ ভাই রোনাল্ডের কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। গোটা ঘটনাটার নেতৃত্বে ছিলেন সার্জেন জোসেফ ই মুরে এবং নেফ্রোলজিস্ট জন মেরিল। চিকিৎসাবিদ্যায় এই যুগান্তকারী ভূমিকার জন্য তাঁরা ১৯৯০ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।
বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ অঙ্গদাতা ছিল একটি শিশু যে অ্যানাসেফালি রোগে আক্রান্ত। ২০১৪ সালে জন্মানো এই শিশু মাত্র ১০০ মিনিট বেঁচে ছিল এবং তার কিডনি দান করা হয়েছিল একজন রেনাল ফেলিওর-এর প্রাপ্তবয়স্ক রোগীকে। সর্বাধিক বয়স্ক ১০৭ বছরের একজন স্কটিশ মহিলা মৃত্যুর পর তাঁর কর্নিয়া দান করেছিলেন এবং ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় বসবাসকারী ৯৫ বছরের একজন বৃদ্ধ তাঁর মৃত্যুর পর লিভার দান করে গিয়েছিলেন।

অঙ্গদানের প্রক্রিয়া
প্রথম একজন দাতা স্বেচ্ছায় তাঁর অঙ্গ দান করার অঙ্গীকার করেন এবং তাঁর মৃত্যুর পরেই সেই অঙ্গটি সংগ্রহ করে তা সংরক্ষণ করা হয়। পরবর্তীতে চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী নির্দিষ্ট রোগীর শরীরে তা প্রতিস্থাপিত করা হবে।
ব্রেন ডেথ হয়ে গেছে এমন ব্যক্তির থেকে অঙ্গ নেওয়া হয়। পথ দুর্ঘটনায় কোনও ব্যক্তি মারা গেলে তাঁর হার্ট, লিভার, কর্নিয়া ভাল থাকে অর্থাৎ অন্যকে দান করার মতো অবস্থায় থাকে। একজন মানুষের অঙ্গদান থেকে সাত-আটজনের প্রাণবাঁচানো যায়। স্ট্রোকের কারণে মৃত্যু হয়েছে যে রোগীর, তাঁর দুটো কিডনি, একটা লিভার, হার্ট, দুটো কর্নিয়া এবং ত্বক— এতগুলো অঙ্গ পাওয়া যেতে পারে। লিভার, কিডনি, হার্ট, কর্নিয়া ইত্যাদি প্রতিস্থাপন করলে একাধিক মানুষ নতুন করে জীবন ফিরে পান।
জীবিত মানুষ নিজের দুটো কিডনির একটি এবং লিভারের কিছুটা অংশ দান করতে পারেন। আর মৃত মানুষের শরীর থেকে সব ক’টা অঙ্গই প্রতিস্থাপনের জন্য সংগ্রহ করা যায়। তবে সবাই অঙ্গদান করতে পারেন না। কারণ শুধুমাত্র হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হলেই হবে না, ব্রেন ডেথ হলে তবেই তাঁর শরীর থেকে অঙ্গ সংগ্রহ করা সম্ভব। সুস্থ-সবল থাকলে যে কোনও ব্যক্তি বেশি বয়সেও অঙ্গদান (World Organ Donation Day) করতে পারেন।

কোন কোন অঙ্গদান করা যায়
পুরো মানবদেহই দান করা যায়।
এ-ছাড়া হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনি, লিভার, প্যাংক্রিয়াস, অস্থি, অস্থিমজ্জা দান করা যায়। আর চোখ বা কর্নিয়া, হাড়, ত্বক, হার্ট ভালভ, ব্লাড ভেসেল, নার্ভ ও টেন্ডনও দান করা যায়। তবে ক্যান্সার, হেপাটাইটিস, এইডস বা জীবাণু সংক্রমণজনিত কোনও ব্যাধিতে মারা গেলে সেই ব্যক্তির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করা যাবে না।

