দুকড়িবালা দেবী
অস্ত্র লুকিয়ে ইতিহাসে
বিপ্লবীদের মাসিমা
নিবারণচন্দ্র ঘটক ছিলেন অগ্নিযুগের বিপ্লবী। রানিগঞ্জ সিয়ারসোল রাজ স্কুলের শিক্ষক। বহু তরুণ-তরুণীর বিপ্লবী চেতনার প্রেরণাদাতা। কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন তাঁর ছাত্র। নিবারণচন্দ্রই বিপ্লবের বীজমন্ত্র বুনে দিয়েছিলেন দুখুমিয়ার মনে। তাঁর উদ্যোগেই সেই সময় যুগান্তর দলের একটি কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। অনেকেই নাম লিখিয়েছিলেন সেই দলে। দুকড়িবালা দেবী ছিলেন তাঁদের একজন। এই মহিয়সী নারী ছিলেন সম্পর্কে নিবারণচন্দ্রের মাসিমা। তাই দলের সবাই দুকড়িবালা দেবীকে ‘মাসিমা’ সম্বোধন করতেন। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর অবদান মনে রাখার মতো।
আরও পড়ুন-সত্যপালের বাড়িতে সিবিআই
মায়েরাও পারে
১৮৮৭-র ২১ জুলাই দুকড়িবালা দেবীর জন্ম। বীরভূমের নলহাটি থানার ঝাউপাড়া গ্রামে। গ্রামটি ব্রাহ্মণী নদী ঘেঁষা এবং ব্রাহ্মণী ও তিরপিতা নদী দিয়ে ঘেরা। বাবা ছিলেন নীলমণি চট্টোপাধ্যায় এবং মা কমলকামিনী দেবী। দুকড়িবালা দেবীর ঝাউপাড়ার বাড়িতে নিয়মিত যেতেন নিবারণচন্দ্র। সঙ্গে থাকতেন বন্ধু, বিপ্লবীরা। স্বদেশি আন্দোলনকারীদের জন্য গোপন আস্তানা হিসাবে মাসিমার বাড়িটিকেই বেছে নিয়েছিলেন নিবারণচন্দ্র। গোপনে তাঁরা নানা বিষয়ে আলোচনা করতেন। করতেন বিভিন্ন পরিকল্পনা। সমস্তকিছু কানে যেত দুকড়িবালা দেবীর। বুঝতেন সব। স্নেহের বোনপোর বৈপ্লবিক কাজমর্ম দেখে তিনি উদ্বুদ্ধ হন। কারণ মনে মনে দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখতেন তিনিও। চাইতেন ইংরেজদের দেশ থেকে তাড়াতে। একদিন দুকড়িবালা দেবী হঠাৎ বিপ্লবী দলে যোগদানের ইচ্ছেপ্রকাশ করেন বোনপোর কাছে। বলেন, ‘‘এবার আমাকে তোমাদের দলে নিয়ে নাও, বাবা।’’
আরও পড়ুন-সত্যপালের বাড়িতে সিবিআই
সেটা শুনে নিবারণচন্দ্র অবাক হন। জানতে চান, ‘‘মাসিমা, আপনি কি পারবেন?’’
উত্তরে দুকড়িবালা দেবী সিংহীর মতো গর্জে উঠে বলেন, ‘তোমরা যদি দেশের জন্য প্রাণ দিতে পারো, তোমাদের মায়েরাও পারে।’’
আর কথা বাড়াননি নিবারণচন্দ্র। সেইসময় ঝাউপাড়ার বাড়িতে এসেছিলেন বিপ্লবী বিপিনবিহারী গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর কাছেই দুকড়িবালা দেবী বিপ্লবের মন্ত্রের দীক্ষা নেন। ধীরে ধীরে শিখে নেন বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রচালনার কলাকৌশল। পালন করতে থাকেন দলের নির্দেশ। প্রয়োজনে পরামর্শও দিতে থাকেন।
পিস্তল এবং গোলাবারুদ
১৯১৪ সালের ২৬ অগাস্ট। ঘটে যায় একটি বড় রকমের ঘটনা। যা রীতিমতো তোলপাড় ফেলে দেয়। রডা কোম্পানির জন্য পাঠানো ৫০টি জার্মান মসার পিস্তল এবং বহু সংখ্যক কার্তুজের বাক্স কলকাতা বিমানবন্দর থেকে লুট হয়ে যায়। সশস্ত্র বিপ্লবীরাই এই অস্ত্র লুটের পিছনে ছিলেন। ৭টি গরুর গাড়িতে স্টিল ট্যাঙ্কের মধ্যে ভরা অবস্থায় পিস্তল এবং গোলাবারুদ আসছিল ফোর্ট উইলিয়াম ক্যান্টনমেন্টে। একটি গরুর গাড়ির গাড়োয়ান সেজে একজন বিপ্লবী অস্ত্রগুলিকে পাচার করে দেন। চন্দননগরের গোন্দলপাড়ার ক্ষেত্র বাবুর বাড়ির গোপন আস্তানায়। সেখান থেকে আটটি পিস্তল এবং দুটি বাক্স আসে ঝাউপাড়ার দুকড়িবালা দেবীর বাড়িতে।
আরও পড়ুন-কুস্তিগীরদের পাশে মুখ্যমন্ত্রী, কী বার্তা দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?
