সুস্মিতা নাথ: পয়লা নয়, এবার নববর্ষটা পটলাদার কাছে একলা বৈশাখ হয়ে এল। এর জন্যে অন্য কেউ দায়ী নয়। দায়ী স্বয়ং পটলাদাই। নববর্ষ উপলক্ষে ‘নিউ-ইয়ার রিজোলিউশনের’ নামে একপ্রস্থ সংকল্প করেছে সে। আগের দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তির রাতেই রাত জেগে ইয়া লম্বা একখানা লিস্টি বানিয়েছে। ওতে নেই নেই করেও ঊনচল্লিশটা সংকল্প লিখেছে। সেই তালিকাভুক্ত পাঁচ ও সাত নম্বর সংকল্প মেনে চলতে গিয়েই ওর আজকের এই একাকী উৎসব যাপন।
আরও পড়ুন-আজ আইএসসি ও আইসিএসই পরীক্ষার ফল
একলা যে পটলাদা আগে থাকেনি, তা নয়। তবে সে একলা থাকা অন্যরকম ছিল। যেবার ওর মামা ও মামিমা আত্মীয়ের বিয়েতে দিন চারেকের জন্যে সোদপুর গেলেন, ইন্টারস্কুল ফুটবল টুর্নামেন্টের জন্যে পটলাদা ওঁদের সঙ্গে যেতে পারেনি। তখনই নিজের বাড়িতে ক’টা দিন একলা ছিল পটলাদা। আর সেই একলা থাকার যে কী আনন্দ! দেদার আড্ডা পিটিয়েছি ওদের বাড়িতে। প্রতিদিন পিকনিক করেছি, গালগপ্পো করেছি, ক্যারাম খেলেছি, টিভি দেখেছি, আর খানিক বাদে বাদেই পাশের অমৃতভাণ্ডার থেকে সিঙ্গাড়া, জিলেপি, মোহনভোগ, বা খাস্তা কচুরি এনে খেয়েছি। দু’দিন চিনে রেস্তঁরায় গিয়ে গার্লিক চিকেন, ফ্রায়েড রাইসও খেয়েছি। কয়েকদিন বাড়ি থাকবেন না বলে ওর মামিমা ওকে ভালমন্দ খাওয়ার জন্যে একগুচ্ছ টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা সবাই মিলে ওটারই সদ্ব্যবহার করেছি।
অর্থাৎ সেবার পটালাদা একলা থাকলেও ঠিক একলা থাকা বলা যায় না ওটাকে। আমরা ওর সঙ্গে ছিলাম সবসময়। কিন্তু এবারের কেস আলাদা। এবারে ওর মামা-মামি নন, বরং আমরাই ওকে একলা রেখে যাচ্ছি। আর সেটাও আমাদের ইচ্ছেয় নয়, বরং পটলাদা যে ভীষ্মের ‘রিজোলিউশন’ করেছে, তার জন্যে। ফলে বাড়িতে মামা, মামিমা, লোকলশকর সব থাকা সত্ত্বেও স্বেচ্ছা নির্বাসনে পটলাদা বিষণ্ণ মনে একাকী হয়ে আছে। তাও আবার নববর্ষের মতো একটা উৎসবমুখর দিনে।
আরও পড়ুন-ইস্টবেঙ্গলের সম্মানে আপ্লুত সলমন
ঘটনাটা বুঝিয়ে বলতে হলে একটু ইতিহাস ঘাঁটতে হয়। … এই নিয়ে চারবার হল পটলাদা মাধ্যমিকে হোঁচট খেয়েছে। ওর মতো জ্ঞান-বিদ্যে-বুদ্ধিসম্পন্ন ছাত্রের এমন হওয়ার কথা নয়। তবু একবার নয়, দু’বার নয়, চার-চারবার একই ঘটনা ঘটল! অশেষ জ্ঞান-বিদ্যের জন্যে আমাদের বিচ্ছুদলের মধ্যে পটলাদার একটা বিশেষ স্থান আছে। সবচাইতে বড় কথা, ওর উদ্ভাবনী শক্তির তুলনা নেই। পড়াশোনা কিছু না-করলেও উত্তরপত্র খালি ছাড়ার পাত্র সে নয়।
