সলতে পাকানোর ইতিহাস
অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়। ইংল্যান্ড থেকে বাণিজ্য করতে এসে কলকাতায় তখন ইংরেজরা গুছিয়ে বসতে শুরু করেছে। নিজেদের আমোদ-প্রমোদের জন্য থিয়েটার হল তৈরি করে নাটকের অভিনয়ের বন্দোবস্ত করল তারা। উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এদেশীয় নাটক বলতে বোঝাত স্বদেশি যাত্রা আর ইংরেজদের থিয়েটারগুলিকে। কবিগান, যাত্রা, পাঁচালিগান এগুলিকে বাংলা নাটকের প্রারম্ভিক কাঠামো বলা যায়। এই যখন সামাজিক অবস্থা তখন ইংরেজি ধরনের নাট্যশালায় সম্পূর্ণ বাংলা নাটকের প্রথম অভিনয় অনুষ্ঠিত হয় ১৭৯৫ সালে।
আরও পড়ুন-ঈশ্বরের আপন দেশে
এই অভিনয়ের যিনি আয়োজক তিনি জাতিতে বাঙালি নন, ভারতীয় নন, এমনকী ইংরেজও নন। তিনি রাশিয়ান পরিব্রাজক। তাঁর নাম হেরাসিম লেবেডফ। যদিও তিনি নিজে বাংলায় নিজের নাম লিখেছেন লেবেডফ। ইউক্রেনের বাসিন্দা লেবেডফ ভাগ্যান্বেষণে ও ভারতীয় ভাষা সংস্কৃতি সম্পর্কে উৎসাহী হয়ে মাদ্রাজে আসেন। পরে আসেন কলকাতায় ১৭৮৯ সালের অগাস্ট মাসে। কলকাতায় তিনি তিন বছর ছিলেন। বাংলা ভাষাকে তিনি ভালবেসে ফেলেছিলেন। এ ব্যাপারে তাঁকে গৃহশিক্ষক পণ্ডিত গোলোকনাথ দাস খুব উৎসাহ দিতেন। এই সময় তিনি দুটি নাটক বাংলায় অনুবাদ করেন। নাটক দুটির একটি হল মলিয়র-এর লেখা ‘লাভ ইজ দ্য বেস্ট ডক্টর’। অন্যটি রিচার্ড পল জড্রেলের লেখা ‘দ্য ডিসগাইজ।’ অনুবাদের কাজে যথারীতি তাঁকে সাহায্য করেছিলেন গোলোকনাথ দাস।
আরও পড়ুন-আজ মহারণ, অপেক্ষা শুধু বিরাট সেঞ্চুরির
গোলোকনাথ দাসই তাঁকে পরামর্শ দেন যদি লেবেডফ নাটক দুটি কলকাতার বুকে মঞ্চস্থ করতে চান তবে বাঙালি শিল্পী তিনি সংগ্রহ করে দেবেন। এতে লেবেডফের উৎসাহ আরও বেড়ে যায়। কিন্তু অভিনয়ের জন্য তো মঞ্চ চাই। সেটা কীভাবে পাওয়া যাবে। গোলোকনাথ দাসের পরামর্শে তিনি সেই সময় গভর্নর জেনারেল স্যার জন শোরের কাছে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করলেন। সেই আবেদন মঞ্জুর হল। ২৫ নম্বর ডোমতলা লেনের জগন্নাথ গাঙ্গুলি মশাইয়ের বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে নিজের উদ্যোগে লেবেডফ তৈরি করলেন ‘দ্য বেঙ্গলি থিয়েটার’। মাসিক ভাড়া ষাট টাকা।
আরও পড়ুন-যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উড়িয়ে গাজার অ্যাম্বুল্যান্সে হামলা ইজরায়েলের
যাত্রা শুরু
এই থিয়েটারের যাত্রা শুরু হয় ১৭৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর শুক্রবার। মঞ্চস্থ হল ‘ডিসগাইজ’ অবলম্বনে ‘কাল্পনিক সংবদল’ নাটকটি। প্রথম রজনীতে থিয়েটারের প্রবেশের মূল্য ছিল গ্যালারির জন্য চার টাকা এবং বক্সের জন্য আট টাকা। প্রথম অভিনয়ের দিন প্রেক্ষাগৃহ পরিপূর্ণ ছিল। অভিনয়ের জন্য সময় নির্ধারিত হল রাত আটটা। এই থিয়েটারের ফলে বাঙালিরা জানতে পারল যে যাত্রা জগতের বাইরেও অন্য ধরনের প্রমোদ ব্যবস্থা হতেই পারে। নাট্য মঞ্চটির নাম ‘বেঙ্গলি থিয়েটার’ অর্থাৎ বাঙালিকে গুরুত্ব দান। মঞ্চসজ্জার বহিরঙ্গে ছিল বাঙালিয়ানার ছাপ। গোলোকনাথ দাসের মাধ্যমে সংগৃহীত অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সবাই ছিলেন বাঙালি।
