৫ অগাস্ট, ১৮৯৩, শুক্রবার
“মিস কেটি স্যানবোর্ন সম্প্রতি পশ্চিম থেকে ফিরেছেন। গত সপ্তাহে তিনি ভারতীয় রাজা বিবেকানন্দকে আদর-আপ্যায়ন করেছেন। ঘোড়া পালন করে যে সংস্থাটি সেখানকার কর্মী এফ ডব্লু ফিলিপস-এর দেওয়া জোড়া ঘোড়ায় টানা গাড়িতে চেপে তাঁরা দু’জন গত শুক্রবার (১৮ অগাস্ট) শহরের মধ্যে দিয়ে হুন্নেওয়েলের পথে যান।”
এদিন খবরটা বেরিয়েছিল ফ্রামিংহ্যাম ট্রিবিউন পত্রিকায়। সাপ্তাহিক পত্রিকা। প্রতি শুক্রবার বের হয়। ফ্রামিংহ্যাম ম্যাসাচুসেটস-এর মিডলসেক্স কাউন্টির একটা শহর। বোস্টন থেকে প্রায় বিশ মাইল পশ্চিমে এর অবস্থান। মিস কেটি স্যানবোর্ন ৫৪ বছর বয়সি প্রাণশক্তিতে ভরপুর একজন মার্কিন মহিলা আর বিবেকানন্দের বয়স তখন ৩০ বছর।
আরও পড়ুন-মেরিন ড্রাইভ জলমগ্ন
মিস স্যানবোর্ন গোটা মহল্লাকে তাঁর এই নয়া সংগ্রহটিকে দেখাতে চান। উজ্জ্বল গেরুয়া রঙের আজব পোশাক পরা এই ভারতীয় লোকটাকে দেখলে চারপাশের লোকজন হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। দুর্লভ সম্পদটা যদি জাহির করে দেখানোই না গেল, তবে আর মজা কীসের! সেজন্যই ঘোড়ার গাড়িতে চেপে এমন ভ্রমণের আয়োজন।
একমাস আগে ছবিটা ছিল অন্যরকম। ২৫ জুলাই, মঙ্গলবার, সন্ধে সাতটা নাগাদ ভ্যাংকুবারের বন্দরে ভিড়েছিল ‘এমপ্রেস’। সে রাতটা সেখানেই কাটাতে হয়েছিল বিবেকানন্দকে। বুধবার সকালে ট্রেনে চড়েছিলেন। তিন-তিনবার ট্রেন বদলে শিকাগোতে আসা। ক্যালেন্ডারে দিনটা ছিল ৩০ জুলাই, রবিবার। ঘড়িতে সময় তখন প্রায় রাত ১১টা। স্বামীজির সঙ্গে তখন ‘এমপ্রেস’-এর সহযাত্রী সি. লালুভাই।
আরও পড়ুন-শান্ত বাংলাকে অশান্ত করতে চাইছে বাম-বিজেপি
শিকাগোতে সেসময় বেজায় হইচই। তিন মাস ধরে চলছে ধর্মমহাসম্মেলনের প্রস্তুতি। কিন্তু এসব সত্ত্বেও ভেতর ভেতর শহরটা কেমন যেন মনমরা। অর্থনৈতিক মন্দার আতঙ্ক। ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে উঠেছে। অনেক ব্যাঙ্ক বন্ধ। ব্যাপক বেকারত্ব। সব মিলিয়ে সাধারণ ভাবে আমেরিকানদের যেটা প্রধান চরিত্রবৈশিষ্ট্য, দিলদরিয়া মেজাজ, তাতে বেশ ভাটা পড়েছে।
এরই মধ্যে বিবেকানন্দ এসে পড়েছেন। উঠেছেন একটা প্রথম শ্রেণির হোটেলে। ‘উঠেছেন’ না বলে বলা ভাল, উঠতে বাধ্য হয়েছেন। সাধারণ কমদামি হোটেলগুলোতে থাকতে পারেননি। হোটেলমালিকরা বাদামি চামড়ার লোককে থাকার অনুমতিই দেয়নি। ‘দূর দূর’ করে তাড়িয়ে দিয়েছিল। কোথাও কোথাও তাঁকে ঢুকতে পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বুকে বর্ণবিদ্বেষের শিকার। তাই-ই, নিতান্ত বাধ্য হয়ে দামি হোটেলে মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করা। আর সেই প্রথম শ্রেণির হোটেলে থাকাটাই বিবেকানন্দের বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়াল।
