এবারেও জেঠিমা ছিলেন শহিদ-তর্পণে

শারীরিক কষ্ট উপেক্ষা করে, সাংসারিক দায়িত্ব সামলে কাতারে কাতারে যাঁরা ফি-বছর একুশে জুলাইয়ের সভায় আসেন, তাঁরা ডিম্ভাতের আকর্ষণে নয়, ভিন্ন আবেগের টানে আসেন। দ্বিতীয় পর্বে সেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর আবেগ ভাগ করে নিচ্ছেন উত্তর বারাকপুর পুরসভার কাউন্সিলর শ্রীপর্ণা রায়

Must read

(গতকালের পর)
ওর সঙ্গে পথ চলতে চলতেই জানলাম ওর বাড়ি নদীয়ার গাংনারায়ণপুরে, ফার্স্ট রানাঘাট লোকাল ধরে শিয়ালদহে এসেছে পাড়ার এক দাদার সঙ্গে, ২০০৩ সাল থেকে প্রতিবছর এই একুশে জুলাই এভাবেই সব প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে মমতা দিদির বক্তব্য শুনতে চলে আসে ও। কত সহজ সরলতায় ছেলেটি নিজের আস্থা, বিশ্বাসের কথা আমাকে বলছিল! একুশের শহিদতীর্থ দর্শন ওর কাছে যেন বছরভর জীবনের অনেক যন্ত্রণার উপশম আর পরবর্তী একবছরের বেঁচে থাকার জীবনযুদ্ধের রসদ! ওর অজান্তেই মনে মনে ওকে একটা বিগ স্যালুট দিলাম। মমতা দিদি, তৃণমূল কংগ্রেস আর একুশে জুলাই ওর রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিরা-উপশিরায় প্রবহমান, কার সাধ্যি এই স্বর্গসুখ থেকে ওকে বঞ্চিত করে! ফিরে যাওয়ার সময় ও আমাকে একটা মমতা দিদির লকেট উপহার দিয়ে বলে গেল— ‘দিদি বেঁচে থাকলে সামনের বছর আবার তোমার সাথে এই দিনটায় পথ চলব, আমিই তোমাকে ঠিক খুঁজে নেব’। বাক্‌রুদ্ধ হয়ে ওর ফিরে যাওয়ার পথের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম, যতক্ষণ না পর্যন্ত ওর পিঠের মধ্যে সেঁটে থাকা জোড়াফুল পতাকাটা আমার চোখে অদৃশ্য হয়েছে ঠিক ততক্ষণ।

আরও পড়ুন-কাশ্মীরের ব্রহ্মা শৃঙ্গ জয় চুঁচুড়ার দেবাশিসের

ততক্ষণে মঞ্চ থেকে ঘোষণা শুরু হয়ে গিয়েছে, এবারের মতো একুশে জুলাইয়ের মিটিং শেষ, সবাই তাড়াতাড়ি মঞ্চের সামনের রাস্তা ফাঁকা করে দিন, কিন্তু ডোরিনা ক্রসিং-এর সামনে থেকে কাতারে কাতারে মানুষ ছুটে চলছে শহিদ মঞ্চের দিকে, আমাদের সামনেই প্রায় দৌড়ে চলতে গিয়ে এক বয়স্ক মহিলা প্রায় পড়েই যাচ্ছিলেন। আমার এক সহকর্মী তাঁর হাতটা ধরে ফেলায় তিনি নিজেকে সামলে নেন। কিছুটা উপযাচক হয়েই তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, জেঠিমা সভা তো শেষ, কেন এত তাড়াহুড়ো করে ওদিকে ছুটে যাচ্ছিলে এই ভিড় ঠেলে? উত্তরে তিনি যা বললেন তা শুনে আমি নিজের মনেই হেসে ফেললাম, কত বড় বোকা আমি যে নিজেকে বড় মমতাভক্ত বা বড় তৃণমূলী ভাবি! এঁদের মতো মানুষের কাছে আমাদের একুশে জুলাইয়ের আবেগ ধোপে টিকবে না কোনওদিন! এই জেঠিমার বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুকে, প্রতিবছর তিনি গ্রামের লোকেদের সঙ্গে ভোরবেলায় সভাস্থলে পৌঁছান, ফাঁকায় ফাঁকায় তেরো শহিদের বেদিতে প্রণাম জানান, একদম মঞ্চের সামনে বসে দিদির বক্তব্য শোনেন এবং সভা শেষে দিদির স্লোগানে গলা মিলিয়ে তারপর সভাস্থল ছাড়েন।