আরও পড়ুন- বিশ্ব আদিবাসী দিবসে শুভেচ্ছা মুখ্যমন্ত্রী ও অভিষেকের

বয়ঃসীমা
অঙ্গদানের (World Organ Donation Day) কোনও নির্দিষ্ট বয়স নেই। সদ্যোজাত থেকে শুরু করে বয়স্ক ব্যক্তিরা অঙ্গদান করতে পারেন। তবে তার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের থেকে জেনে নেওয়া উচিত আপনার কোন কোন অঙ্গ আপনি দান করতে পারবেন।

কীভাবে করবেন
প্রত্যেক রাজ্যে অঙ্গদানের নিজস্ব রেজিস্ট্রেশন সাইট রয়েছে। সেই সাইটের মাধ্যমে আপনি অঙ্গদান করতে পারবেন। ইন্টারনেট ঘাঁটলে সেই সম্পর্কে সমস্ত তথ্য পাওয়া যায়। যাঁরাই অঙ্গদান করতে চান, তাঁদের নিজেদের নাম সেখানে রেজিস্ট্রি করতে হয়। প্রথমে আপনাকে নিজের মোবাইল নম্বর অথবা ইমেল আইডি নিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।
তারপর আপনি কোন কোন অঙ্গ দান করতে চান সেটি সিলেক্ট করে নিজের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর, ইমেল আইডি, রক্তের গ্রুপ দিয়ে ফর্ম ফিল-আপ করতে হবে।

মনে রাখা দরকার
দাতার মৃত্যুর পর অঙ্গদানের সমস্ত ফর্মালিটিজ করার দায়িত্ব তাঁর পরিবারের। তাই পরিবারের সদস্যদের সম্মতি খুব জরুরি। দাতা তাঁর পরিবারকে অঙ্গদানের রেজিস্ট্রেশনের কথা অবশ্যই জানিয়ে রাখবেন। ভারতে পরিসংখ্যান কম হলেও অঙ্গদান এবং প্রতিস্থাপনের বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ অনেকটা এগিয়ে। যেখানে মৃত্যুর পরে অঙ্গদানকে উৎসাহিত করা হয়। দেশের মধ্যে বাংলা সেইসব রাজ্যগুলির মধ্যে একটি, যারা সফল অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য নিয়মিত ভাবে গ্রিন করিডর করে দ্রুত অঙ্গের পরিবহণের ব্যবস্থা করে থাকে।

কোন দেশে অঙ্গ প্রতিস্থাপন বেশি
অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি অঙ্গ প্রতিস্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্র। দুই ও তিন নম্বরে রয়েছে স্পেন ও ফ্রান্স। তালিকার সবচেয়ে নিচের তিনটি দেশ হচ্ছে জাপান, গ্রিস ও লাটভিয়া।
বিভিন্ন দেশে অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইন
যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণত ১৮ থেকে ৭০ বছর বয়স্ক যেকোনও সুস্থ ব্যক্তি অঙ্গ দান করে থাকেন। পছন্দমতো রোগীর জন্য সরাসরি দান করেন বা হাসপাতালের প্রয়োজনমাফিক অনাত্মীয়ের জন্য। এ-ছাড়া আরও কিছু নিয়ম রয়েছে।
কানাডায় যেকোনও সুস্থ সুহৃদ ব্যক্তি অপরিচিত রোগীর জন্য কিডনি দান করতে পারেন। তিনি ইচ্ছা করলে একটি কিডনি, যকৃতের অংশবিশেষ এবং ফুসফুসের একটি অংশ দান করতে পারেন।
ভারতে জীবিত আত্মীয়স্বজন সরাসরি হাসপাতলে গিয়ে অঙ্গ দান করতে পারেন। অনাত্মীয় ব্যক্তি অঙ্গ দান করতে চাইলে রাজ্যের অনুমোদন কমিটিকে জানাতে হয়।

Latest article