আরও পড়ুন-ক্রীড়া দফতরের সাহায্য চায় পরিবার
যেজন্য শিকাগোতে আসা সে কাজটা হওয়ার আশু সম্ভাবনা নেই। সঙ্গে কোনও শংসাপত্র নেই। শংসাপত্র ছাড়া ধর্মমহাসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ মিলবে না। তা ছাড়া নাম নথিভুক্ত করার শেষ তারিখও পেরিয়ে গিয়েছে। সুতরাং, শিকাগো ধর্মমহাসম্মেলনে নিজের দেশের কথা, নিজের ধর্মের কথা, নিজের মতো করে বলার সুযোগ আর নেই। ধর্মমহাসম্মেলনের বাইরেও সে সুযোগ তক্ষুনি-তক্ষুনি হবে, এমন সম্ভাবনাও নেই। বক্তৃতার মরশুম শুরু হবে হেমন্তে। সেজন্য আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে। ওদিকে হোটেলভাড়া পড়ে যাচ্ছিল রোজ প্রায় ৩ ডলার। থাকা-খাওয়া মিলিয়ে প্রতিদিনের খরচ ৫ ডলার। রোজ এত খরচ হয়ে গেলে হেমন্ত অবধি টাকায় কুলোবে না। তা ছাড়া শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য যেরকম জামাকাপড় দরকার, সেসবও নেই। শিকাগোয় শীতের কামড় মারাত্মক।
আরও পড়ুন-ফুটবলার সমস্যায় নতুন জট, আইএফএ-কে ফের চিঠি মোহনবাগানের
লালুভাই জাহাজ থেকে নামা ইস্তক সঙ্গে আছেন। মাদ্রাজ থেকে বরদা রাও একটা পরিচয়পত্র লিখে দিয়েছিলেন। সেই সুবাদে এক দম্পতির সঙ্গে পরিচয়। ধর্মমহাসম্মেলন উপলক্ষে মেলা আর প্রদর্শনীর আয়োজন হয়েছে। ওয়ার্ল্ড কলম্বিয়ান এক্সপোজিশন। ভদ্রলোক সেখানকার ডিরেক্টর। তাঁর স্ত্রীও বেশ মিশুকে। লালুভাই থেকে শুরু করে এই মার্কিন দম্পতি, সবাই বিবেকানন্দের সঙ্গে পরিচয়ের পর একটাই কথা বলেছেন। স্বামী বিবেকানন্দের উচিত ধর্মমহাসম্মেলনে যোগ দেওয়া। অবশ্যই। কিন্তু কেউই অতিথি হিসেবে তাঁকে রাখার জন্য কোনো বাড়ির দরজা খুলে দেননি। সম্মেলন শুরু হতে প্রায় পাঁচ সপ্তাহ বাকি। এই সময়টা যাতে বিবেকানন্দ শিকাগোতে থাকতে পারেন, সেজন্য তাঁর দিকে কোনও আর্থিক সাহায্যের হাতও ওঁরা কেউ বাড়িয়ে দেননি। এর মধ্যে আবার রাস্তায় বের হলেই লোকজন ঝামেলা পাকাত। ঠেলা মেরে, গা টিপে দেখত এই কিম্ভূত-কিমাকার বেশ পরা সন্দেহজনক বস্তুটা আদৌ মানুষ কি না। কেউ কেউ আবার পাগড়ি ধরে টানাটানি করে বেজায় আমোদ পেত।
আরও পড়ুন-গ্রাফিক নভেল প্রকাশ ধোনির
দামি হোটেলের ভেতর এসব উপদ্রব নেই। কিন্তু সেখানে পাঁচ সপ্তাহ থাকার আর্থিক সামর্থ্য নেই। এরই মধ্যে শুনলেন বোস্টনে থাকা-খাওয়ার অনেকটা কম। সেজন্যই শিকাগো ত্যাগ। বোস্টনের ট্রেনে চড়ে বসেছিলেন। লালুভাইও বোস্টনে তাঁকে ছাড়তে এলেন।
আর সেই ট্রেনেই আলাপ মিস কেটি স্যানবোর্নের সঙ্গে।
