এই বছর জাতীয় লুপ্তপ্রায় প্রাণিদিবস ছিল ২০ মে। প্রতি বছরের মে মাসের তৃতীয় শুক্রবার এই দিনটি পালন করা হয়। দেশ জুড়ে বিলুপ্তির দিকে ক্রমশ এগিয়ে চলা বিপন্ন প্রাণীদের চিহ্নিত করা, তাদের রক্ষা করা কতটা জরুরি, জলবায়ুর ব্যাপক হারে পরিবর্তন কীভাবে সেই প্রাণীদের ধ্বংস ডেকে এনে আমাদের বাস্তুতন্ত্রকে তছনছ করে দিতে পারে তা মনে রাখার জন্যই এই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে ২০০৬ সাল থেকে।
আরও পড়ুন-আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়
ওরা আমাদের ক্ষমা করবে না
মানুষ এই দুনিয়ায় জীবজগতের কনিষ্ঠতর প্রতিনিধিদের একজন হলেও তার প্রভাব এই গ্রহের পরিবেশ এবং পরিস্থিতির উপর সর্বাধিক, এ কথা নিঃসংশয়ে বলা যায়। নিজের মতো করে জগতটাকে গড়ে-পিটে নিতে গিয়ে মানুষ যা যা করেছে, প্রায়শই তার খেসারত দিতে হয়েছে অন্যদের। শুধু যে খাদ্যের প্রয়োজন মেটাতেই মানুষ তাদের নির্বিচারে হত্যা করেছে, তা নয়, খেয়ালখুশির বলিও হয়েছে অনেকে। আদিম যুগের গুহামানবকে শিকার করার জন্য যে অস্ত্রশস্ত্র হাতে তুলে নিতে হয়েছিল, আধুনিক মানুষ আরও অত্যাধুনিক অস্ত্রে সেই বন্যপ্রাণ হত্যা করেছে কখনও নিজের ড্রয়িং রুমের শোভা বাড়াতে, কখনও-বা বাজারে চড়া দামে সেসব বিকিয়ে মুনাফা লুটতে।
আরও পড়ুন-কামদারঞ্জন থেকে উপেন্দ্রকিশোর
গহন অরণ্যের নির্জনতা খানখান করে দেয় বুলেটের কানফাটানো আওয়াজ। বারুদের কটু গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। টন-টন হাড়গোড়, মাংস, স্তূপীকৃত হয়ে ভর্তি হয় সারি সারি ট্রাক। হাতির দাঁত, চিতাবাঘের চামড়া, হরিণের বাহারি শিং— কিছুই বাদ যায় না সেখানে। পশুশিকার বেআইনি হলে কী হবে, মজাটা তাতেই তো বেশি! তাই অর্থলিপ্সু আর নির্বোধ মানুষের সংখ্যার সঙ্গে অসহায় বন্যপ্রাণীদের মৃত্যুহার পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। ১৯৯০ সাল থেকে হাতির দাঁতের আন্তর্জাতিক বিপণন নিষিদ্ধ হয়ে গেলেও প্রতি বছর এখনও ৩০ হাজারের বেশি হাতি মারা পড়ে শুধু আফ্রিকা মহাদেশেই। চোরাচালান বন্ধ হয়নি যে! শুধু কি প্রাণিহত্যা? পশু-পাখি-মাছেদের বাসস্থান ধ্বংস করে দেওয়া, অরণ্যচ্ছেদন, জলাশয় লোপাট করে দেওয়া, যে বাতাসে আমরা শ্বাস নিই আর যে জল আমরা পান করি তাদের উভয়কেই ভয়ানক ভাবে কলুষিত করে দেওয়া— আমরা বাদ রেখেছি কোনটা? এই পৃথিবী নামের গ্রহটাকেই আমরা যে তিলে তিলে একটা মৃত গ্রহে পরিণত করার দিকে ঠেলে দিচ্ছি, সেই বোধ কি আমাদের জন্মাচ্ছে?
