সে একটা দিন ছিল বটে, যখন মুক্তির পথ ছিল বড়ই কঠিন। অবশ্য কঠিনের মধ্যে ছিল পথচলার আনন্দ। তবে সে আনন্দ উপভোগ করতে পারত পাহাড় পথে হেঁটে বেড়ানো কিছু সীমিত মানুষ, যাদের পা এবং হাড় দুটোই বেশ শক্তপোক্ত। এখন মুক্তির পথ বেজায় আয়েশি — শেষে পাঁচশো মতো সিঁড়ি বেয়ে সোজা পথে মুক্তি।
আরও পড়ুন-রেশন দোকানে ওজনে কারচুপি রুখতে বসছে নতুন যন্ত্র
হচ্ছে নেপালের মুক্তিনাথের কথা। কয়েক বছর আগেও অন্নপূর্ণা অভয়ারণ্যের মধ্যে তিনহাজার আটশো মিটার উচ্চতায় অবস্থিত মুক্তিনাথ বেশ কঠিন একটা ট্রেক পথ। ট্রেকাররা কাঠমান্ডু থেকে পোখরা যেত, পোখরা থেকে জম্সম্ বাসে। তারও আগে বেণী পর্যন্ত বাস যেত। তারপর কালিগণ্ডকী গভীর গিরিখাত ধরে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ছিল পথচলার আনন্দ। পনেরো দিনের জন্য পরিচিত জীবন থেকে ছুটি নিয়ে ট্রেকার ছুঁতে চেয়েছে অন্নপূর্ণা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারির মধ্যে জঙ্গলের বন্যতা মাউন্ট ধৌলাগিরির ধ্যানমগ্নতা এবং কালিগণ্ডকীর উচ্ছলতা।
কঠিন সে ট্রেক আজকের প্রযুক্তির দৌলতে হয়েছে সহজ তীর্থযাত্রা। পুরো পথটাই বিদেশে, মানে নেপালে। শান্তি একটাই, ভারতীয়দের কোনও পাসপোর্ট লাগে না। প্রথমেই পৌঁছতে হবে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু। রক্সৌল, গোরখপুর অথবা যোগবাণী কিংবা কাঁকরভিটা হল সড়কপথে নেপালের দরজা। এর পর আট থেকে বারো ঘণ্টার পথ রাজধানী কাঠমান্ডু। মুক্তিনাথের পথ পোখরা থেকে। তাই বর্ডার থেকে পোখরাও যাওয়া যায় কাঠমান্ডুর বদলে। পোখরা থেকে মুক্তিনাথ যাওয়ার তিনটি বিকল্প। সরকারি বাস বেণী হয়ে জম্সম্ যাচ্ছে। তারপর শেয়ার গাড়িতে একঘণ্টায় মুক্তিনাথের দোরগোড়া। দ্বিতীয় বিকল্প উড়ানে কুড়ি মিনিট পোখরা থেকে জম্সম্। দল বড় হলে তৃতীয় ও সেরা বিকল্প গাড়ি ভাড়া করে সাত ঘণ্টা সময়ে মুক্তিনাথ পৌঁছনো।
আরও পড়ুন-আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা, রেকর্ড ব্যবসা বাংলার
পোখরা থেকে সরকারি অফিসে অন্নপূর্ণা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি ঢোকার পারমিট লাগবে। চারটে ছবি আর বারোশো নেপালি রূপি দিয়ে ফর্ম ফিলআপ করে, পারমিটের কাগজ পেতে দুটি ঘণ্টা পেরিয়ে যাবেই। হয়তো হোটেল থেকে গাড়ি নিলে ওঁরাই ব্যবস্থা করে দেন।
গাড়ি ছাড়তে ছাড়তে বারোটা বাজল। নিয়মিত ফেসিয়াল করা স্কিনের মতো রাস্তা বেণী পর্যন্ত। খুব তাড়াতাড়ি বেণী পৌঁছে যাওয়া যায়। এরপর আসে পাহাড়ি পাকদণ্ডী পথ, রাস্তার অপেক্ষায় থাকে কারও বাগান ঘেরা বাড়ি। তবে মেঘেরা এখানে গাভীর মতো চড়ে না। ঝুলে থাকে পাহাড়ের খাঁজে ঝুল-বারান্দায়। রূপসা ঝরনা তার ভয়ংকর সুন্দর রূপের ডালি নিয়ে রাস্তার পাশে অপেক্ষা করে থাকে পথিকের। মে মাসের দীর্ঘ বিকেলে মারফায় আপেল বাগানে কুঁড়ি আপেলরা হাতছানি দিয়ে ডাকে একটু থমকে যাওয়ার। আপেলের জুস, আপেল ওয়াইন, আপেল বিয়ার– আপেলের বহুমুখী পরিকল্পনা। জম্সমের ছোট্ট হেলিপ্যাড, জনা কুড়ি লোক নিয়ে খেলনা প্লেনের ওঠানামা। কাকবেণীতে পিতৃতর্পণ কালিগণ্ডকীর তীরে। কালিগণ্ডকীর জলে বজ্রকীটের ফসিল থুড়ি শালগ্রাম শিলার পুণ্যা