বোস্টনের অভিজ্ঞতাও সুখকর নয়। অজ্ঞাত জায়গা। অপরিচিত ব্যক্তি। শহরের ব্যস্ততম রাস্তাতেও ছেলেবুড়োর দল ধাওয়া করে। আজব চিজ দেখার মজা নেয়। জিনিসপত্র ছুঁড়ে আমোদ পায়। পকেটে কয়েকটা মাত্র ডলার পড়ে আছে। এরকম একটা পরিস্থিতিতে মিস স্যানবোর্ন বললেন, আপনি ব্রিজি মেডোজ-এ আমার ফার্ম হাউসে থাকুন।
আরও পড়ুন-বুনো হাতিকে ঘোল খাওয়াতে বাঘা ওল
এই মিস স্যানবোর্নের সঙ্গে আলাপটাই হয়ে দাঁড়াল ‘রহস্যময় ঈশ্বরের লীলা’। এই মহিলাই অধ্যাপক জন হেনরি রাইটের সঙ্গে বিবেকানন্দের পরিচয় করিয়ে দিলেন। রাইট দুর্দান্ত পণ্ডিত। ‘ডিকশনারি অব আমেরিকান বায়োগ্রাফি’-তে তাঁর পরিচয় দেওয়া হয়েছে ‘এনসাইক্লোপেডিক’ বলে। তিনি তাঁর অ্যান্নিসকোয়ামের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালেন বিবেকানন্দকে। বোস্টন থেকে প্রায় ৪০ মাইল দূরে সমুদ্রের উপকূলে ছবির মতো সুন্দর গ্রাম অ্যান্নিসকোয়াম। সেখানে বিবেকানন্দের সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর ২৯ অগাস্ট জন রাইটের স্ত্রী মেরি টাপ্পন রাইট তাঁর মাকে লিখলেন, “সময়ের বিচারে তাঁর (বিবেকানন্দের) বয়স হবে বছর তিরিশ, সভ্যতার বিচারে কয়েক শতাব্দী। …এপর্যন্ত যত মানুষ দেখেছি তার মধ্যে ইনিই সবচেয়ে কৌতূহল-উদ্দীপক।…আশ্চর্যরকম বুদ্ধিমান। যুক্তিকে নিজস্ব চিন্তাধারায় সাজিয়ে সিদ্ধান্তে আসার ব্যাপারে ভীষণ স্পষ্ট। তুমি কক্ষনো তাঁকে হোঁচট খাওয়াতে বা ছাড়িয়ে যেতে পারবে না।”
আরও পড়ুন-সেরেনাকে বলেছিলাম খেলেই যাও : মারিয়া
আর জন রাইট চিঠি লিখলেন ধর্মসম্মেলনের কর্তৃপক্ষকে। নির্দ্বিধায় জানালেন, “আমাদের সকল পণ্ডিত অধ্যাপকদের পাণ্ডিত্যের সমষ্টির চেয়ে ইনি (বিবেকানন্দ) বেশি পাণ্ডিত্যের অধিকারী।”
ধর্মসম্মেলনে যোগ দেওয়ার ব্যবস্থাটা পাকা হয়ে গেল।
৯ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩, শনিবার
প্রায় মাসখানেক পর ফের শিকাগোতে বিবেকানন্দ। ডিয়ারবোর্ন আর পক স্ট্রিটের মোড়ে ডিয়ারবোর্ন স্ট্রিট স্টেশন। লাল ইট দিয়ে তৈরি। সেখানেই ট্রেন থেকে নামলেন। তখন দুপুর পেরিয়ে বিকেলবেলা। ‘সারাগোটিয়ান’ পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল। হেডিং-এ লেখা ছিল, ‘অর্ধেক মূল্যে বিশ্বমেলায়’। বিজ্ঞাপনের বক্তব্য, ‘ডেলাওয়ার অ্যান্ড হাডসন রেল-রোডে চমৎকার ব্যবস্থা…যাতায়াতে ২৬ ডলার’। এই ব্যবস্থার সুযোগ নিয়েই শিকাগোতে প্রত্যাবর্তন।
আরও পড়ুন-চা-বলয়ে নতুন আন্দোলনের অভিষেক
স্টেশনে নামার পর টের পেলেন, যেখানে যাওয়ার কথা ছিল, সেখানকার ঠিকানাটাই হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে শিকাগোর একটা মালগাড়ির ওয়ার্ডে একটা মালগাড়ির ওয়াগান বা বক্স-কারে রাত্রিযাপন।