আরও পড়ুন-দ্বিতীয় দফায় বিশ্বভারতীর শোকজ ৭ অধ্যাপককে
আমাদের দেশের কথা ধরা যাক। বিংশ শতকের গোড়ায় যেখানে সারা দেশের জঙ্গলে অন্তত চল্লিশ হাজার রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার সদর্পে ঘুরে বেড়াত, ১৯৬৯-এ এসে সেটা দাঁড়ায় মাত্র আড়াই হাজারে! ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে ঔপনিবেশিক প্রভু, ধনী রাজা-মহারাজাদের শিকার খেলার নামে ভয়ঙ্কর সুন্দর প্রাণীটির এই শোচনীয় অবস্থা হয়। চিন, থাইল্যান্ড-সহ এশিয়ার বেশ কিছু দেশে ওষুধ তৈরির দোহাই দিয়ে বহু প্রাণীর সর্বনাশ করা হয়। বাঁদরের ঘিলু, বাঘের হাড়, গন্ডারের খড়্গ থেকে কৃষ্ণসার হরিণের শিং, ভাল্লুকের পিত্তথলি পর্যন্ত এমন সব জিনিসের প্রবল চাহিদা সে-সব দেশে যা কল্পনা করেও গা শিউরে ওঠে। কিন্তু বাস্তব এটাই। এবং সেই চাহিদা মেটাতেই ভারত-সহ অন্যান্য দেশে এইসব জীবজন্তুদের মেরে তাদের দেহাবশেষ চোরাপথে পাচার হয়ে যাচ্ছে আজও। আমাদের পরিচিত মঙ্গলকাব্যে ফুল্লরা-কালকেতুর গল্পের সেই স্বর্ণগোধিকার কথা মনে আছে নিশ্চয়ই? পোশাকি ভাষায় যাদের নাম মনিটর লিজার্ড। তারাও অবলুপ্তির পথে। তাদের চামড়া বিকোয় চড়া দামে, তাদের নখযুক্ত পা কেটে রঙ করে বাহারি চাবির রিং অবধি তৈরি হয়! ইন্দোনেশিয়া, মরক্কোর মতো দেশে খোলাবাজারে বিক্রি হয় কচ্ছপের খোলা দিয়ে বানানো গিটার, সেই যন্ত্রে সুর তোলার সময় বাদকের কানে কি মৃত প্রাণীগুলির নীরব হাহাকার পৌঁছয়? তিমির মাংস খাওয়ার জন্য জাপানের মতো দেশের কিছু মানুষ যা খুশি টাকা খরচ করতেও রাজি থাকেন, এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে? তিমির বিভিন্ন প্রজাতি যেভাবে বিলুপ্তির দিকে গেছে বা যাচ্ছে তার পরিসংখ্যান অবিশ্বাস্য। মানুষের দৌলতে অ্যান্টার্কটিকার কাছে দক্ষিণ সাগরে বিশ্বের বৃহত্তম স্তন্যপায়ী প্রাণী নীলতিমির সংখ্যা আড়াই লক্ষ থেকে কমে এক হাজারে আসতে সময় লেগেছিল মাত্র কয়েকশো বছর।
আরও পড়ুন-রামমোহন রায় পুরস্কার ছৌগুরু হেমচন্দ্রকে
কারা বিলুপ্ত আর কারা লুপ্তপ্রায়? যখন কোনও প্রজাতির আর একটিও জীবিত সদস্য এই ধরিত্রীর বুকে ঘুরেফিরে বেড়ায় না, তখন সেই প্রাণীটিকে বিলুপ্ত ধরা হয়। যেমন ডাইনোসর, ম্যামথ, বিরাট দাঁতওয়ালা প্রাগৈতিহাসিক বাঘ বা ডোডোপাখি! আর লুপ্তপ্রায়? যাদের নিজস্ব বাসভূমির সর্বত্র বা অংশবিশেষে তাদের সম্পূর্ণ অবলুপ্তির আশঙ্কা দেখা যায়, তাদেরই সাধারণত লুপ্তপ্রায় বলে ঘোষণা করা হয়।
মানুষ আসার আগে কি প্রাণীরা বিলোপ পায়নি? পেয়েছে। এবং একাধিকবার। তবে এবার যেটা ঘটছে সেটা একটু আলাদা। কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়, এবারে দায়ী মানুষ ও তার কীর্তিকলাপ। জুরাসিক যুগের মতো উল্কাপাতের প্রয়োজন নেই, একুশ শতকে বিশ্ব উষ্ণায়ন আর নগরসভ্যতার অগ্রগতির জোয়ারে বহু প্রাণিকুল ভেসে যাচ্ছে মৃত্যুমোহনার দিকে। অথচ মানুষ কিন্তু সারা দুনিয়ায় সেই একমাত্র প্রাণী যারা অন্যান্য প্রজাতির রক্ষক হতে পারত, তাদের দেখভাল করতে পারত! প্রাকৃতিক দূষণ, স্বাভাবিক আবাসস্থলের ক্রমবিনাশ, রোগজীবাণু ছড়িয়ে দেওয়া প্রভৃতি মনুষ্য-সৃষ্ট বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হয়ে বেশ কিছু প্রজাতি আর টিকে থাকতে পারেনি, পারছে না। তাদের প্রজননহার কমে যাচ্ছে, ক্রমাগত কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে তারা।
