আমার ধর্ম ঠিক, আর অপরের ধর্ম ভুল— এ-মত ভাল না। ঈশ্বর এক বই, দুই নাই। তাঁকে ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন লোকে ডাকে। কেউ বলে গড, কেউ বলে আল্লাহ, কেউ বলে কৃষ্ণ, কেউ বলে শিব, কেউ বলে ব্রহ্ম। যেমন পুকুরে জল আছে, একঘাটের লোক বলছে জল, আর একঘাটের লোক বলছে ওয়াটার, আর একঘাটের লোক বলছে পানি, হিন্দু বলছে জল, খ্রিস্টান বলছে ওয়াটার, মুসলমান বলছে পানি, কিন্তু বস্তু এক। এক-একটি ধর্মের মত এক-একটি পথ, ঈশ্বরের দিকে লয়ে যায়। যেমন নদী নানাদিক থেকে এসে সাগরসঙ্গমে মিলিত হয়।
আরও পড়ুন-পৌষ সংক্রান্তি থেকে কংসাবতী তীরে গঙ্গারতি চালু করছে মেদিনীপুর পুরসভা
যেদিকেই তাকাই, আমি লোককে ধর্মের নামে ঝগড়া করতে দেখি— হিন্দু, মুসলিম, ব্রাহ্ম, বৈষ্ণব এবং বাকিরা। আমরা কি ভাবতে পারি যে এটি ‘জল’ নয়, শুধু ‘পানি’ বা ‘ওয়াটার’? কী হাস্যকর! পদার্থ বিভিন্ন নামে এক, এবং প্রত্যেকে একই পদার্থ খুঁজছে; শুধুমাত্র জলবায়ু, মেজাজ এবং নাম পার্থক্য সৃষ্টি করে। প্রতিটি মানুষ তার নিজের পথ অনুসরণ করুক।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যিনি এমন কথা ভেবেছেন ও বলছেন, তাঁকে পৃথিবী চেনে রামকৃষ্ণ বলে। বিবেকানন্দের ভাষায় তিনি ‘লিভিং পার্লামেন্ট অব ইন্ডিয়া’।
আরও পড়ুন-সমবায় সমিতিগুলিও সক্রিয় উন্নয়নের কাজে : বেচারাম
যিনি রাম তিনিই কৃষ্ণ। দুই-এ মিলে রামকৃষ্ণ। এই রাম-কৃষ্ণ— মহাকাব্যের নন, অস্ত্রের ঝংকারে, নির্দিষ্ট ধর্মের নামে নিজেদের বার্তা প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিভাজনের আশ্রয় নেননি। বরং বারবার বলেছেন, “ঈশ্বর লাভ হবে বলে যে যেটা সরলভাবে প্রাণের সহিত বিশ্বাস করে, সেটাকে খারাপ বলতে নেই…”।
তিনি রামকৃষ্ণ। তিনি পরমহংস। বেদে চার মহাবাক্যর কথা আছে— প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম (ঋকবেদ), তত্বমসি (সামবেদ), অহং ব্রহ্মাস্মি (যজুর্বেদ) ও অয়মাত্মা ব্রহ্ম (অথর্ব বেদ)। জ্ঞানমার্গে যাঁরা সাধনা করেন, সাধনার স্তর অনুযায়ী তাঁদের চারটি ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথমে বহুদক— যিনি তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়িয়েছেন বা বহু জায়গায় জল পান করেছেন। দ্বিতীয় কুটিচক— যিনি সাধনকুটিরে একাকী সাধনা করছেন। তৃতীয় হংস— যিনি ‘‘সোহহং” মন্ত্রের অর্থ সবিকল্প সমাধিতে বোধ করেছেন। আর চতুর্থ পরমহংস— যিনি নির্বিকল্প সমাধিতে ব্রহ্ম সাক্ষাৎ করেছেন এবং সেখান থেকে ফিরে এসে লোকশিক্ষার জন্য আচার্যের ভূমিকা পালন করে চলেছেন।
আরও পড়ুন-মনরেগা নিয়ে গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকে চিঠি তৃণমূলের, সাংসদ চাইলেন একাধিক প্রশ্নের উত্তর
রামকৃষ্ণ পরমহংস তাঁর অর্জিত ব্রহ্মজ্ঞান সহজভাবে সাধারণভাবে সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তিনি কল্পতরু। পুরাণে কল্পতরু গাছের উল্লেখ রয়েছে। দেবাসুরের সমুদ্রমন্থনের সময় সমুদ্রগর্ভ থেকে উঠে আসে। কল্প শেষ হলে আবার সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হয়। এই জন্যই এর নাম কল্পতরু। ইন্দ্রের উদ্যানে এই গাছের কাছে যে যা চাইত তাই পেত।
ঠাকুর অনেকবার ভক্তদের বলেছেন, ভগবান কল্পতরু। কল্পতরুর নিচে বসে যে যা চাইবে, তাই পাবে। তবে তিনি এও বলেছেন, যখন সাধন-ভজনের দ্বারা মন শুদ্ধ হয় তখন খুব সাবধানে কামনা করতে হয়।
দক্ষিণেশ্বরে রানি রাসমণির জামাই মথুর ছোটঠাকুরের মধ্যেই ভগবানকে দেখেছিলেন। গদাধরের ‘রামকৃষ্ণ’ রূপকে জনপ্রিয় করেন তিনিই। তোতাপুরীর কাছে বৈদান্তিক মতে সাধনা করেই গদাধর রামকৃষ্ণ— এই নূতন নামে চিহ্নিত হন।
আরও পড়ুন-অত্যন্ত স্পর্শকাতর: সুপ্রিম কোর্টে স্থগিত কামদুনি মামলার শুনানি
মথুর যেমন রাম-কৃষ্ণ-কালীকে ছোটঠাকুরের শরীরে লীন হয়ে যেতে দেখেন, ঠিক তেমনি ঠাকুরের অন্য ভক্ত গিরিশচন্দ্র ঘোষও বিশ্বাস করতেন ঠাকুর হলেন স্বয়ং ঈশ্বর। তিনি এ-জন্মে এসেছেন মানুষকে সঠিক দিশা দেখাবার জন্য। তাঁর কাছে রামকৃষ্ণ অবতার। তিনি চারদিকে ঠাকুরের অবতারত্ব, তাঁর বিরাটত্ব, তাঁর অনন্যতা সম্পর্কে বলে বেড়াতেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ জানতেন এই কথা। তিনি তাই গিরিশের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘হ্যাঁ গো, তুমি যে আমার সম্পর্কে এত কিছু বলে বেড়াও, আমাকে তুমি কী বুঝেছো?’’