আরও পড়ুন-রাজ্যে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে ভােটার তালিকা সংশোধনের কাজ
অশনি সংকেত
পরপর দু’বার সাফল্যের সঙ্গে অভিনীত হওয়ার পর তৃতীয়বারের জন্য যখন এই নাটক লেবেডফ মঞ্চস্থ করতে উদ্যোগী হচ্ছিলেন, তখনই শুরু হল তাঁর উপর নিগ্রহের ঘটনা। সেই সময় ইংরেজ পরিচালিত ‘ক্যালকাটা থিয়েটার’ কর্তৃপক্ষ ঈর্ষান্বিত হয় লেবেডফ-এর উপর। লেবেডফের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী টমাস রোওয়ার্থ। তাঁরই প্ররোচনায় চুক্তি ভঙ্গ করে বেঙ্গলি থিয়েটারের শিল্পীরা দলে দলে চলে যেতে শুরু করলেন। লেবেডফ আদালতে মামলা করলেন। কিন্তু সেখানেও বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কেঁদেছে। কারণ কোনও ইংরেজ আইনজীবী লেবেডফের হয়ে মামলা চালাতে রাজি হলেন না। এখানেই শেষ নয় ১৭৯৭ সালের ৬ মে টমাসের চক্রান্তে ইংরেজরা লেবেডফের বেঙ্গলি থিয়েটারে আগুন লাগিয়ে দেয়। খবর পেয়ে ছুটে আসেন লেবেডফ। কিন্তু ততক্ষণে মঞ্চটি ভস্মীভূত হয়ে গেছে। এখন যখন দেখি সাম্প্রতিককালেই কলকাতার বুকে স্টার থিয়েটার, বিশ্বরূপা থিয়েটার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, তখন স্বভাবতই মনে পড়ে এই বেঙ্গলি থিয়েটারের কথা।
আরও পড়ুন-ভূকম্পনে বিধ্বস্ত নেপালে বাড়ছে মৃত্যু, নিখোঁজ বহু
উত্তরসূরি লেবেডফ
পরিব্রাজক লেবেডফ চলে গেলেন। কিন্তু যে প্রেরণা তিনি রেখে গেলেন তাতে উৎসাহিত হয়ে উঠল বাঙালি সমাজ। লেবেডফ এসে দেখিয়ে দিলেন যে বাঙালিদের দিয়ে বাংলা নাটক অভিনয় করানো সম্ভব। তবে বাঙালিরা কেন করতে পারবে না তাঁদের নিজেদের থিয়েটার? এই চিন্তায় বিভোর হলেন বেশ কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি। তা সত্ত্বেও লেবেডফ কলকাতা ছাড়ার পর আরও ৩৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল এমন একটি চিন্তাকে বাস্তবায়িত করার জন্য। ১৮৩১ সালে প্রসন্নকুমার ঠাকুর নির্মাণ করলেন বাঙালির প্রথম থিয়েটার ‘হিন্দু থিয়েটার’। তবে পথিকৃতের সম্মান সর্বদাই থাকবে লেবেডফের জন্য।
পরবর্তী শৌখিন নাট্যশালা
হিন্দু থিয়েটারের পরেই একে একে পেলাম নবীন বসুর ‘শ্যামবাজার নাট্যশালা’, ‘আশুতোষ দেবের সাতু বাবুর থিয়েটার’, কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চ’, পাইকপাড়া জমিদার ভ্রাতাদের ‘বেলগাছিয়া নাট্যশালা’, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের ‘পাথুরিয়া ঘাটা বঙ্গরঙ্গালয়’, ঠাকুরবাড়ির ‘জোড়াসাঁকো নাট্যশালা’ প্রভৃতি। এসবই শৌখিন নাট্যশালা। উদ্যোক্তার উৎসাহে তৈরি। তাঁর মৃত্যুতে অথবা সরে যাওয়াকে কেন্দ্র করে নাট্যশালার যবনিকা পতন।
আরও পড়ুন-নৌসেনার বায়ুঘাঁটিতে ভেঙে পড়ল চেতক হেলিকপ্টার
বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটার পত্তন
বাগবাজার অঞ্চলের একরাশ যুবক নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে অভিনয়ের আয়োজন শুরু করেন। তাঁরা প্রতিষ্ঠা করেন ‘বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটার’। এঁরাই পরে ‘শ্যামবাজার নাট্যসমাজ’ নামে অভিনয় শুরু করেন। এই দলে ছিলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মহেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রাধামাধব কর, অরুণচন্দ্র হালদার, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, মতিলাল সুর, অমৃতলাল বসু, ক্ষেত্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ নব্য যুবকেরা।