পরদিন রবিবার। সকাল হতেই দরজায় দরজায় ঘুরে খাবার আর অর্থ জোগাড়ের চেষ্টা। বাদামি চামড়া। মুখে না-কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়িগোঁফ। দুমড়ে মুচড়ে একাকার গেরুয়া আলখাল্লা। মাথায় অদ্ভুত একটা পাগড়ি। এমন চেহারায় ভিক্ষা চাওয়ার নিটফল, বাড়ির কর্ত্রীরা পত্রপাঠ বিদায় করে দিল। পরিচারক-পরিচারিকারা মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল। কেউ কেউ আবার দু-চার কথা শুনিয়েও দিল।
পেটে খিদে। শরীরে ক্লান্তি। মন জুড়ে অপমানের জ্বালা। তাই নিয়েই দু-আড়াই মাইল হাঁটলেন বিবেকানন্দ। তারপর আর না-পেরে ডারবোর্ন স্ট্রিটের পশ্চিম দিকটায় একটা কার্ব মেটালের ওপর বসে পড়লেন।
আচমকা উলটো দিকের একটা বাড়ির দরজা খুলে গেল। বেরিয়ে এলেন শ্রীমতী জর্জ ডব্লু হেল। সরাসরি জানতে চাইলেন, স্যার, আপনি কি ধর্মসম্মেলনের প্রতিনিধি? স্বামীজি বললেন, হ্যাঁ।
বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে বিবেকানন্দকে প্রাতরাশ খাওয়ালেন শ্রীমতী হেল। রেলস্টেশন থেকে তাঁর মালপত্র আনার জন্য লোক পাঠালেন। তারপর নিজে স্বামীজিকে ধর্মমহাসভার অফিসে নিয়ে গেলেন। সেখানে ড. জন এইচ বারোজ-সহ অন্যান্য কর্মকর্তারা স্বামীজির আসার অপেক্ষায় বসেছিলেন।
আরও পড়ুন-পুজোর জোগান নিয়ে দুশ্চিন্তায় পদ্মচাষিরা
সব অনিশ্চয়তার অবসান।
১১ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩, সোমবার
শিকাগোর আর্ট ইনস্টিটিউট। আজ থেকে এখানে ধর্মমহাসম্মেলনের শুরু। বেলা দশটায় দশবার ঘণ্টা বাজিয়ে উদ্বোধন। ঘণ্টার গায়ে খোদাই করা সেই মহামন্ত্র। ‘তোমাদের কাছে আমার নব নির্দেশ—পরস্পরকে ভালবাস’। ব্রাহ্ম, ইহুদি, ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, তাও, কনফুসিয়াস, শিল্টো, জরথ্রুস্ত্র এবং খ্রিস্টান (যার মধ্যে রয়েছে ক্যাথলিক, গ্রিক চার্চ আর প্রোটেস্ট্যান্ট)—এই প্রধান দশটি ধর্মের জন্য ঘণ্টাটা দশবার বাজানো হল।
চার-পাঁচ হাজার শ্রোতা প্রেক্ষাগৃহে। আর তাঁদের সামনে, মঞ্চের ওপর বক্তারা বসে আছেন। কারও মাথায় পাগড়ি, কারও মুণ্ডিত মস্তক, কারও আবার লম্বা চুল। কারও পোশাক উজ্জ্বল গৈরিক, কারও পোশাকে আঁকা ক্রস, কারও পোশাকে আধখানা চাঁদ, কারও আবার রামধনু রঙের ঢেউ খেলানো পোশাক। সে এক অপূর্ব মনোহর দৃশ্য, জানিয়েছেন ওয়াল্টার হাউটন, তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থে।
আরও পড়ুন-বাড়ল ভর্তির সময়সীমা
ওই বক্তাদেরই একজন স্বামী বিবেকানন্দ। মাথায় গেরুয়া পাগড়ি, পরনে লালচে আংরাখা আর ‘ব্রোঞ্জ’রঙা মুখ। এসবই সকলের চোখ টানছিল।