ফায়ার করতে জানেন
খবরটি বেশিদিন গোপন থাকেনি। দলেরই একজন বিশ্বাঘাতকতা করেন। ফলে জানাজানি হয়ে যায়। ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনী গোন্দলপাড়ার ক্ষেত্র বাবুর গোপন আস্তানা সম্পর্কে জানতে পারে এবং সেখানে হানা দেয়। উদ্ধার হয় বেশ কিছু স্বদেশি কাগজপত্র এবং একটি চিঠি। একটি চিঠিতেই আভাস ছিল, মাসিমা অর্থাৎ দুকড়িবালা দেবীর বাড়িতে লুঠ করা অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে। চিঠিতে এও লেখা ছিল, নদীর ধার ঘেঁষা গ্রাম বাঁশঝাড়ওয়ালা জঙ্গলে পরিপূর্ণ। সেখানে মাসিমার কাছে ফুলের চারা ও বীজ রয়েছে। মাসিমা ফায়ার করতে জানেন।
বাড়ি ঘেরাও
চিঠির সূত্র ধরেই ব্রিটিশরা মাসিমার খোঁজ শুরু করে। দীর্ঘ খোঁজাখুঁজির পর দায়িত্বে থাকা তৎকালীন সিআইডি ইন্সপেক্টর সুবোধ চক্রবর্তী বরযাত্রী সেজে একটি বিয়েবাড়িতে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন ঝাউপাড়ার মাসিমার খবর। সেই খবর মিলতেই শুরু হয় ব্রিটিশদের তৎপরতা। ১৯১৭-র ৭ জানুয়ারি। বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে নলহাটি থানা থেকে দারোগাবাবু যান ঝাউপাড়ায়। রাতেই দলবল নিয়ে ঘিরে ফেলেন দুকড়িবালা দেবীর বাড়ি।
আরও পড়ুন-মোহালিতে আজ পাঞ্জাব-লখনউ
ভীতু প্রতিবেশী
মাসিমার বাড়ি ঘেরাও করা হয়েছে, রাতে অবশ্য বিন্দুমাত্র টের পাওয়া যায়নি। তবে ভোরের আলো ফোটার আগেই দুকড়িবালা দেবীর কানে ফিসফিস আওয়াজ আসে। সেই ফিসফিসানি কিসের, বুঝে নেওয়ার জন্য সন্তর্পণে দরজায় কান পাতেন। পাশাপাশি শুনতে পান ভারী বুটের শব্দ। তার পরেই আসন্ন বিপদের কথা স্মরণ করে মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। বুকের রক্ত দিয়ে বিপ্লবীদের অস্ত্র রক্ষা করার জন্য প্রতিজ্ঞবদ্ধ হন। স্মরণ করেন পবিত্র গীতা। বালিশের তলা থেকে হাতে তুলে নেন পিস্তল। বাক্স খুলে আরও দুটি পিস্তল কোমরে গুঁজে নেন। পরমুহূর্তেই ছেলেদের ঘুম থেকে জাগান। জানান পুলিশের আসার কথা। বলেন, ‘‘পুলিশ যদি কিছু জানতে চায়, তোমরা শুধু জোরে জোরে কাঁদবে। মনে রেখো, মুখ ফুটে কিছু বললেই কিন্তু পুলিশ তোমাদের মাকে মেরে ফেলবে।’’
এরপর দুকড়িবালা দেবী জাগান বাড়ির কাজের লোক পাঁচকড়ি লেটকে। তাকে নির্দেশ দেন প্রতিবেশী সুরধনী মোল্লানির বাড়িতে অস্ত্রের বাক্স লুকিয়ে রাখতে। সঙ্গে যান দুকড়িবালা দেবী নিজেও। অন্ধকারের বুক চিরে দুই ছায়ামূর্তি বেরিয়ে যায়, পুলিশ টের পায় না।
নায়েবের কানে
সুরধনী মোল্লানি ছিলেন সহজ সরল মানুষ। কিছুটা ভীতু প্রকৃতির। পড়াশোনা বেশি জানতেন না। পাশাপাশি ছিল না গলা নামিয়ে কথা বলার স্বভাব। অস্ত্র দেখে আচমকা ভয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘‘ওরে পাঁচকড়ি, ওসব এখানে রাখবি না।’’
দুকড়িবালা দেবী তাঁকে চুপ করাতে যান। কিন্তু ততক্ষণে ঘটে যায় যা ঘটার। সেই সময় বাড়ির পাশ দিয়ে প্রাতঃভ্রমণে যাচ্ছিলেন গ্রামের নায়েব নলিনী রায়। সমস্ত কথা বিঁধে যায় তাঁর কানে।
বাড়ি তল্লাশি
ইংরেজের নিষ্ঠুর এবং অহংকারী পুলিশ। কতক্ষণ আর ধৈর্য রাখতে পারে? একটা সময় জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা দিতে শুরু করে। ততক্ষণে ফিরে এসেছেন দুকড়িবালা দেবী। কোনও কিছু না জানার ভান করে করেন ঘুম থেকে ওঠার অভিনয়। ধরা গলায় জানতে চান, ‘‘কে ধাক্কা দেয় দরজায়? কে?’’
সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের পরিচয় জানান দেয় পুলিশ। বলে, ‘‘আপনার বাড়ি তল্লাশি করা হবে। দরজা খুলুন।’’
পুলিশের হুংকারে কোনওরকম ভীত এবং বিচলিত না হয়ে দুকড়িবালা দেবী বলেন, ‘‘এখনও সকাল হয়নি। বাড়িতে পুরুষমানুষ নেই। লোকজন জেগে না ওঠা পর্যন্ত বাড়ি খোলা হবে না। অপেক্ষা করতে হবে।’’
আরও পড়ুন-একেনবাবু একাই একশো
সকালবেলা পুলিশ ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট, জমিদারের গোমস্তা এবং গ্রামের কিছু গণ্যমান্য লোকজনের উপস্থিতিতে দুকড়িবালা দেবীর বাপের বাড়ি এবং স্বামীর বাড়িতে জোর তল্লাশি চালানো হয়। দীর্ঘক্ষণ ধরে। কিন্তু অস্ত্রের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
বাজেয়াপ্ত বিপ্লবী বই ও কাগজ
ব্যর্থ হয়ে আরও ক্ষেপে ওঠে পুলিশ। অন্যায়ভাবে বাড়ির মধ্যে শুরু করে তাণ্ডব এবং অত্যাচার। নষ্ট করতে থাকে বাড়ির জিনিসপত্র এবং খাদ্য সামগ্রী। সমস্ত কিছু দেখেও চুপ ছিলেন দুকড়িবালা দেবী। আশ্চর্য রকমের শান্ত। তিনি এবং তাঁর বাড়ির সদস্যরা কেউ ঘুণাক্ষরে টের পেতে দেননি যে সকল অস্ত্রশস্ত্র অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও তল্লাশি চালানোর সময় বাড়ি থেকে বেশকিছু বিপ্লবী বই এবং কাগজপত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়। কিন্তু অস্ত্রের সন্ধান অধরা থেকে যায়। ব্রিটিশ পুলিশদের মধ্যে ঘিরে ধরে চরম হতাশা। তারা ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করে।
গ্রেফতার
ঠিক সেইসময় আসরে নামেন আরও এক বিশ্বাসঘাতক। নলিনী রায়। সেই তিনি, যিনি প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে সুরধনী মোল্লানির কণ্ঠস্বর শুনেছিলেন। জানতে পেরেছিলেন কোথায় সরিয়ে রাখা হয়েছে অস্ত্রের গোপন বাক্স। পুলিশ যখন ব্যর্থ হয়ে ফিরতে চলেছে, তখন নায়েব নলিনী রায় এবং গ্রামের জমিদারের কিছু কর্মচারী উৎকোচের লোভে পুলিশকে সুরধনী মোল্লানির বাড়ি ইশারা করে দেখিয়ে দেন। তারপরেই তৎপরতা বাড়ে পুলিশের। সিআইডি ইন্সপেক্টর সুবোধ চক্রবর্তী এবং সাব ডিভিশনাল পুলিশ ইন্সপেক্টর অন্নদাবাবু সদলবলে বাড়িটির তল্লাশি নিতে শুরু করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই গোপন বাক্সের সন্ধান মেলে। অস্ত্র লুকিয়ে রাখার দায়ে গ্রেফতার করা হয় দুকড়িবালা দেবী এবং সুরধনী মোল্লানিকে। নলহাটি থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। ৯ জানুয়ারি তোলা হয় রামপুরহাট এসডিও আদালতে। সেখানে সুরধনী মোল্লানি জামিন পান। তবে অজ্ঞাতকারণে দুকড়িবালা দেবীকে জামিন দেওয়া হয় না।
আরও পড়ুন-একেনবাবু একাই একশো
দোষী সাব্যস্ত এবং কারাদণ্ড
বিচারের প্রস্তুতির নামে পুলিশ দুকড়িবালা দেবীর উপর অকথ্য অত্যাচার শুরু করে। সমস্তকিছু সহ্য করতে থাকেন মাসিমা। ব্রিটিশ পুলিশ তাঁর মুখ থেকে একটা শব্দও বের করতে পারেনি। পরের স্পেশাল ট্রাইবুনাল কেসে সিউড়িতে বিচার শুরু হলে অস্ত্র আইনের ধারায় দুকড়িবালা দেবীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ৯ মার্চ ১৯১৭, বিচারক তাঁকে সশ্রম কারাদণ্ডের সাজা দেন। পাঠানো হয় প্রেসিডেন্সি জেলে। দুকড়িবালা দেবীই পরাধীন ভারতের প্রথম নারী, যিনি অস্ত্র আইনে সাজা পেয়েছিলেন। গোপন খবর আদায়ের জন্য প্রেসিডেন্সি জেলেও তাঁর উপর নির্মম অত্যাচার চালানো হয়। তবে তাঁর মুখ থেকে একটি শব্দও বের করতে পারেনি ব্রিটিশ পুলিশ। জেলে তাঁকে প্রতিদিন প্রায় আধ মণ ডাল ভাঙতে হত। তবু তিনি তাঁর বাবাকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমি ভালই আছি, আপনারা আমার জন্য চিন্তিত হইবেন না। আপনারা শুধু আমার সন্তানদের খেয়াল রাখিবেন। আমার শিশুরা যেন না কাঁদে।’ এইভাবে পেরিয়ে যায় দীর্ঘ দিন। ১৯১৮ সালেই ডিসেম্বর মাসে তিনি মুক্তি পান।
ছিলেন আদর্শ
জেল থেকে বেরিয়ে দুকড়িবালা দেবী সমাজসেবামূলক কাজে নিযুক্ত হন। ততদিনে তিনি হয়ে উঠেছেন তরুণ সমাজের আদর্শ। তাঁকে দেখে বহু নারী ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনে।