গিরিশ ঠাকুরের সামনে তখন নতজানু হয়ে বসে পড়ে বললেন, ‘‘স্বয়ং ব্যাস বাল্মীকি যাঁর ইয়ত্তা করতে পারেননি, আমি তাঁর কী বলব?’’ অদ্ভুত গদগদ কণ্ঠে অসামান্য ভাবে পরিপূর্ণ হয়ে গিরিশচন্দ্র এই অপূর্ব কথাগুলি যেই বললেন, অমনি শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবসমাধি হল। তিনি বললেন, ‘‘তোমাদের আর কী বলব? তোমাদের চৈতন্য হোক।’’
আরও পড়ুন-শীঘ্রই সমঝোতা চুক্তি খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দফতর-এনএইচআরডিএফের, পেঁয়াজ চাষে উৎকর্ষ কেন্দ্র গড়বে রাজ্য
দিনটা ১৮৮৬ সালের পয়লা জানুয়ারি। ঠাকুরের তখন গলায় ক্যানসার। ডাক্তাররা তাঁকে স্থানান্তর করে বায়ু পরিবর্তনের পরামর্শ দিলে তিনি দক্ষিণেশ্বর ছেড়ে প্রথমে শ্যামপুকুরে একটি বাড়িতে এলেও তা পছন্দ না হওয়ায় তার থেকে অনেক খোলামেলা জায়গা রানি কাত্যায়নীর জামাতা গোপালচন্দ্র ঘোষের কাশীপুরের বাগানবাড়িতে এসে উঠলেন। ঠাকুরের শিষ্য সিমুলিয়ার বাসিন্দা সুরেন্দ্রনাথ মিত্র ওই বাড়ির ভাড়া আশি টাকা দেবার অঙ্গীকার করেছিলেন।
ঠাকুর সেদিন একটু সুস্থ বোধ করছিলেন। তিনি দোতলার ঘর থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এসে দেখলেন তাঁর শিষ্যদের। গিরিশ ছাড়াও অতুল, রাম, নবগোপাল, হরমোহন, বৈকুণ্ঠ, কিশোরী, হারান, রামলাল, অক্ষয়-সহ আরও অনেক গৃহীভক্ত উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা ঠাকুরের সেই রূপ দেখে বিমোহিত হয়ে ঘিরে ধরে হাতজোড় করে তাঁর কাছে প্রার্থনা করছেন, কেউ-বা তাঁর পায়ে শরীরে ফুল দিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করছেন, কেউ স্পর্শ করতে ব্যকুল হচ্ছেন আর সকলের অন্তরে অদ্ভুত পরিবর্তন আসছে। ভিতরের সমস্ত ভাবরাশি বাইরে বেরিয়ে আসছে অনর্গল ধারায়।
আরও পড়ুন-নেত্রীর বাড়িতে অভিষেক
রামকৃষ্ণের কথা শুনে ভক্ত রামচন্দ্র-সহ অন্যরা দৌড়ে এসে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘‘ওরে তোরা কে কোথায় আছিস, দৌড়ে আয়। ঠাকুর আজ কল্পতরু হয়েছেন।’’
এই চৈতন্য স্বার্থগন্ধহীন। এই চৈতন্য অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে আলোয় যাবার দিশা। আর এই কল্পতরুরূপ জ্ঞানবৃক্ষের কাছে অনৈতিক চাওয়া নয়। লোভ, ঈর্ষা, অন্যের ক্ষতি করার মানসিকতা নিয়ে একমাত্র নিজের জন্য চাওয়া নয়। এই চাওয়া হতে হবে বৃহত্তর স্বার্থে। তবেই তিনি তা পূরণ করবেন। নইলে যা যা চাওয়া হল তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া গেলেও তা ক্রমশ ধূলিস্যাৎ হবে।
আজ যখন আমরা সবাই ছুটছি তামসিক তৃপ্তির জন্য, অর্থ, লোভ, লালসা আমাদের ঘিরে ফেলেছে, তার থেকে নিষ্কৃতি পেতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ছি আরও অন্ধকারে, তখন এই শুদ্ধ চেতনার, প্রকৃত জ্ঞান ও সত্যকে উপলব্ধি করার জন্য নতজানু হই বারবার তাঁর কাছে। তিনি এই অশান্ত, হিংসা, দ্বেষ-পূর্ণ রক্তক্ষরিত যুদ্ধক্লান্ত পৃথিবীতে আরেকবার দাঁড়িয়ে যদি কল্পতরু হয়ে বলেন ‘তোমাদের চৈতন্য হোক’ তবে কি এই নিকষ কালো রাতের অন্ধকার ঘুচে আলো আসবে? বিশ্বাস করি আসবে। শুধু চাওয়াটা আমি ছেড়ে আমরা হতে হবে।