আরও পড়ুন-বাতিল রেশন কার্ড নিয়ে আদিত্যনাথ প্রসঙ্গ তুলে বিরোধী দলনেতাকে বিঁধলেন কুণাল ঘোষ
সাধারণ রঙ্গালয়ের উদ্ভব
‘বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটার’ এবং ‘শ্যামবাজার নাট্যশালা’ এই দুই নাট্যশালার উদ্যোগী যুবকদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সাধারণ রঙ্গালয়। গিরিশচন্দ্র ঘোষ প্রথমে এতে যোগদান করেননি। ৩৬৫ নম্বর আপার চিৎপুর রোডে মধুসূদন সান্যালের বাড়িটিতে প্রতিষ্ঠিত হয় সাধারণ রঙ্গালয়। বাড়িটি ‘ঘড়িবাড়ি’ নামে পরিচিত। এর বর্তমান ঠিকানা ২৭৯ এ-এফ রবীন্দ্র সরণি। বাঙালির প্রথম সাধারণ রঙ্গালয়। নাম দেওয়া হল ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’। মঞ্চের দ্বার উদ্ঘাটিত হল ১৮৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর। একটু পিছু ফিরে তাকানো যাক। দীনবন্ধু মিত্রের ‘লীলাবতী’ নাটকের সময় শ্যামবাজার নাট্য সমাজের শিল্পীদের মনে ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠার বীজ উপ্ত হয়। হিন্দুমেলার নবগোপাল মিত্র নাম ঠিক করে দেন ‘দ্য ক্যালকাটা ন্যাশনাল থিয়েটার’। মতিলাল সুর ‘ক্যালকাটা’ অংশটুকু বাদ দিয়ে নামকরণ করেন ‘দ্য ন্যাশনাল থিয়েটার’।
আরও পড়ুন-বাতিল রেশন কার্ড নিয়ে আদিত্যনাথ প্রসঙ্গ তুলে বিরোধী দলনেতাকে বিঁধলেন কুণাল ঘোষ
এঁরা ঠিক করলেন টিকিট বিক্রি করে যে অর্থ উপার্জন হবে, তাতে শিল্পী-কলাকুশলীরা কিছু কিছু করে পাবেন। থিয়েটারের জিনিসপত্র কেনা হবে এবং হল-এর ভাড়া প্রভৃতি করা যাবে। ধর্মদাস সুরের তত্ত্বাবধানে মঞ্চটি স্থাপিত হয়। এর সম্পাদক নিযুক্ত হলেন নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। টিকিটের দাম ঠিক করা হল প্রথম শ্রেণি এক টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণি আট আনা, রিজার্ভ সিট দু টাকা এবং দালানের সিঁড়ি চার আনা। মঞ্চস্থ হল দীনবন্ধু মিত্রের নাটক ‘নীলদর্পণ’। প্রথম দিনের অভিনয় অংশে নিলেন অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মহেন্দ্রলাল বসু, গোপালচন্দ্র দাস, ক্ষেত্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, অমৃতলাল মুখোপাধ্যায়, অমৃতলাল বসু প্রমুখ শিল্পী। এই নাটকের দ্বিতীয় অভিনয় অনুষ্ঠিত হয় ১৮৭২ সালের ২৯ ডিসেম্বর। দ্বিতীয় দিনের পর ন্যাশনাল থিয়েটারে অভিনীত হল দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’। এরপর এই মঞ্চে বিভিন্ন সময়ে দীনবন্ধু মিত্রের বিভিন্ন নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। যে তালিকায় রয়েছে ‘নবীন তপস্বিনী’, ‘লীলাবতি’, ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’। প্রতিটি নাটকে অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি নানান ধরনের চরিত্রে অভিনয় করে তাঁর অভিনয় প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে থাকেন।