আরও পড়ুন-নব জাগরণের প্রথম আলো নিভিয়ে উল্টো পানে চলো
ওরা কি আমাদের কখনও ক্ষমা করতে পারবে? লুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণ সংরক্ষণে বিভিন্ন পদক্ষেপ
১৮৯৫ সালে প্যারিসে প্রথমবার পাখি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক বৈঠক হয়। আর প্রকৃতি সংরক্ষণের জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক বৈঠকটি হয় ১৯১৩ সালে। ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় তিমিদের বিভিন্ন প্রজাতিকে রক্ষা করার জন্য ইন্টারন্যাশনাল হোয়েলিং কমিশন। আর এই সবকিছুকে মাথায় রেখে ১৯৫৬ সালে গঠিত হয় ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজার্ভেশন অফ নেচার অ্যান্ড ন্যাচারাল রিসোর্সেস (IUCN)। ১৯৬১-তে জন্ম নিয়েছিল ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার (WWF) সংস্থাটি। তাঁদের ম্যাসকট চিনদেশের দৈত্যাকার সাদাকালো পান্ডা। ভারতে এঁদের শাখাটির নাম WWF–INDIA। লুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের জন্য ১৯৭৩ সালে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়, প্রবর্তন করা হয় এনডেঞ্জার্ড স্পিসিজ অ্যাক্ট (ESA)। এই আইনের মুখ্য উদ্দেশ্য লুপ্তপ্রায় অথবা অবলুপ্তির আশঙ্কাগ্রস্ত প্রাণিদের চিহ্নিত করা। আন্তর্জাতিক বাজারে লুপ্তপ্রায় তথা দুষ্প্রাপ্য প্রাণীদের অবৈধ কেনা-বেচা, পাচার রোধে ১৯৭৫ সালে দ্য কনভেনশন অন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইন এনডেঞ্জার্ড স্পিসিজ অফ ওয়াইল্ড ফ্লোরা অ্যান্ড ফনা (CITES) [আন্তর্জাতিক বাজারে লুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদের কেনা-বেচা বিষয়ক সম্মেলন]-এ একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
আরও পড়ুন-৩১ মে বন্ধ রেল?
ভারতের লুপ্তপ্রায় প্রাণীরা
২০১২ সালের রিও আর্থ সামিটে (ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত) বিশ্বের সংকটাপন্ন জীবদের তালিকায় ভারতের ১৩২টি বিপন্ন প্রজাতির উল্লেখ করা হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল—
লাল পান্ডা: হিমালয়ের দার্জিলিং, সিকিম, অসম এবং অরুণাচল প্রদেশের উত্তরভাগের পাহাড়ি অঞ্চলের অরণ্যে গাছের ডালে দেখা যায় এই ছোট্ট লাজুক প্রাণিটিকে। এদের খাদ্য বাঁশ গাছ আবার বনের উঁচু গাছেই এদের বাসা; অথচ নির্বিচারে বৃক্ষচ্ছেদনে রেড পান্ডার সংখ্যা আজ তলানিতে। IUCN-এর মতে, এই প্রজাতির বিগত তিন প্রজন্মের হিসেবে এদের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক কমে গেছে আর এই অবনমন আরও সুদূরপ্রসারী হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
আরও পড়ুন-মাঙ্কিপক্স আতঙ্ক, এবার ভারতেও জারি সতর্কবার্তা