দুকড়িবালা দেবীর স্বামী ছিলেন ফণীভূষণ চক্রবর্তী। তাঁদের তিন সন্তান। সুধীন্দ্রনাথ, সৌরেন্দ্রকুমার এবং সমরেন্দ্রকুমার। এই মহিয়সী নারী ১৯৭০-এর ২৮ এপ্রিল বার্ধক্যজনিত কারণে পাড়ি দেন না-ফেরার দেশে।
ঝাউপাড়া গ্রামে রয়েছে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। দুকড়িবালা দেবীর নামে নামাঙ্কিত। প্রতি বছর নানাভাবে স্মরণ করা হয় এই তাঁকে। তাঁর জীবন এবং সাহসের কাহিনি নিয়ে লেখা হয়েছে বই। এইভাবে নতুন প্রজন্মের মধ্যে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন বিপ্লবীদের মাসিমা। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর অবদান ভোলার নয়।
আরও পড়ুন-চেন্নাই এক্সপ্রেস থামালেন যশস্বী
মহালক্ষ্মী মেনন শোভা
শ্যামা সুন্দরী অভিনেত্রী
অভিনেত্রীর কন্যা
প্রেমা ছিলেন পাঁচের দশকের মালয়ালম চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেত্রী। ফুটিয়ে তুলতেন বিভিন্ন ধরনের চরিত্র। অসংখ্য অনুরাগী ছিল তাঁর। বিয়ে করেছিলেন চেন্নাইয়ের (তখন মাদ্রাজ) পি কে মেননকে। মালয়ালি পরিবার। আনন্দে কাটছিল তাঁদের দিনগুলো। আনন্দের মাত্রা আরও বেড়ে যায় ১৯৬২-র ২৩ সেপ্টেম্বর। জন্ম হয় তাঁদের কন্যা মহালক্ষ্মী মেননের।
শিশুশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ
ছোট বয়সেই অভিনয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন মহালক্ষ্মী। মূলত মাকে দেখে। সেটা লক্ষ্য করেন প্রেমা। তিনি মেয়েকে নানাভাবে উৎসাহ দিতেন। একদিন ছোট্ট মহালক্ষ্মী নজরে পড়েন চলচ্চিত্র জগতের কয়েকজন ব্যক্তির। মিষ্টি মুখ এবং আচার আচরণের কারণে সহজেই অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে যান। ১৯৬৬ সালে মাত্র চার বছর বয়সে শিশুশিল্পী হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। তামিল চলচ্চিত্রে। ছবির নাম ‘ঠাট্টুঙ্গাল ঠিরাক্কাপ্পাডুম’। তখন তাঁর পর্দানাম ছিল বেবি মহালক্ষ্মী। পরিচালক ছিলেন জে পি চন্দ্রবাবু। ছবিতে তিনি আর এস মনোহর, কে আর বিজয় এবং চন্দ্রবাবুর সঙ্গে অভিনয় করেন। উচ্চ প্রশংসিত হয় তাঁর প্রথম কাজ।
আরও পড়ুন-চেন্নাই এক্সপ্রেস থামালেন যশস্বী
তামিলের পর মালয়ালম
মহালক্ষ্মী মালয়ালম ছবিতে আত্মপ্রকাশ করেন পরের বছর। পি ভেনুর উদ্যোগে। সেইসময় তাঁর নামকরণ করা হয় বেবি শোভা। মালয়ালম চলচ্চিত্রের প্রথম সারির একাধিক তারকা ছিলেন ছবিতে। যেমন সত্যন, প্রেম নাজির, কে পি উমার, শারদা, ও শীলা। ব্যাপক সাফল্য পেয়েছিল ছবিটি। শিশুশিল্পী হিসেবে বেবি শোভা দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্রে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। আসতে থাকে একটার পর একটা কাজ। পেতে থাকেন সাফল্য। বাড়তে থাকে নাম। জনপ্রিয়তা।
শিশুশিল্পী হিসেবে পুরস্কৃত
১৯৭১ সালে বদলে যায় শোভার জীবন। ‘যোগম্মুল্লাভাল’ ও ‘আভাল আল্পম ভাইকিপ্পোয়ি’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী বিভাগে পান কেরালা রাজ্য চলচ্চিত্র পুরস্কার। ফলে তাঁর নাম আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ে। আসতে থাকে বেশি বেশি কাজ। বড় বড় পরিচালকের তারকা সমৃদ্ধ ছবি। যত বড় তারকাই থাকুন না কেন, প্রতিটি ছবিতেই শোভা নিজেকে আলাদা ভাবে মেলে ধরতে পারতেন। টেনে নিতেন দর্শকদের মন এবং দৃষ্টি। চরিত্র যত ছোট বা বড়ই হোক না কেন, তাঁকে অস্বীকার করা যেত না কোনও ভাবেই। পর্দায় তিনি আসা মাত্র বাকিরা ম্লান। ছড়িয়ে দিতেন স্নিগ্ধতা, মাখিয়ে দিতেন মায়া। ১৯৭৭ সালে তিনি ‘ওর্মাকাল মারিক্কুমো’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ দ্বিতীয় অভিনেত্রী বিভাগে কেরালা রাজ্য চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।
আরও পড়ুন-অ্যালোপ্যাথ চিকিৎসকদের সমান বেতন পেতে পারেন না আয়ুর্বেদিক বা হোমিওপ্যাথরা : সুপ্রিম কোর্ট
নায়িকার চরিত্রে