আরও পড়ুন-তিস্তার বিপর্যয়ে কালিম্পংয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণের রিপোর্ট পাঠান হল নবান্নে
গিরিশচন্দ্র ঘোষের যোগদান
হিন্দুমেলার সপ্তম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল পাইকপাড়ার কাছে হীরালাল শীলের উদ্যানে। সেখানে ন্যাশনাল থিয়েটারের তরফ থেকে মঞ্চস্থ করা হয় মধুসূদনের নাটক ‘কৃষ্ণ কুমারী’। নাটকের দিনটি ছিল ১৮৭৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। এই নাটকে কৃষ্ণকুমারীর বাবা ভীম সিংয়ের চরিত্রে গিরিশচন্দ্র ঘোষ সবাইকে অভিভূত করে দিয়েছিলেন। অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করলেন নাম ভূমিকায় ক্ষেত্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, ধনদাসের চরিত্রে অর্ধেন্দু শেখর, রানির চরিত্রে মহেন্দ্রলাল বসু, মদনিকার চরিত্রে অমৃতলাল বসু প্রমুখ।
আরও পড়ুন-আমরা নারী আমরা সব পারি
আয়ুষ্কাল
১৮৭২-এর ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৮৭৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি— এই হল সাধারণ রঙ্গালয় তথা ন্যাশনাল থিয়েটারের আয়ুষ্কাল। এই থিয়েটারের বৈশিষ্ট্যগুলো অবশ্যই নজরে পড়ার মতো। এক, এই থিয়েটারই প্রথম পেশাদারি থিয়েটারের প্রবর্তন ঘটায়। দুই, এই থিয়েটারে পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে যে কোনও মানুষ অভিনয় দেখার সুযোগ পান। তিন, এই থিয়েটার প্রতিষ্ঠার পর এই কলকাতার বুকে প্রতিষ্ঠিত থাকে একের পর এক পেশাদারি রঙ্গমঞ্চ। ৪, এই থিয়েটারে অভিনীত প্রথম নাটক ‘নীলদর্পণ’, যা জাতীয়তা বোধ সৃষ্টিতে সাহায্য করেছে। মঞ্চটির নামকরণের সঙ্গে তার অভিনীত প্রথম নাটকের মাহাত্ম্য মিশে গেছে। পাঁচ, অভিনয় যে পেশার রূপ নিতে পারে এই থিয়েটারই তা প্রথম দেখাল। এর ফলে দেখা দিতে থাকে অসংখ্য অভিনেতা-অভিনেত্রী। ৬, থিয়েটার যে লাভজনক ব্যবসা ন্যাশনাল থিয়েটার তা প্রমাণ করেছে। ধনী ব্যবসায়ীরা থিয়েটার ব্যবসায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ৭, মৌলিক নাটকের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার জন্য বহু নতুন নতুন নাটককারের আবির্ভাব ঘটতে থাকে। ৮, আর শুধু শিল্পীদেরই যে আবির্ভাব ঘটল তাই নয় পাশাপাশি নৃত্যশিক্ষক, সংগীতশিক্ষক, পটুয়া প্রভৃতি কলাকুশলীদেরও আবির্ভাব ঘটতে থাকে।
আরও পড়ুন-আজ মহারণ, অপেক্ষা শুধু বিরাট সেঞ্চুরির
এই থিয়েটার ভাঙার মূল কারণ
দলাদলি বাঙালির মজ্জাগত। ফলে ন্যাশনাল থিয়েটার ভেঙে দুটো দল তৈরি হয়। ১, ন্যাশনাল থিয়েটার। দুই, হিন্দু ন্যাশনাল থিয়েটার। প্রথম দলটিতে ছিলেন গিরিশচন্দ্র, ধর্মদাস সুর, মহেন্দ্রলাল বসু প্রমুখ। দ্বিতীয়টিতে ছিলেন অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, অমৃতলাল বসু, অমৃতলাল মুখোপাধ্যায়, ক্ষেত্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়। এই সময় ক্ষণস্থায়ী যে ক’টি রঙ্গমঞ্চ তৈরি হয়েছিল তাতে অভিনয় করে দর্শকদের মাতিয়েছিলেন তারাসুন্দরী, নটী বিনোদিনী, তিনকড়ি, কুসুমকুমারী, অমরেন্দ্রনাথ দত্ত, গিরিশপুত্র দানিবাবু প্রমুখ।
আরও পড়ুন-তিস্তার বিপর্যয়ে কালিম্পংয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণের রিপোর্ট পাঠান হল নবান্নে