তুষারচিতা: হিমালয়ের বরফঢাকা প্রত্যন্ত অংশ হল তুষারচিতাদের বিচরণভূমি। কিন্তু বিগত কিছু সময় ধরে সেই জায়গাতেও বারবার মানুষের পা পড়া, প্রাকৃতিক দূষণ বাড়িয়ে দেওয়ার মতো দুর্ভাগ্যজনক কারণে এদের সংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে কমে যাচ্ছে। তা ছাড়া এদের মূল শিকার যেসব পাহাড়ি ভেড়া, খরগোশ জাতীয় প্রাণীরা, তারাও যে কমে যাচ্ছে সংখ্যায়; তাই খাদ্যাভাবও একটা বড় কারণ। ২০১৭ সালের পর থেকে অবশ্য সংরক্ষণের ফলে এদের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। লাদাখ, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ডের মতো হিমালয়ের কিছু অংশে সব মিলিয়ে এখন ৫০০টির মতো তুষারচিতা রয়েছে।
নীলগিরি থর: কেরালার কিছু অংশে এই বাঁকানো শিংওয়ালা লোমশ পাহাড়ি ছাগলটির দেখা মেলে। ঊনবিংশ শতক থেকে ব্যাপক হারে চোরাশিকার আর স্বাভাবিক বাসস্থানের অপ্রতুলতার পরিণামে আজ তারা লুপ্তপ্রায় তালিকাভুক্ত। সারা দুনিয়ায় মাত্র ২৫০০-তে এসে ঠেকেছে তাদের সংখ্যা। সংরক্ষণের তাগিদে এখন তামিলনাড়ুর রাজ্য-পশু এই নীলগিরি থর।
আরও পড়ুন-চারধাম যাত্রা : ১০ হাজারেরও বেশি পর্যটক আটকে
রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার: একাধিক ব্যাঘ্রপ্রকল্প, কড়া আইনকানুন সত্ত্বেও নির্বিচারে চোরাশিকার বা বিদেশে বাঘের অঙ্গ পাচারের ঘটনা এখনও ঘটছে। তা ছাড়া সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যে সমুদ্রের জলস্তর ক্রমাগত বাড়তে থাকায় নিজেদের থাকার জায়গা হারিয়েও বহু বাঘ লোকালয়ে চলে আসছে বা খাদ্যাভাবে মারা পড়ছে। তাই ভারতের জাতীয় পশু ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ ডোরাকাটা বাঘের সংখ্যা বর্তমানে কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও এখনও তা মাত্র ২০০০-এর আশেপাশে।
এশিয়ার সিংহ: সোনালি কেশরের এই প্রবল পরাক্রমী প্রাণীটির অবশিষ্ট সামান্য কয়েকজনের দেখা মেলে শুধুমাত্র ভারতের গুজরাতের গির অরণ্যে। IUCN-এর লাল তালিকাভুক্ত এই প্রাণীটির সংখ্যা ২০১০ সাল থেকে ক্রমহ্রাসমান। শেষ শুমারি অনুসারে ভারতে এখন মাত্র ৬৫০টির মতো সিংহ রয়েছে।
আরও পড়ুন-সংখ্যালঘু ভেবে হিন্দু প্রৌঢ়কে পিটিয়ে মারল বিজেপি নেতা
ভারতীয় একশৃঙ্গ গন্ডার: IUCN এই প্রাণীটির অসিত্বসংকট নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মালয়ের পাদদেশে বিচরণ করা এই বড়সড় চেহারার জীবটি নিজেদের ঐ শৃঙ্গটির জন্যই নিজেরা বিপদে পড়েছে। বিভিন্ন ওষুধ তৈরির নাম করে যথেচ্ছ নিধনের শিকার হতে হয়েছে এদের। বিংশ শতকের শেষ লগ্নে এদের সংখ্যা নামতে নামতে ২০০-তে ঠেকেছিল। এখন অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়ে বর্তমানে হাজার দুয়েক গন্ডার টিকে রয়েছে এ দেশের বিভিন্ন জাতীয় উদ্যান বা অভয়ারণ্যে।