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেবি মুছে যায়। তিনি হয়ে ওঠেন শোভা। নবযৌবনা এক শ্যামা সুন্দরী। ১৯৭৮ সালে শোভা বলচন্দ্র মেননের ‘উত্রড়া রাত্রি’ ছবিতে নায়িকা চরিত্রে আত্মপ্রকাশ করেন। একই বছর অভিনয় করেন ‘বন্ধনম’ ও ‘এন্তে নীলাকাশম’ ছবিতে। পান কেরালা রাজ্য চলচ্চিত্র পুরস্কার। পরপর সুপারহিট হতে থাকে তাঁর অভিনীত সমস্ত ছবি। কাজ করতে থাকেন সুপারস্টার রজনীকান্ত সহ একের পর এক জনপ্রিয় নায়কের বিপরীতে। পর্দায় শোভাকে দেখার জন্য তখন ব্যাপক উন্মাদনা দেখা যেত ভক্তদের মধ্যে। তাঁর হাসি ঢেউ তুলত অগণিত যুবকের মনে। টিকিট কাউন্টারে চোখে পড়ত লম্বা লাইন। প্রায় প্রত্যেকটা শো যেত হাউসফুল। সেইসময় পাবলিকের মুখে একটাই নাম, শোভা। গানের সঙ্গে দারুণ ঠোঁট মেলাতেন। তাঁর বিভিন্ন গানে কণ্ঠ দিয়েছেন এস জানকী, পি সুশীলার মতো জনপ্রিয় গায়িকারা। বেশকিছু গানে সুরারোপ করেছেন সলিল চৌধুরী।
পয়সা উশুল
মাকে দেখেই মূলত তাঁর অভিনয় জগতে আসা। তবে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেছিলেন নিজের যোগ্যতায়, একাগ্রতায়, চেষ্টায়। ছিল পিছনে লাগার লোক, নিন্দুক। হেলায় তাঁদের পরাজিত করেছিলেন নিজের অভিনয় প্রতিভা দিয়ে। প্রযোজক পরিচালকরা বাধ্য হতেন তাঁকে নিতে। কারণ পর্দায় শোভা মানেই পয়সা উশুল। ভরপুর বিনোদন।
আরও পড়ুন-দেশের ৪৮টি নিত্যব্যবহার্য ওষুধের গুণমান খারাপ
জাতীয় পুরস্কার
কন্নড় ভাষার ছবি ‘অপরিচিতা’। মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৮ সালে। এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য শোভা শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে পান দক্ষিণ ভারতের ফিল্মফেয়ার পুরস্কার। পরের বছর তামিল ছবি ‘পাসি’-তে অভিনয়ের জন্য লাভ করেন শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। সেইসঙ্গে পান শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী (তামিল) বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার দক্ষিণ।
আজও চর্চায়
১৯৭৮ সাল। শোভা ঘর বাঁধেন পরিচালক বালু মহেন্দ্রের সঙ্গে। সবকিছু চলছিল ঠিকঠাক। নদীর মতো। সংসার, কেরিয়ার। হঠাৎ ঘটে ছন্দপতন। ১৯৮০-র ১ মে, মাত্র ১৭ বছর বয়সে স্বেচ্ছায় পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যান শোভা। খানখান হয়ে যায় ভক্তদের মন। ছয় এবং সাতের দশকের জনপ্রিয় অভিনেত্রীর শেষ যাত্রায় নেমেছিল মানুষের ঢল। শায়িত শোভার নিথর দেহ দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি কেউ। চার দশকের বেশি সময় তিনি নেই। তবু আজও দেশের বহু মানুষ দেখেন তাঁর ছবি। চর্চা করেন। মৃত্যুর তিন বছর পর, ১৯৮৩ সালে মালয়ালম ছবি ‘লেখায়ুদে মরনম ওরু’-তে তাঁর জীবন ও বালু মহেন্দ্রের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ক্ষণজন্মা ছিলেন প্রতিভাময়ী শোভা। নাতিদীর্ঘ ছিল তাঁর অভিনয় জীবন। তারমধ্যে তিনি যে উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন, সাফল্য পেয়েছিলেন, সেটা সত্যিই মনে রাখার মতো।
আরও পড়ুন-অভিষেক গ্রামে গ্রামে, বিরোধীদের গাত্রদাহ
সানা আলি
ইসরোর ইঞ্জিনিয়ার
অসাধারণ সাফল্যের নজির
এ পি জে আব্দুল কালামের স্বপ্ন ছিল বিশ্বের কাছে ইসরো যাতে শ্রেষ্ঠ আসন পায়। সেই স্বপ্নপূরণের পথে অন্যতম কান্ডারির ভূমিকায় থাকবে মধ্যপ্রদেশের মেয়ে সানা আলি। সাফল্যের একমাত্র পথ হল হার না মানার লড়াই। যে লড়াইয়ে মধ্যপ্রদেশের এই প্রতিভাবান কন্যা। কয়েকমাস আগেই ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশনের সহকারী প্রযুক্তি প্রকৌশলী বা অ্যাসিস্ট্যান্ট টেকনিকাল ইঞ্জিনিয়ার পদে নিযুক্ত হলেন সানা। সানার বাবা একজন বাসচালক। অভাব তাঁদের নিত্যদিনের সঙ্গী। তাঁর মধ্যেই সানা ছোট থেকে স্বপ্ন দেখতেন বিজ্ঞানী হবেন। যদিও সেই পথ ছিল না মসৃণ। কারণ লড়াইটা ছিল দারিদ্রের সঙ্গে, প্রতিকূল পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে। কিন্তু স্বপ্ন যদি দৃঢ় হয় তাহলে তা সফল হতে বাধ্য আর সেটাই করে দেখালেন সানা। কঠোর পরিশ্রম, অধ্যাবসায়, মেধা, মনন দিয়ে অসাধারণ সাফল্যের নজির গড়লেন তিনি।
আরও পড়ুন-যুদ্ধ থামাতে জেলেনস্কিকে মধ্যস্থতার ফোন জিনপিংয়ের
স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়ার