আরও পড়ুন-নবরূপ পাবে কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম

এবার স্বামী রোগশয্যায়, মেয়েটারও বিয়ে হয়ে গিয়েছে, তাই বাড়িতে অসুস্থ স্বামীকে একা ফেলে রেখে রাতের বাসে গ্রামের লোকেদের সঙ্গে আসতে এবার সাহস পাননি তিনি। দিনের আলো ফুটতেই স্বামীর জন্য রান্না করে প্রতিবেশী এক বউমাকে সব বুঝিয়ে কোনওমতে যখন রাসমণি রোডে পৌঁছেছেন তখন সভাস্থল জনস্রোতে অবরুদ্ধ। তিনি দিদির ভাষণ শুনতে পেরেছেন দূর থেকে, কিন্তু প্রতিবারের মতন শহিদ বেদিতে নমস্কার করতে না পারলে তাঁর এত কষ্ট করে এবার একুশে জুলাই কলকাতায় আসাটাই তো অসম্পূর্ণ থেকে যাবে! তাই সভা শেষ হতেই তার কাঁধে ঝোলাব্যাগ নিয়ে মরণপণ মঞ্চের দিকে ছুটে যাওয়া। তারপর ঘটনাচক্রে সঙ্গী আমরা। তেরো শহিদের বেদির উদ্দেশ্যে কিছুটা দূর থেকে নমস্কার করে জেঠিমাকে সঙ্গে নিয়ে ধর্মতলা বাস স্ট্যান্ডে ফেরার সময় জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু খেয়েছ তুমি? এত বেলা হয়ে গিয়েছে!

আরও পড়ুন-আগাম ঘােষণা ছাড়াই বহু ট্রেন বাতিল, দুর্ভোগ যাত্রীদের

জেঠিমা একগাল হেসে কাঁধের ঝোলা দেখিয়ে বলল, ‘এই ঝোলায় ছ’টা ডিমের ঝোল আর ভাত নিয়ে এসেছি, নিজে খাব আর গ্রামের চেনা পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা হলে তাদেরকেও খাওয়াব, আমার যা সাধ্যি, ঘরে পৌঁছাতে তো অনেক রাত হবে, ডিম্ভাত আর জল, তমলুক পর্যন্ত পৌঁছে যাব মা। তোমরা খাবে আমার সঙ্গে?’ জেঠিমার আন্তরিকতার কাছে হার মেনে চারটে ডিম আমরাও ভাগাভাগি করে খেয়ে নিলাম, আমাদের খাওয়াতে পেরে জেঠিমার মুখের অনাবিল তৃপ্তির হাসি দেখে মনে হল শহিদ তীর্থে শহিদ তর্পণ আর ডিম্ভাত এক লহমায় কতটা প্রাসঙ্গিক হয়ে গেল সেটা যদি ওই অবুঝদের বোঝাতে পারতাম বা এটা বোঝার মতন সুবুদ্ধি যদি ওদের থাকত তাহলে ওদের অবস্থান অন্তত আজকে শূন্যে অবস্থান করত না।

আরও পড়ুন-প্রবল বৃষ্টিতে তেলেঙ্গানায় মৃত ১১

জেঠিমাকে বাসে তুলে দিয়ে আবার হাঁটতে হাঁটতে শিয়ালদহের অভিমুখে পথ চলতে শুরু হল আমাদের। মাইকের আওয়াজ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে কানে, কলকাতা পুরসভার সাফাইবন্ধুরা নেমে পড়েছেন রাজপথ পরিষ্কার করতে, ট্রাফিক পুলিশরা আবার সক্রিয় উঠছে সবকিছু স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টায়, সবকিছু একেবারে প্রতিবারের মতো। সারাদিনের সব অভিজ্ঞতাগুলোকে নিজের মনেই এক এক করে সাজিয়ে নিচ্ছিলাম পথ চলতে চলতে, আর বেশ ভাললাগার একটা উপলব্ধি হচ্ছিল যে এতগুলি বছর পেরিয়েও কিচ্ছু বদলায়নি আমাদের তৃণমূল কংগ্রেসের এই পবিত্র শহিদ তর্পণ দিনটার চরিত্র। একুশে জুলাইয়ের আবেগ, একুশে জুলাইয়ের স্বতঃস্ফূর্ততা, একুশে জুলাইয়ের গুরুত্ব, একুশে জুলাইয়ের মর্মার্থ— সবকিছু আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক প্রতিটি সাচ্চা তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীর মননে ও হৃদয়ে। এসব ভাবতে ভাবতেই কানে এল শিয়ালদহ স্টেশনে তৃণমূলের অস্থায়ী ক্যাম্প থেকে মাইকের আওয়াজ— ‘সবাই সাবধানে একসাথে বাড়ি ফিরবেন’ … হ্যাঁ, বদলায়নি এই আত্মিক-মন-ভাল-করা ঘোষণাটুকুও। (শেষ)

Latest article