মধ্যাহ্নভোজনের বিরতির পর বিকেলের অধিবেশন। চারজন বক্তা বললেন। ভাষণ লিখে এনেছিলেন। সেগুলোই পড়লেন আর কী! স্বামীজির ওসব প্রস্তুতি নেই। মনে মনে জপ করছেন। ধ্যানে ডুবে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। পাশেই বসেছিলেন ধর্মযাজক বেনেট মারি। ফরাসি সুপণ্ডিত। বলার যখন সুযোগ এল, তখন সেটা অন্য বক্তাকে ছেড়ে দিতে যাচ্ছিলেন বিবেকানন্দ। দ্বিধাগ্রস্ত সন্ন্যাসীকে বেনেট মারিই বললেন, না, আপনিই এবার বলুন। অনুরোধের সুরে কিছু একটা ছিল। এবার আর সুযোগটা ছাড়লেন না। মনে মনে সরস্বতীকে প্রণাম জানিয়ে উঠে দাঁড়ালেন বিবেকানন্দ।
প্রাচ্য উঠে এসে দাঁড়াল পশ্চিমের সামনে। ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে নয়। প্রতিস্পর্ধার ঔদ্ধত্য নিয়েও নয়। সহিষ্ণুতার আত্মপরিচয় নিয়ে।
বিবেকানন্দ সম্বোধন করলেন, “সিস্টার্স অ্যান্ড ব্রাদার্স অব আমেরিকা।”
আরও পড়ুন-সাইবার সুরক্ষায় রাজ্য
তারপর প্রায় মিনিট দুয়েক জুড়ে হাততালি। শ্রোতাদের মধ্যে উচ্ছ্বাসের বিস্ফোরণ। অজস্র শ্রোতা সামনের বেঞ্চিগুলো টপকে পাগলের মতো ছুটল স্রেফ স্বামীজিকে ছোঁয়ার জন্য। তাঁর কাছে পৌঁছানোর জন্য। সেই দৌড়ে মহিলারাও শামিল।
শ্রোতাদের মধ্যে ছিলেন মিসেস ব্লজেট। প্রেক্ষাগৃহের উন্মাদনা দেখে তিনি তখন মনে মনে বলছেন, “বাছা, তুমি যদি এই আমন্ত্রণ থেকে আত্মরক্ষা করতে পার, তবে বুঝব তুমি স্বয়ং ঈশ্বর”।
মাঝে মাঝে তীব্র হাততালির ছেদ। তার মধ্যেই বিবেকানন্দর বলে চলা। পশ্চিমি দুনিয়ার বুকে তিনি ছুঁড়ে দিতে লাগলেন সনাতন ধর্মের শাশ্বত লক্ষণগুলো। সেদিনের বক্তৃতা শেষ করলেন এই বলে, “আমি সর্বতোভাবে বিশ্বাস করি, আজ এই ধর্মমহাসম্মেলনে উপস্থিত বিভিন্ন প্রতিনিধিদের সম্মান জানাতে যে ঘণ্টাধ্বনি নিনাদিত হল, তা ধর্ম নিয়ে উন্মত্ততার, তরোয়াল বা কলম দিয়ে করা যাবতীয় নির্যাতনের এবং অভিন্ন লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া ভাইদের পথে যাবতীয় বাধার মৃত্যু ঘোষণা করবে।”
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর পূর্ব মেদিনীপুর সফর ঘিরে প্রশাসনিক তৎপরতা তুঙ্গে
ফের হর্ষধ্বনির বজ্রনির্ঘোষ। ফের আকুল শ্রোতাদের বিপুল উচ্ছ্বাস।
২৭ সেপ্টেম্বর,১৮৯৩, বুধবার
শিকাগো ধর্মসম্মেলনের শেষ দিন। ১১ তারিখ থেকে আজ পর্যন্ত অনেকবার বলার সুযোগ পেয়েছেন বিবেকানন্দ। মার্কিন জনতা আরও ভালভাবে চিনে নিতে পেরেছে ভারতীয়দের হৃদয়ের রাজাধিরাজকে। জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন আরও একজন ভারতীয়। তিনি কলকাতার প্রতাপচন্দ্র মজুমদার। নানা পথ পেরিয়ে সেখানে পৌঁছেছিলেন প্রতাপচন্দ্র। ভারতের সনাতন ধর্ম, অধ্যাত্মবাদ, সর্বোপরি ব্রাহ্ম ধর্মের কথা পৌঁছে দেওয়ার জন্য ১৮৭৪ সালেই তিনি চলে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও জার্মানিতে। ব্রিমিংটন হলে তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য তিন হাজার মানুষ হাজির হয়।সেখান থেকে সোজা আমেরিকায় এসেছেন। খ্যাতির কারণে তাঁকে শিকাগো ধর্ম মহাসভার অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য হিসেবে মনোনীত করা হয়।