বিচরণ। তীব্র হাওয়ার স্রোতে সন্ধ্যা নামে গণ্ডকীর কালো জলে। পোখরায় শ্বেতগণ্ডকীর দুধ সাদা জল, কালিগণ্ডকীর বিপরীত। প্রকৃতির কী অসামান্য সৃষ্টি। প্রকৃতির রস-রূপ উপভোগ করতেই তো পথে বেরোনোর নেশা। সন্ধে সাড়ে সাতটায় রানিপাওয়া গ্রামে। এখানে হোটেলগুলোর এক মজার বৈশিষ্ট্য– এত বিজন জায়গায় গিজার, কমোডের সুবিধা-সহ দারুন কাঠের ঘর, ভাড়া মাত্র সাতশো টাকা কিন্তু একটা আটার রুটি ২৬০ টাকা! মেনু কার্ডটির ছবি তুলে রেখেছি যত্ন করে।
আরও পড়ুন-ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহে রাশ টানার উদ্যোগ
সকালে সোনালি আলোয় চরাচর ভেসে যাওয়ার আগেই মুক্তি আকাঙ্ক্ষী মানুষের সিঁড়ি বেয়ে ওঠা শুরু। পাঁচশো সিঁড়ি উপরেই মুক্তির ঠিকানা। ডানদিকে ধৌলাগিরি পর্বতের ঝকঝকে উপস্থিতি। চারিদিক সবুজের ঘেরাটোপ, উপরে আকাশ পুরো উজালা ঢালা নীল। গেট পেরিয়ে মন্দিরের আঙিনা শুরু।
একশো আট ধারায় জল নেমে আসছে, ভক্তরা সেই ধারায় স্নান করতে করতে এগিয়ে চলেছেন। কেউ প্রাঙ্গণে দুটি কুণ্ডে স্নান সেরে পাপমুক্ত হয়ে মুক্তিনাথের দর্শনে চললেন। নেপালের কাঠ ও ধাতুর মিশেলে প্যাগোডা ধাঁচের দৃষ্টিনন্দন মন্দির। বৌদ্ধ আদল স্পষ্ট হিন্দু নারায়ণ বিগ্রহের। দু’পাশে শ্রীদেবী ও ভূদেবী। বৃন্দার অভিশাপ-মুক্ত নারায়ণ দর্শনে মুক্তি কতটা মেলে মানুষের জানি না তবে এই মায়াময় প্রকৃতির উঠোনে বসে খানিকটা সময় কাটালে জগতের চাওয়া-পাওয়া থেকে মন মুক্ত হয়, এটা অনুভব করতে পারি। ডাইনে একটু দূরে জ্বালামাঈ মন্দিরে অনন্ত জ্যোতি নীল বিন্দু হয়ে জ্বলছে। বামে একটি বৌদ্ধ মনাস্ট্রি। কে যে আগ্রাসী আর কে যে গ্রাস, সে বোঝার কাজ ভক্তিমার্গের নয়। সময় বয়ে যায় মাউন্ট অন্নপূর্ণা আর মাউন্ট ধৌলাগিরি ঘেরা এই অনুপম শোভাময় তীর্থক্ষেত্রে। নীল আকাশের বুকে উদ্ধত সাদা তুষারশৃঙ্গের ঝকঝকে উপস্থিতি।
নিচে নামার পালা। নামতে নামতেই দেখা যায় মারফা লেক। দুম্বা লেকের ধারে সুন্দর একটা ক্যাফেটেরিয়া। লেকের পাড়ে চমৎকার বসার জায়গা, তাই একটু বসে ছবি তুলতেই হয়। এতে দেরি হলে একটা দিন তপ্তপানিতে থেকে পরদিন লাঞ্চের আগেই পোখরা পৌঁছলে জীবনের হিসেবে কোনও গরমিল হয় না– কিছুই আসে-যায় না। শুধু থেকে যায় মুগ্ধতা ও অপরূপ স্মৃতি মাখা একটা বেড়াতে যাওয়ার গল্প– মুক্তিপথের সন্ধানে।
আরও পড়ুন-জামিন পেয়েও ফের গ্রেফতার কল্যাণময়
কীভাবে যাবেন?
প্রথমেই পৌঁছতে হবে কাঠমান্ডু। রক্সৌল, গোরখপুর অথবা যোগবাণী কিংবা কাঁকরভিটা হল সড়কপথে নেপালের দরজা। এর পর আট থেকে বারো ঘণ্টার পথ রাজধানী কাঠমান্ডু। মুক্তিনাথের পথ পোখরা থেকে। তাই বর্ডার থেকে পোখরাও যাওয়া যায় কাঠমান্ডুর বদলে। সরকারি বাস বেণী হয়ে জম্সম্ যাচ্ছে। তারপর শেয়ার গাড়ি। একঘণ্টায় মুক্তিনাথের দোরগোড়া। উড়ানে কুড়ি মিনিটে পোখরা থেকে জম্সম্ যাওয়া যায়।
আরও পড়ুন-বিধানসভায় বিধায়কদের বেতন বৃদ্ধি বিল পাশ নিয়ে মুখ খুললেন মুখ্যমন্ত্রী
কোথায় থাকবেন?
অনেকেই মুক্তিনাথ মন্দিরের আশপাশে থাকতে চান। তবে সেখানে তেমন কোনও থাকার জায়গা নেই। বেশকিছু হোটেল আছে রানিপৌয়াতে। সেখানে থাকা যায়। বিভিন্ন রকমের ভাড়া। আগে থেকে বুকিং করে গেলেই ভাল।