মহাবিশ্বের অচেনা, অজানা তথ্য তাঁকে আকর্ষিত করত আর মন ছুটে বেড়াত অনন্ত মহাকাশে। তাই চেয়েছিলেন মহাকাশ বিজ্ঞানী হতে। সেই স্বপ্নতেই বাঁচতেন তিনি প্রতিমুহূর্ত। মেয়ের স্বপ্নপূরণ দুঃসাধ্য হলেও কখনও মুখে তা প্রকাশ করেননি সানার বাবা-মা। যে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে মেয়ে পড়েন সেই কলেজেরই বাসচালক ছিলেন তাঁর বাবা সৈয়দ সাজিদ আলি। হাজার প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মেয়ের স্বপ্নে তাল মেলাতে পিছপা হননি। সানার বাবা সবসময় চেয়েছিলেন মেয়ে তাঁর লক্ষ্যে অবিচল থাকুক। মেয়েকে পড়াতে আর্থিক ঋণ নিয়েছিলেন সৈয়দ সাজিদ আলি। এমনকী তাঁকে উচ্চশিক্ষিত করাতে মা নিজের গহনা পর্যন্ত বন্ধক দেন। যদিও আত্মীয়-পরিজন কেউ তেমনভাবে চায়নি সানা এতদুর পড়াশুনো করুক বরং তারা সানা বাবা-মাকে পরামর্শ দিয়েছিল মেয়েকে যত দ্রুত সম্ভব পাত্রস্থ করার। সেই মতো তাঁর বিয়েও হয়ে যায় ২০২২-এ। সানার স্বামী গোয়ালিয়র নিবাসী আক্রম খান। তিনিও পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। শ্বশুরবাড়িও সানার স্বপ্নকে আপন করে নেয়।
আরও পড়ুন-কিসের বন্ধ? আমার কর্মসূচি তো চলবে, আলিপুরদুয়ারে অভিষেক
কঠোর অধ্যবসায়
মধ্যপ্রদেশের বিদিশায় জেলায় বাড়ি সানার। বিদিশা জেলার সম্রাট অশোক টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে বি টেক পাশ করেন সানা এবং সেখান থেকেই পরবর্তীতে এম টেক করেন। পারোইটা পরীক্ষায় ডিস্টিংশন পেয়ে পাশ করেন সানা। এরপরেই তিনি সুযোগ পান ইসরোতে। অন্ধ্রপ্রদেশের তিরুপতি জেলার শ্রীহরিকোটায় স্থিত ইসরোর রকেট লঞ্চ সেন্টারের ‘সতীশ ধাওয়ান মহাকাশ কেন্দ্রে’ তিনি যোগ দিয়েছেন। শুধু মধ্যপ্রদেশ নয়, এদেশের প্রতিটি মেয়ের উদ্দেশ্যে সানা বলেন, আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। যে কোনও মূল্যে শিক্ষাগ্রহণ করুন। জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছতে সবধরনের চেষ্টা চালিয়ে যান। যাত্রাপথে আসা বিফলতাগুলোকে গুরুত্ব না দিয়ে কঠিন পরিশ্রম করে যান। চেষ্টা থাকলে লক্ষ্যে পৌছনো কষ্টসাধ্য নয়। বাবা-মার পাশাপাশি নিজের এই অসামান্য সাফল্যের কৃতিত্ব দিয়েছেন শ্বশুরবাড়ি লোকজনকে। মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী সহ অনেকেই তাঁকে অভিনন্দন জানান।
আরও পড়ুন-৬০ দিন জনসংযোগে অভিষেক: ৬ দিন বাইরে থেকে দেখাক বিরোধীরা, চ্যালেঞ্জ সাংসদের
জেসিকা ওয়াটকিন্স
সেরা নভশ্চর
দীর্ঘমেয়াদি মিশন
জগৎজোড়া নাম হতে গেলে চাই নজিরবিহীন সাফল্য। চাই এমন কিছু যা কারও নেই। জেসিকা আন্দ্রেয়া ওয়াটকিন্স হলেন তেমন এক নারী। তিনি প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা যিনি ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে একটি বড় দীর্ঘমেয়াদি মিশন সম্পূর্ণ করেছিলেন। তিনি অন্যতম আফ্রিকান আমেরিকান মহিলা যিনি সবচেয়ে বেশি সময় মহাকাশে ছিলেন। মহাকাশচারী স্টেফানি উইলসনের রেকর্ডকেও ছাপিয়ে গিয়েছিলেন জেসিকা। স্টেফানি মহাকাশে অবস্থান করেছিলেন ৪২ দিন ২৩ ঘণ্টা ৪৬ মিনিটের রেকর্ড ব্রেক করেন। জেসিকা মহাকাশে ছিলেন মোট ১৭০ দিন, ১৩ ঘণ্টা ৩ মিনিট।
মিশন ইম্পসিবল
ঠিক ২২ বছর আগের ১৯৯৮ সালের নভেম্বর মাসে মহাকাশে পৃথিবীর কক্ষপথে পাঠানো হয় মানুষের বসবাসযোগ্য, কৃত্রিম উপগ্রহ ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন (আইএসএস) কে। এরপর দু’দশকেরও বেশি সময় কেটে গেছে। ঠিক তার পরেই ২০২২ স্পেস এক্স ক্রু ৪ মিশনের অন্যতম অভিযাত্রী ছিলেন জেসিকা। ২০২১-এ তিনি এই মিশনের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ছয়মাসের এই মিশনে তিনি মিশন বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। যেখানে তাঁর কাজ ছিল পৃথিবীর ভৌগোলিক পরিবর্তনগুলি লক্ষ্য রাখা এবং তাঁর ছবি তোলা পাশাপাশি এবং মহাকাশ বিজ্ঞান ও পৃথিবী ও জীববিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণামূলক তদন্ত।
আরও পড়ুন-২০৩০-এর মধ্যে তাপপ্রবাহের মেয়াদ তিন দিন বাড়বে ভারতে
বহুমুখী প্রতিভা