আরও পড়ুন-পর্যটকদের জন্য দিঘা থেকে সরছে বেআইনি হকার
এদিন সম্মেলন শেষ হলে ধর্মমহাসভার কর্তাব্যক্তিদের কাছেও চলে যান প্রতাপচন্দ্র। স্বামী বিবেকানন্দ একজন ‘ভণ্ড’, ভবঘুরে সম্প্রদায়ের লোক— এই কথাটার প্রচার শুরু করেন তিনি। স্বামীজি ভয়ানক দুঃখ পেলেন। স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে লিখলেন, “প্রভুর ইচ্ছায় মজুমদার মহাশয়ের সঙ্গে এখানে দেখা। প্রথমে বড়ই প্রীতি, পরে যখন শিকাগোসুদ্ধ নরনারী আমার উপর ভেঙে পড়তে লাগল তখন মজুমদার ভায়ার মনে আগুন জ্বলল।… পার্লামেন্ট অব রিলিজিয়নের পাদ্রিদের কাছে আমার যথেষ্ট নিন্দা করে, ‘ও কেউ নয়, ঠগ, জোচ্চোর; ও তোমাদের দেশে এসে বলে — আমি ফকির’ ইত্যাদি বলে তাদের মন আমার উপর যথেষ্ট বিগড়ে দিলে!…” এখানেই শেষ নয়। নিজের ‘ইউনিটি অ্যান্ড দি মিনিস্টার’ পত্রিকায় স্বামীজি সম্পর্কে বিষোদগার করে চলেন তিনি। তাঁর ‘কালাপানি পার হওয়া’, ‘সিগারেট খাওয়া’ ইত্যাদি নানা কথা বললেন। শেষে কলকাতায় ফেরার পর প্রতাপচন্দ্র রটালেন স্বামীজি আমেরিকায় গিয়ে ‘সমস্ত পাপ কাজ করেছেন’।
আরও পড়ুন-ফুটবলার সমস্যায় নতুন জট, আইএফএ-কে ফের চিঠি মোহনবাগানের
পরবর্তী কালে ব্যারোজের ধর্ম সম্মেলন সংক্রান্ত রিপোর্টে ২০ জন ভারতীয়কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হল। এঁদের মধ্যে সব থেকে বেশি জায়গা পেয়েছিলেন অনাগরিক ধর্মপাল(২৩ পাতা), হিন্দু মনিলাল দ্বিবেদী (২০.৫ পাতা), প্রতাপ চন্দ্র মজুমদার (১৯ পাতা), জে জে মোদি (১৭ পাতা), স্বামী বিবেকানন্দ (১৫ পাতা) এবং বি বি নাগরকার (১৫ পাতা)।
৯ নভেম্বর, ১৮৯৩, বৃহস্পতিবার
সাতসকালে রামতনু বসুর গলিতে হাজির মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত। হাতে একটা স্টেটসম্যান কাগজ। রামতনু বসুর ভাইপো নন্দলাল। তাঁর একটি কন্যার বিয়ে হয়েছিল গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বিশ্বনাথ দত্তের সঙ্গে। বিশ্বনাথ গত হয়েছেন। বড়ো ছেলেটি তার ঠাকুরদার মতো ঘর ছেড়ে বিবাগী। আর যে দুটি ছেলে, মহেন্দ্রনাথ আর ভূপেন্দ্রনাথ, তাদের নিয়ে নন্দলাল বসুর কন্যা ভুবনেশ্বরী দেবী এখন বাপের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। মাস্টারমশাই ওঁদের কাছেই এসেছেন কার্তিকের এই সকালে।
আরও পড়ুন-বিক্রম বেতাল-এর রূপকথা ও এক অদ্ভুত কাহিনি