পেশাদারি রঙ্গমঞ্চগুলির উত্থান এবং ধীরে ধীরে প্রস্থান
৯০ দশক পর্যন্ত কলকাতার বুকে যেসব পেশাদারি রঙ্গমঞ্চ আমরা পেয়েছি তাদের মধ্যে রয়েছে, স্টার থিয়েটার (৭৯/৩/৪ বিধান সরণি), মিনার্ভা থিয়েটার (৬ বিডন স্ট্রিট), রঙমহল (৭৬/১ বিধান সরণি), বিশ্বরূপা (২বি রাজা রাজকৃষ্ণ স্ট্রিট), কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ (২০/২সি মানিকতলা), রঙ্গনা (১৫৩/২এ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড), বিজন থিয়েটার (রাজা রাজকৃষ্ণ স্ট্রিট), সারকারিনা (রাজা রাজকৃষ্ণ স্ট্রিট), নেতাজি মঞ্চ (রেল কোয়ার্টার শিয়ালদহ), রামমোহন মঞ্চ (২৬৬ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড), প্রতাপ মেমোরিয়াল হল (রাজাবাজার), তপন থিয়েটার (৩৭ এবি সদানন্দ রোড), উত্তম মঞ্চ (১০/১/১ মনোহরপুকুর রোড) প্রভৃতি। প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধে সাড়ে ছ’টায়, শনিবার, রবিবার এবং ছুটির দিনগুলিতে তিনটে এবং সাড়ে ছ’টায় নিয়মিত পেশাদারি রঙ্গমঞ্চগুলিতে যে অভিনয় জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে হত, সেই ধারাটি সম্পূর্ণভাবেই নব্বই দশকের শেষে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
শিল্পীদের কৃতিত্ব
এই সময়কালে গিরিশচন্দ্র ঘোষ-পরবর্তী পর্বে অভিনয় করে দর্শকদের মাতিয়ে দিয়েছিলেন শিশিরকুমার ভাদুড়ী, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, অহীন্দ্র চৌধুরী, নরেশ মিত্র, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, ছবি বিশ্বাস, কমল মিত্র, মহানায়ক উত্তমকুমার, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, নির্মলকুমার, তুলসী চক্রবর্তী, পাহাড়ি সান্যাল, উৎপল দত্ত, তরুণকুমার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, রবি ঘোষ, সুপ্রিয়া দেবী, সন্ধ্যা রায়, মাধবী মুখোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন, কেতকী দত্ত, সুব্রতা চট্টোপাধ্যায়, গীতা দে, বাসবী নন্দী, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুপকুমার, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, শোভা সেন, মঞ্জু দে, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, বসন্ত চৌধুরী, লিলি চক্রবর্তী, দিলীপ রায় প্রমুখ আরও অজস্র শিল্পী, যাঁদের প্রাণমাতানো অভিনয়ের গুণে দর্শকেরা মন্ত্রমুগ্ধ হতেন। এ প্রজন্মের মানুষেরা তা উপলব্ধি করতে পারবেন না কখনও।
আরও পড়ুন-কৃষ্ণগঞ্জে আজও পূজিত হচ্ছে ডাকাতেকালী
আজকের অবস্থান
‘স্টার থিয়েটার’ যেটি বিধান সরণিতে, সেটি এখন মূলত সিনেমা হল। থিয়েটার মাঝেমধ্যে অভিনয় হয় তবে নিয়মিত নয়। ‘বিশ্বরূপা থিয়েটার’ ভেঙে এখন বিশাল অট্টালিকা তৈরি হয়েছে। ‘রঙমহল’-এ তৈরি হয়েছে মল। এক এক করে ভাঙনের মুখে ‘সারকারিনা’, ‘রঙ্গনা’, ‘বিজন থিয়েটার’, ‘কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ’ প্রভৃতি রঙ্গমঞ্চগুলি। লন্ডনের থিয়েটার পাড়ার সঙ্গে একসময়ে তুলনা করা হত হাতিবাগানের থিয়েটার হলগুলির। কিন্তু আজ সবই ইতিহাসের পাতায় চলে গিয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।