জেসিকার পরিচিতির শেষ নেই। তিনি একাধারে NASA-র মহাকাশচারী, ভূতত্ত্ববিদ, অ্যাকোয়ানট এবং প্রাক্তন আন্তর্জাতিক রাগবি খেলোয়াড়। ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জিওলজিক্যাল ও এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স নিয়ে স্নাতক হন। তারপর ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জিওলজিতে স্নাতকোত্তর পাশ করেন। তিনি ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির পোস্টডক্টরাল ফেলো ছিলেন। যেখানে তিনি মহিলা বাস্কেটবল দলের একজন সহকারী কোচও ছিলেন।
তিনি যখন নাসায়
নাসার সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের যোগাযোগ। একটা সময় নাসা-তে ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করতেন। পরবর্তী কালে নাসার এমস রিসার্চ সেন্টার এবং জেট প্রোপালসন ল্যাবে কাজ করেছেন জেসিকা। নাসার মঙ্গলগ্রহের রোভার কিউরিওসিটির অভিযানে যুক্ত ছিলেন তিনি। জিওলজি পড়তে গিয়ে ভিনগ্রহের গঠন নিয়ে তাঁর গবেষণার উৎসাহ তৈরি হয়। ২০১১-তে তিনি অ্যানালগ মিশনে সায়েন্স অপারেটর হিসেবে কাজ করেন। জুন ২০১৭তে জেসিকা নাসা অ্যাস্ট্রোনট গ্রুপ ২২ এর সদস্য নির্বাচিত হন। অগাস্টে তাঁর দু’বছরের প্রশিক্ষণ হয়। ২০২০ সালে চাঁদে মানুষকে ফেরানোর জন্য তিনি আর্টেমিস টিমে নির্বাচিত হন। জেসিকার পরবর্তী লক্ষ্য ২০২৫ সালের ক্রিউড চন্দ্রাবতরণ মিশন।
আরও পড়ুন-শিলাবৃষ্টিতে হাজার হাজার বিঘে জমির ধান নষ্ট
তিনি খেলোয়াড়ও
গেইথসবার্গের মেরিল্যান্ডে জন্ম জেসিকা ওয়াটকিনসের। জন্মের পরপরই তাঁর পরিবার কলোরাডোতে চলে যায় পাকাপাকিভাবে।সেখানেই তার পড়াশুনো, ফেয়ারভিউ হাইস্কুলে পড়তেন। ছোট থেকেই রাগবি খেলার প্রতি অসীম আগ্রহ ছিল তাঁর । হাইস্কুলেই তিনি রাগবি খেলা শুরু করেন এবং চারবছর টিমে ছিলেন। তিনি জাতীয় চ্যাম্পিয়ন দলেরও সদস্য হন। আমেরিকান মহিলা জাতীয় রাগবি দলের প্রাক্তন খেলোয়াড় জেসিকা ওয়াটকিন্স। ২০০৯ সালে রাগবি বিশ্বকাপে সেভেন ইউএসএ ঈগলসের হয়ে তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। বিশ্বকাপের সময় তিনি মার্কিন দলের সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন।
পুরস্কার ও সম্মাননা
জেসিকা ওয়াটকিন্স তার শিক্ষাজীবন, কর্মজীবন, এবং অ্যাথলিট হিসেবে পেয়েছেন বহু পুরস্কার আর সম্মাননা। যার মধ্যে অন্যতম কিছু হল ক্যালটেক ডিভিশন অফ জিওলজিক্যাল অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্সেস থেকে পেয়েছেন পোস্টডক্টরাল ফেলোশিপ। ক্যালিফোর্নিয়া অ্যালায়েন্স ফর গ্র্যাজুয়েট এডুকেশন অ্যান্ড দ্য প্রফেসরিয়েট এর তরফ থেকে পেয়েছেনপোস্টডক্টরাল ফেলোশিপ। পেয়েছেন নাসা গ্রুপ অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড (মার্স সায়েন্স ল্যাবরেটরি প্রাইম মিশন সায়েন্স অ্যান্ড অপারেশনস)। ডাইভার্সিটি ইন দ্য জিওসায়েন্স মাইনরিটি রিসার্চ গ্রান্ট অ্যাওয়ার্ড ইত্যাদি।
আরও পড়ুন-ধৃতের সাতদিনের পুলিশি হেফাজত, চলছে জেরা, আতঙ্ক কাটিয়ে স্কুলে গেল পড়ুয়ারা
স্মিতা সবরওয়াল
পিপলস অফিসার
রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী
একে সুন্দরী তায় বাঙালি। তেলেঙ্গানার বাঙালি আমলা থুড়ি আইএএস অফিসার স্মিতা সবরওয়াল। যাঁকে নিয়ে শোরগোল, উৎসাহ উদ্দীপনার শেষ নেই। এদেশে মহিলা আইপিএস, আইএএস এখন আর অভাব নেই। কিন্তু সুন্দরী আইপিএস বা আইএএস এমন কথা কানে আসেনি কারও। না, শুধু সুন্দরী বলে তাঁকে খাটো করলে ভুল হবে। তিনি রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী। চাইলে বেছে নিতে পারতেন এমন পেশা যেখানে রয়েছে গ্ল্যামারের ছটা। হতে পারতেন অনায়াসে বড়পর্দার অভিনেত্রী, মডেল, বিমানসেবিকা, শিল্পোদ্যোগী যেসব পেশায় নিজেকে অনেক বেশি ফোকাসে রাখা যায়। রূপের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয় সবাই। থাকতে পারতেন ফ্রন্টলাইনে। কিন্তু সেদিকে না গিয়ে তিনি হলেন একধরনের ফ্রন্টলাইন ওয়ারিয়র। ছোট থেকে বিদুষী স্মিতা আজ সবার অনুপ্রেরণা। শুধু আইএএস অফিসার নয়, তাঁর অন্যতম পরিচয় তিনি হলেন ‘পিপলস অফিসার’।
আরও পড়ুন-শিলাবৃষ্টিতে হাজার হাজার বিঘে জমির ধান নষ্ট