আসলে, স্টেটসম্যান পত্রিকায় আজ একটা খবর বেরিয়েছে। আমেরিকার শিকাগোতে ধর্মমহাসম্মেলন বসেছিল। তারই সমাচার। ক্যান্টারবেরির আর্চ বিশপ যেদিন থেকে ধর্মসম্মেলন বর্জনের কথা ঘোষণা করেছেন, সেদিন থেকে স্টেটসম্যানও ও-ব্যাপারে উদাসীন। প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান ধর্ম ইংল্যান্ডের রাজধর্ম। একমেবাদ্বিতীয়ম খাঁটি ধর্ম। সেই ধর্মের প্রতিনিধি যদি ধর্মসম্মেলনে যোগ দেন তবে মেনে নেওয়া হবে যে সেই ধর্ম পৃথিবীর আর পাঁচটা ধর্মর মতোই। সমস্তরের। তাই-ই আর্চ বিশপের ওই সিদ্ধান্ত। ওসব ধর্মমহাসভা, সর্বধর্মসমন্বয়ের ধারণা, এসবে তাঁর বিস্তর আপত্তি। আর আপত্তির আড়ালে লুকিয়ে ছিল আরও একটি আদ্যন্ত রাজনৈতিক কারণ। ইংল্যান্ডের রাজা ব্রিটিশ চার্চের প্রভু। আর ভারতবাসী ইংল্যান্ডের রাজার প্রজা। আমেরিকা ভারতের ‘প্রভু’ নয়। তারা তাই শিকাগো ধর্মমহাসভায় আমন্ত্রণ জানিয়ে বসেছে ভারতীয় ধর্মের প্রতিনিধিদের। পার্লামেন্ট অব রিলিজিয়নে যোগ দিলে ওই প্রজাগুলোর সঙ্গে একই সারিতে বসতে হবে রাজধর্মের প্রতিনিধিকেও। তা কী করে সম্ভব! প্রোটেস্ট্যান্ট ইংল্যান্ডকে সাম্রাজ্যের প্রয়োজনে ধর্মের ব্যাপারেও প্রভুসুলভ পার্থক্য বজায় রাখতে হবে তো! তাই ক্যান্টারবেরির আর্চ বিশপের এমন সিদ্ধান্ত।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর অসন্তোষ প্রকাশ এবং কড়া নির্দেশের পরেই তৎপরতা
আর স্টেটসম্যান? তারা তো বাংলাদেশের এক নম্বর অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান দৈনিক। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সুরে সুর মেলানো, তার হাত শক্ত করাই এই কাগজটির কাজ। সেজন্য তারাও পার্লামেন্ট অব রিলিজিয়ন সংক্রান্ত খবরে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিল। আজকের প্রতিবেদনটাও আদতে স্টেটসম্যানের নিজেদের খবর নয়। বোস্টন ইভিনিং ট্রান্সক্রিপ্ট থেকে নেওয়া। তাতে ফ্রান্সিস অ্যালবার্ট ডাউটি ধর্মসভায় উপস্থিত ভারতীয়দের একটা বিবরণ দিয়েছেন। সেখানেই বর্ণিত হয়েছে এক উজ্জ্বল হিন্দু সন্ন্যাসীর কথা। নাম স্বামী বিবেকানন্দ। ধর্মমহাসভায় তিনিই নাকি সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। যেমন নজরকাড়া চেহারা, তেমন মনে নাড়া দেওয়া কথাবার্তা। অপূর্ব ব্যক্তিত্ব, অসামান্য বাণী। সেই সংবাদের সুতো ধরে স্টেটসম্যান জানিয়েছে, বছর তিরিশ বয়সি এই যুবক কলকাতার ছেলে।
এসব পড়েই মাস্টারমশাই যারপরনাই উত্তেজিত। একবার তাঁর মনে হচ্ছে, এই স্বামী বিবেকানন্দ তাঁদের চেনা নরেন। সিমলা পাড়ার নরেন্দ্রনাথ দত্ত। মহেন্দ্রনাথ ও ভূপেন্দ্রনাথের বড় দাদা। কিন্তু পরক্ষণেই প্রশ্ন জাগছে তাই-ই কি?