একবার যেমন, বিজ্ঞানের পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছিল, ‘সালোকসংশ্লেষণ কী’? বিজ্ঞান বইয়ের সে অধ্যায়টা তেমনভাবে পড়া ছিল না ওর। কিন্তু এতে দমে না-গিয়ে উত্তরে খুব কাব্যিক ভাষায় পটলাদা লিখেছিল, ‘তপ্ত দুপুরে প্রখর সূর্যালোকে বৃক্ষ যখন সবুজ বরণ,/তাহাকে শাক-সবজি জ্ঞানে রাঁধিয়া খাইবার নামই সালোকসংশ্লেষণ।’ প্রক্রিয়াটির সঙ্গে যে ‘সূর্যালোক’ আর গাছের সবুজ রঙের সম্বন্ধ আছে, সেটা ওর মনে ছিল। বাকিটুকু সে ভর্তুকি দিয়েছিল নিজের কল্পনাশক্তি আর কাব্যশক্তি দিয়ে।
আরও পড়ুন-ডবল ইঞ্জিন নয়, এখন ট্রাবল ইঞ্জিন
পটলাদার এমনতর উদ্ভাবনী শক্তির উদাহরণ ভূরি ভূরি। পরীক্ষার উত্তরপত্রগুলো ভরে থাকে ওর তেমনই সাংঘাতিক সাংঘাতিক গবেষণামূলক, বিশ্লেষণাত্মক উত্তরে। একবার যেমন ইতিহাস পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছিল, ‘তাজমহল কে নির্মাণ করেছিলেন?’ পটলাদা সেটার উত্তরে গোটা তিনটে পৃষ্ঠা জুড়ে যে উত্তর লিখেছিল, তার সারবস্তু এই, ‘তাজমহল নির্মাণ করেছিল অনেকজন রাজমিস্ত্রি, ছুতোর, পাথর ভাঙা মিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, রংমিস্ত্রি, স্থপতি, ভাস্কর ও বহু শ্রমিক মিলে।’
অর্থাৎ অনেককিছু লিখলেও পটলাদা কেবল সম্রাট শাহজাহানের নামটা উল্লেখ করতে ভুলে গিয়েছিল। ওটাই যা ত্রুটি ছিল। কিন্তু নির্দয় অবিবেচক পরীক্ষক ওইটুকু ত্রুটির জন্যে অতবড় উত্তরটা পুরো কেটে দিয়েছিলেন। কোনও মানে হয়?
যাইহোক, চার-চারবার মাধ্যমিকের বৈতরণী পার হতে পারেনি বলে ওর মামা গেছেন খুব খেপে। বলেছেন, “অনেক বিদ্যে দেখিয়েছিস, এবারে একটু পাঠ্যবইয়ে মন দে। নিজের পাণ্ডিত্য দেখানোর দরকার নেই। মাধ্যমিকে মধ্যম জ্ঞানই ভাল। এবার বরং পাঁঠার মতো ম্যা-ম্যা করে পাঠ্যবইগুলো পড়ে যা।”
আরও পড়ুন-ইস্টবেঙ্গলের সম্মানে আপ্লুত সলমন
কিন্তু কত আর পাঠ্যবইয়ে মুখ গুঁজে থাকা যায়? ওর কি আর অন্য কাজ নেই? কত ব্যস্ততা পটলাদার! ক্রিকেট ম্যাচ আছে, ফুটবল টুর্নামেন্ট আছে, ক্লাব আছে, সমাজসেবা আছে, তা ছাড়া আমার মতো সাঙ্গাতদের হাতে কলমে নানা তালিম দিতে হয়। অঢেল কাজ। এসবের জন্যে পাঠ্য বইগুলোর প্রতি সুবিচার করতে পারছিল না সে। অথচ মামাবাবু এবারে ডেডলাইন দিয়ে দিয়েছেন। পঞ্চমবারেও যদি এই অসাধ্য সাধন, মানে মাধমিকে উৎরোতে না পারে, তবে আদ্যাপীঠে পুরোহিতের কাজে লাগিয়ে দেবেন ওকে। সেই থেকে পটলাদা টেনশনে পড়ে গেছে। অবশেষে বছরের শুরুতেই একগাদা সংকল্পের লিস্টি বানিয়ে পাঠ্যবইয়ে মনোনিবেশ করার সময় বের করেছে ও।