গঙ্গার ডলফিন বা শুশুক: বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এই জলজ স্তন্যপায়ীটির বাস, গাঙ্গেয় ভারতবর্ষে! আর সেই নদীটির কী হাল আমরা সবাই কম-বেশি জানি। গঙ্গাকে বাঁচানোর জন্য গালভরা নাম দিয়ে একাধিক প্রকল্প এটাই প্রমাণ করে, ‘পবিত্র’ নদীটির স্বাস্থ্য বড়ই রুগ্ণ। বেড়ে চলা জলদূষণ আর জেলেদের মাছ ধরার জালে আটকে মারা যাওয়ার ঘটনা তো আছেই, সেইসঙ্গে গঙ্গার গতিপথে একাধিক বাঁধ তৈরি হওয়ার ফলেও তারা বিপন্ন হয়েছে। সাম্প্রতিক সমীক্ষায় গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের বিস্তীর্ণ অববাহিকায় মাত্র ২০০০-এর মতো শুশুকের সন্ধান মিলেছে।
কৃষ্ণসার মৃগ: অপূর্ব সুন্দর এই প্রাণীটিও মানুষের লালসার শিকার। রাজস্থানের বিশনোই প্রজাতির মানুষেরা শুধু তাঁদের সর্বস্ব দিয়ে এই প্রাণীটিকে রক্ষা করার চেষ্টা করে আসছেন বহুযুগ ধরে। তবুও এই ‘কালো হরিণ চোখে’র অবলা জীব আজ বিপন্ন।
আরও পড়ুন-নির্লজ্জ! মহিলাকে দিয়ে পা ধোয়ালেন বিজেপি বিধায়ক
ভারতীয় শকুন: ২০০২ সাল থেকে IUCN-এর লাল তালিকায় (গভীরভাবে সংকটাপন্ন) থাকা এই বিরাট ডানাওলা পাখিটির সংখ্যা লক্ষ লক্ষ থেকে কমে মাত্র হাজার দশেকে এসে ঠেকেছে ভারতে। শকুন মৃতজীবী প্রাণী। আর গবাদিপশুর শরীরে প্রযুক্ত ডাইক্লোফেনেকের মতো কিছু ওষুধ এবং যথেচ্ছ কীটনাশকের ব্যবহারের ফলে তাদের শবদেহ খাওয়ার পর বিষক্রিয়ায় কিডনি বিকল হয়ে বহু শকুন মারা যাচ্ছে বলে বিজ্ঞানীদের অভিমত। পরিবেশ সাফসুতরো-রাখা এই পাখিটি কমে গেলে আমাদের যে সমূহবিপদ, তা আমাদের বুঝতে হবে।
আরও পড়ুন-বিদেশ থেকেই
ভারতীয় হাতি: হস্তিমাথা গণেশের পুজো হোক অথবা প্রাচীন ভারতীয় সংস্কার মেনে হাতিকে ফুল-চন্দনে সাজিয়ে ভক্তিভরে প্রণাম করা— এর কোনওটাই কিন্তু এতবড় প্রাণীটিকে নিশ্চিন্তভাবে এদেশে চলাফেরা করতে দেয়নি। ‘মরা হাতি লাখ টাকা’ প্রবাদ যে প্রাণীর সঙ্গে জড়িত, তার মতো হতভাগ্য আর কে-ই বা আছে? স্রেফ দাঁত দুটির জন্য তাকে মরতে হয় আজও। সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা হাতিরা এখন মাত্র কিছু অংশে দল বেঁধে ঘোরে। নগরায়ণের ঠেলায় একের পর এক বন উজাড় হয়ে যাওয়ায় তারা আজকাল মানুষের শস্যখেতে হামলা চালাতে বাধ্য হয়।
আরও পড়ুন-শিল্পকর্ম মুখ্যমন্ত্রীর পছন্দ হয়েছে, খুশি ভাস্কর
বাঘরোল: আমাদের রাজ্য প্রাণীটির (State Animal) নাম বাঘরোল বা ফিশিং ক্যাট। সাধারণ বাড়ির বিড়ালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বড়মাপের এই নিশাচর মেছো-বিড়ালের দেহ সুঠাম হলেও লেজ একটু ছোট হয়। নামেই মালুম মাছ এদের বড্ড প্রিয় খাবার। IUCN-এর লাল তালিকায় থাকা, দ্রুত অবলুপ্তির দিকে এগিয়ে চলা জলাভূমিতে বিচরণকারী এই প্রাণীটিকে সংরক্ষণের আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন পরিবেশবিদরা। জেনে রাখা ভাল, একটি বাঘরোলের হত্যাকে আমাদের জাতীয় পশু বাঘ হত্যার সমতুল্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
আমাদের করণীয় কী? আমরা কি আমাদের সময়, অর্থ, মেধা বা শ্রমের যথাযথ প্রয়োগ ঘটিয়ে অবলুপ্তপ্রায় প্রজাতিগুলিকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে চাইব নাকি ‘যোগ্যতমই টিকে থাকবে, বাকিরা গোল্লায় যাবে’— এই আপ্তবাক্য মেনে নিয়ে চুপচাপ তাদের ধ্বংস দেখতে ভালবাসব? বিকল্প বেছে নেওয়ার দায়টা কিন্তু আমাদেরই।