এমন সংশয় একাধিক কারণে স্বাভাবিক।
আরও পড়ুন-গঙ্গাভাঙন রুখতে তৎপর প্রশাসন
প্রথম কারণ, মাস্টারমশাইদের চেনা নরেন্দ্রনাথের ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা করার অভ্যাস আছে বলে কারও জানা ছিল না। আমেরিকায় গিয়ে তিনি ইংরেজিতে বক্তৃতা করে হুলস্থূল কাণ্ড ঘটিয়েছেন, এটা প্রথম ধাক্কাতেই হজম করা কঠিন ছিল।
দ্বিতীয় কারণ, হিন্দুর পক্ষে সমুদ্রযাত্রা নিষিদ্ধ। বিশেষ করে হিন্দু সন্ন্যাসীর পক্ষে। আর যায়ও যদি, তবে সে সেদেশে খাবেই বা কী, আর পরবেই বা কী? আমেরিকায় তো সাত্ত্বিক হিন্দুর খাবার পাওয়া যায় না। আর পোশাক-পরিচ্ছদ? ‘আমেরিকা ঠান্ডা দেশ, সাহেবের দেশ, সেখানে ইজের পরিতে হয়।’
আরও পড়ুন-‘বাংলার বুকে চা শ্রমিকদের নিয়ে এই সভা নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ’ জানালেন ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়
তৃতীয় কারণ, নরেন্দ্রনাথের সন্ন্যাসজীবনের নাম। আলমবাজার বরানগর মঠে নরেন্দ্রর সতীর্থরাও ঠিকঠাক জানতেন না, তিনি কী নাম নিয়েছেন। পরিব্রাজক সন্ন্যাসী হিসেবে কখনও শোনা গিয়েছে তিনি বিবিদিষানন্দ, কখনও-বা সচ্চিদানন্দ। ফলে নাম নিয়ে একটা বিভ্রান্তি ছিলই।
সবচেয়ে বড় কথা হল বিবেকানন্দের আমেরিকা-যাত্রা নিয়ে চরম গোপনীয়তা। শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত অনুরাগীদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র সেখবর জানতেন। এঁরা হলেন ‘শ্রীশ্রীমাতাঠাকুরাণী’ অর্থাৎ সারদা মা, ‘সান্যাল মহাশয়’ অর্থাৎ বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল (ইনি ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলামৃত’র লেখক), শরৎ মহারাজ অর্থাৎ স্বামী সারদানন্দ (ইনি রামকৃষ্ণ মিশনের প্রথম সম্পাদক, আমৃত্যু সেই পদে আসীন ছিলেন এবং ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ’-এর লেখক), যোগেন মহারাজ অর্থাৎ স্বামী যোগানন্দ এবং বিবেকানন্দের মেজভাই মহেন্দ্রনাথ নিজে। তবে কবে, কোথায়, কখন, কীভাবে স্বামীজি আমেরিকায় যাচ্ছেন, সেখবরটা ঠিকমতো মহেন্দ্রনাথেরও জানা ছিল না।
আরও পড়ুন-পুজোর আগেই প্রস্তুত বনবিভাগের ৩৫ হোটেল
অবশেষে, মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত মহেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে কথা বলে নিঃসংশয় হলেন। এ তাঁদেরই নরেন। খুশিতে ডগমগ হয়ে মাস্টারমশাই বাড়ি ফিরলেন। আস্তে আস্তে সেই আনন্দের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল বাংলার আনাচে-কানেচে। দিন কয়েকের মধ্যে।
বাকিটা ইতিহাস।