নববর্ষ থেকেই যাতে শুরু করা যায়, সেজন্যে পয়লা বৈশাখের আগের রাতেই পটলাদার সংকল্পের তালিকা তৈরি। একটা চার্টপেপারে রঙিন কালিতে বড় করে লিখে সেটা ক্যালেন্ডারের মতো বিছানার পাশে ঝুলিয়ে দিয়েছে। যাতে ঘুম থেকে উঠেই সেগুলো চোখে পড়ে, আর সারাদিনের জন্যে প্রস্তুতি নেওয়া যায়। আমাদেরও তালিকাটা পড়ে শুনিয়েছে পটলাদা। গুনে গুনে ঊনচল্লিশটা সংকল্প। সব সংকল্পের কথা তো মনে নেই, তবে যে দুটি সংকল্পের জন্যে আজ পয়লা বৈশাখে ওর একলা অবস্থা, সেই পাঁচ ও সাত নম্বর সংকল্প দু’টি হল, ‘‘(সংকল্প-৫) পাঠ্যপুস্তকে পর্যাপ্ত সময় নিবেদন করিবার নিমিত্ত এই বছরটিতে ক্রিকেট, ফুটবল আদি খেলিব না। (সংকল্প-৭) এই বছর ক্লাবে আড্ডা মারিয়া সময় নষ্ট করিব না।”
এবারে হয়েছে কী, নববর্ষ উপলক্ষে দক্ষিণপাড়ার তরুণদল ক্লাব একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করেছে। ওটাতে আমাদের খেলতে যাওয়ার কথা। টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। অর্থাৎ বেলাবেলিই খেলা শেষ হয়ে যাবে। শুনেছি, খেলোয়াড় ও ক্লাব মেম্বারদের জন্যে নাকি ওরা ভূরিভোজেরও আয়োজন করেছে। সুতরাং আমন্ত্রণ না-রক্ষা করার প্রশ্নই আসে না।
এদিকে বছরের প্রথম দিন বলে আমাদের ক্লাবেও পিকনিকের আয়োজন হয়েছে। তবে সেটা রাতের পিকনিক। এইসব খেলাধুলো বা পিকনিক ইত্যাদিতে পটলাদার উৎসাহ-উদ্দীপনাই বেশি থাকে সবসময়। কিন্তু এবারে নিজের সংকল্পের চক্করে পড়ে ওর আর এসবে যোগই দেওয়া হচ্ছে না।
বিষণ্ণ হৃদয়ে, ছলছল চোখে দক্ষিণপাড়াতে যাওয়ার সময় পটলাদা আমাদের বিদায় জানাল। পটলাদাকে ছেড়ে ম্যাচ খেলতে যেতে আমাদেরও খুব কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু কী আর করা যাবে? মাধ্যমিকের অসাধ্যসাধন তো ওকে করতেই হবে। একটা মহৎ কাজের জন্যে কতই না আত্মত্যাগ করতে হয়!
আরও পড়ুন-কলকাতার হৃদয় জয় সলমনের
দক্ষিণপাড়ায় দারুণ এক ম্যাচ হল। টসে জিতে আমরা প্রথমে ব্যাটিং নিলাম। আমাদের ওপেনার ব্যাটসম্যান পল্টন শুরু থেকেই ফর্মে। আটত্রিশ বলে আটান্ন রান করে রান-আউট হয়ে গেল। এর পরে নবদা নামল। একবার নবদার একটা স্ট্রোকে বলটা বাউন্ডারির দিকে উড়ে গেল। আমি বলটা অনুসরণ করে ওদিকে তাকাতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম। আরে! দর্শকদের মাঝে ওটা পটলাদা না? ভাল করে চোখ কচলে দেখি, হ্যাঁ পটলাদাই তো! নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। সংকল্প ভেঙে ও কি এখানে আসবে? কিন্তু এসেছে যে, সে তো দেখতেই পাচ্ছি। অবশ্য ওকে দেখে আমার আনন্দই হল। গুরু বিনা চ্যালাদের কী আর ভাল লাগে?