মেধাবী কন্যা
২০০০ সালের ইউপিএসসি পরীক্ষায় চতুর্থ র্যাঙ্ক করেন স্মিতা সবরওয়াল। আইএএস টপার এই বঙ্গকন্যা। স্মিতার জন্ম দার্জিলিং-এ। বাবা কর্নেল প্রণব দাস অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার। মা পূরবী দাস। বাবার চাকরির কারণে সুবাদে তাঁকে থাকতে হয়েছে বিভিন্ন শহরে। তাঁর শৈশব কেটেছে হায়দরাবাদে। সেকেন্দ্রবাদে স্কুলিং শেষ করে হায়দরাবাদের সেন্ট অ্যান মারেদপল্লি স্কুল থেকে বারো ক্লাস উত্তীর্ণ হন। এখানে তাঁর বাকি শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়। দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় সারা ভারত থেকে প্রথম স্থানাধিকারী ছিলেন স্মিতা। বাণিজ্য বিভাগ থেকে স্নাতক হন তিনি। সাফল্য, ব্যর্থতা জীবনের নিয়ম তাই প্রথমবার যখন সিভিল সার্ভিস দেন তখন তিনি ব্যর্থ হন। কিন্তু হাল ছাড়েননি। দ্বিতীয়বার সেই সুযোগ পেয়ে যান। মাত্র ২৩ বছর বয়সে আইএএস হওয়ার পর স্মিতাই হলেন দেশের সর্বকনিষ্ঠ আইএএস। স্মিতা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘অনেকের ধারণা, সিভিল সার্ভিসে চাকরি পেতে হলে শুধুমাত্র আপনাকে অনেক পড়তে করতে হবে। এই ভাবনাটা ভুল। আপনি যদি শেষ রাউন্ডে নিজের পছন্দের জিনিস নিয়ে কিছু না বলতে পারেন, তাহলে আপনি কোনওদিন একজন সিভিল সার্ভিস আধিকারিক হতে পারবেন না।” এটাই হয়তো ওনার সাফল্যের কারণ।
আরও পড়ুন-ফের চড়ছে তাপমাত্রার পারদ, রয়েছে একাধিক জেলায় বৃষ্টির পূর্বাভাস
মানুষের জন্য
তেলেঙ্গানা ক্যাডার থেকে আইএএস প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন স্মিতা। নিয়োগের পর চিত্তুরের সাব কালেক্টর ছিলেন তিনি। এরপর স্মিতা কুর্নুলের জয়েন্ট কালেক্টর, করিমনগর এবং মেডকের জেলাশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
পদমর্যাদায় স্মিতা হলেন তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রীর সচিব। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে মহিলা আইএএস কর্তার নিয়োগ একটা সময়ে বিরল বিষয় ছিল। স্মিতাই প্রথম মহিলা আইএএস, যাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে নিয়োগ করা হয়।
স্মিতা কাজ করেছেন মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায়। সেই দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে পালন করেন। তাঁর কর্মক্ষেত্রের প্রতিটা এলাকার পরিকাঠামোর উন্নয়নে বড়সড় ভূমিকা পালন করে এসছেন সবসময়। জনতার অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছেন এই জেলাশাসক। শুধু নিজেকে নয়, তাঁর কাজের মাধ্যমে সরকারকেও জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন স্মিতা। তাই তাঁকে জনগণের আমলা বা পিপলস অফিসার বলেই সবাই চেনে।
আমজনতার সমস্যা শুনে তার সমাধান খোঁজেন স্মিতা। করেছেন বহু বাস্তবমুখী উন্নয়ন, অনেক নতুন প্রকল্পকে বাস্তবায়িত করেছেন। তাঁর এলাকার মানুষের আর্থিক এবং সামাজিক উন্নতিকল্পে আম্মাললনা, প্রজাবাণী, ফান্ড ইওর সিটি ইত্যাদি জনপ্রিয় প্রকল্প তৈরি করেছেন। স্মিতার কারণে তেলেঙ্গানা বিভিন্ন জেলা দিনে দিনে স্বচ্ছ, সুন্দর হয়ে উঠেছে। উন্নত হয়েছে স্বাস্থ্য পরিষেবা। তাঁর আমলে নারী ও শিশুমৃত্যুর হার অনেক কমে গেছে সেখানে। ২০১২ সালে করিমনগর প্রধানমন্ত্রী মনোনীত সেরা জেলা হিসেবে নির্বাচিত হয়।
আরও পড়ুন-জয়ে ফিরল কলকাতা নাইট রাইডার্স
অনুপ্রেরণা সবার
যিনি রাঁধেন তিনি চুলও বাঁধেন। এহেন বিখ্যাত কন্যা পুরোদস্তর সংসারী। স্মিতার স্বামী নামকরা আইপিএস অফিসার আকুন সবরওয়াল। দুই সন্তানের জননী তিনি। তাঁর এমন জনপ্রিয়তা আর সাফল্যের একমাত্র কারণ জনসংযোগ, যাকে আমরা বলি কমিউনিকেশন। আসলে দূর থেকে বসে কোনও মানুষকে যেমন চেনার উপায় থাকে না তেমনই দূরবর্তী মানুষের সমস্যা, ভাল-মন্দ বোঝারও কোনও পথ থাকে না তাই তিনি পড়েছিলেন জনসাধারণের মাঝে। তাঁদের কথা মন দিয়ে শুনেছিলেন এবং তাঁদের মতো করে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, সমস্যার সমধান করেছিলেন। স্মিতা সবরওয়াল হলেন সেই জনমুখ যে আমাদের সবার অনুপ্রেরণা।