হাড্ডাহাড্ডি লড়াই শেষে আমরাই জিতলাম। আর ম্যাচ শেষ হতেই পটলাদাও আমাদের সঙ্গে ভিড়ে গেল। খেলা শেষে মাটন বিরিয়ানি, চিকেন রেজালা, রায়তা আর ফিরনির ভূরিভোজেও সে থাকল। তার পরে বিকেল নাগাদ ট্রফি হাতে সগৌরবে নিজেদের জায়গায় ফিরে এলাম। ফেরার পথে জেতার আনন্দে পটলাদা আমাদের সব্বাইকে আইসক্রিম খাওয়াল। তবে এতক্ষণেও আমরা কেউই সংকল্প ভাঙা নিয়ে প্রশ্ন করে পটলাদাকে বিব্রত করিনি। আসলে আমরাও তো সবাই পটলাদাকে সবসময় আমাদের সঙ্গে চাই।
রাত্রিবেলা ক্লাবের পিকনিকেও আগের মতোই উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে যোগ দিল পটলাদা। এমনকী মুরগির মাংস পটলাদাই রাঁধল। অবশ্য রান্না করতে করতে নুন-ঝাল চেখে দেখতে কষানো অবস্থাতেই অর্ধেক মাংস সাবাড় করে ফেলেছে সে। এমনটা হামেশাই হয়। রান্না যেই করুক, ‘চেখে’ দেখার গুরুদায়িত্বটা সবসময় পটলাদাই পালন করে থাকে। এসব ভেবেই এমন ভোজপর্বে পর্যাপ্ত মাংসের আমদানি করা হয়। তা ছাড়া পেটুক তো আমরা কেউ কম নই।
খেতে বসতে বসতে রাত প্রায় এগারোটা বেজে গেল। অথচ পটলাদার যেন বাড়ি ফেরার কোনও তাড়াই নেই। অনেকক্ষণ কৌতূহল দমিয়ে রেখে আর থাকতে না-পেরে নবদা বলে উঠল, ‘হ্যাঁরে পটলা, নতুন বছরের সংকল্প শেষপর্যন্ত প্রথম দিনেই ভেঙে ফেললি?’
পটলাদা তখন সবে মুরগির ঠ্যাং-এ কামড় বসিয়েছে। চাকুম চকুম চিবোতে চিবোতে বলল, “না তো, সংকল্প তো ভাঙিনি”।
“সে কীরে? তুই যে লিখেছিস, পড়াশোনাতে সময় দিতে তুই ক্রিকেট-ফুটবল খেলবি না, ক্লাবেও আড্ডা দিবি না, তাহলে এই যে সারাদিন আমাদের সঙ্গেই দিব্যি কাটালি?”
কিন্তু পটলাদা একই রকম নির্বিকার ভাবে মুরগির ঠ্যাং খেতে খেতে বলল, “সারাদিন তোদের সঙ্গে কাটিয়েছি তো কী হয়েছে? সংকল্প তো আর ভাঙিনি। ক্রিকেটও খেলিনি, ক্লাবে আড্ডাও দিইনি।”
পলটাদার কথা শুনে আমরা থ। নবদা বলল, “তবে এখন ক্লাবে কী করছিস? আর দক্ষিণপাড়ায় গিয়েছিলি কেন?”
পটলাদা বলল, “এখন তো পিকনিক করছি। আড্ডা কোথায় দিলাম? পিকনিক আর আড্ডা এক হল? আর দক্ষিণপাড়ায় গিয়েছি তোদের ম্যাচ দেখতে। নিজে তো খেলিনি।”
এরপরে আর কথা হয় না। পটলাদার মোক্ষম যুক্তি। ম্যাচ দেখেছে ঠিকই, কিন্তু খেলেনি। ক্লাবেও নিছক আড্ডা দিতে আসেনি, পিকনিক করতে এসেছে। কাজেই সংকল্প ভেঙেছে এমন দোষারোপ ওকে মোটেই করা যায় না। অবশ্য আমরা এ-ও বুঝে গেলাম যে, সংকল্পের লিস্টি যত লম্বাই হোক, নতুন বছরেও পটলাদার জীবনযাত্রায় বিশেষ পরিবর্তন আসছে না।
অঙ্কন : শংকর বসাক