সর্বজয়া

নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে যাঁর ছবির জগতে প্রবেশ। অসংখ্য নয়, অল্প সংখ্যক ছবির মাধ্যমে যিনি তাঁর প্রতিভার পরিচয় প্রকাশে সক্ষম হয়েছিলেন। আগামিকাল তাঁর জন্মদিন। সেই প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর কথা তুলে ধরেছেন ড. শঙ্কর ঘোষ

Must read

কথা মুখ
পথের পাঁচালী ছবির নির্মাণপর্বে পরিচালক সত্যজিৎ রায় হরিহরের স্ত্রী সর্বজয়ার জন্য যাঁকে বাছলেন তিনি ইতিপূর্বে স্টেজে অভিনয় করেছেন বহুবার। পেশাদারি মঞ্চে নয়, গ্রুপ থিয়েটারে। ফলে তিনি পেশাদারি রঙ্গমঞ্চ ও গ্রুপ থিয়েটারের অভিনয়ের ফারাকটা জানতেন। কিন্তু সিনেমার ক্ষেত্রে তাঁর মনে হয়েছিল সবটাই কমার্শিয়াল। ছবিতে অভিনয় সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিল চেঁচিয়ে সংলাপ বলা, চড়া মেকআপ করা প্রভৃতি। ফলে তিনি সত্যজিৎ রায়কে একটা পোস্টকার্ডে চিঠি লিখে পাঠালেন। লিখলেন ‘পারব না, করব না’। স্বভাবতই সত্যজিৎ রায় খানিকটা অবাক হলেন। কিন্তু সর্বজয়ার জন্য নির্বাচিত শিল্পীর স্বামী সত্যজিৎ রায়ের বাল্যবন্ধু ও সহকর্মী সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর শ্বশুরমশাই সুনীত কুমার, শাশুড়ি নলিনী দেবীর উৎসাহে ও প্রেরণায় অবশেষে তিনি রাজি হলেন সর্বজয়ার চরিত্রে অভিনয় করতে। যাঁর সম্পর্কে বলছি তিনি হলেন করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়। সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি পথের পাঁচালী ছবির সর্বজয়া, যিনি হরিহরের স্ত্রী, অপুর মা এবং দুর্গার মা-ও বটে।

আরও পড়ুন-ডাললেকের মতোই এবার শিকারাবিহার তিস্তায়

ব্যক্তিজীবন
করুণার জন্ম হয় ১৯১৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর সাঁওতাল পরগনার মহেশপুর গ্রামে। বাবার নাম শচীন্দ্রনাথ সেন। মা সুধা দেবী। দুই দাদা রবীন্দ্রনাথ ও আর্যকুমার। স্কুলে যাননি কখনও। তবে পড়াশোনা বন্ধ থাকেনি। শৈশব ও কৈশোর কেটেছিল বই সঙ্গী করেই। বাবা ডাক্তার। বাড়ির সকলেই কংগ্রেসপন্থী। প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে যোগমায়া দেবী কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। গ্র্যাজুয়েট হন। ১৯৪১ সালে এমএ। ইংরেজিতে। গোঁড়া কংগ্রেস বাড়ির মেয়ের জীবনে গোলমালটা লাগল ’৪২-এর আন্দোলনের সময় থেকে। ১৯৪৩ সালে সহপাঠী ও বন্ধু সুব্রতকে বিয়ে করলেন। দু’জনেই ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। সুব্রতরা আবার মার্কসবাদী। করুণা মন্বন্তর দেখলেন নিজের চোখে। এ যেন মৃত্যুর মিছিল।

আরও পড়ুন-সংঘরূপ নির্মাণে শ্রীমা সারদা দেবী

নাট্যজগতে প্রবেশ
স্বামীর হাত ধরে গণনাট্য সংঘে যোগ দিয়েছিলেন করুণা। শাশুড়িও যুক্ত ছিলেন। সেখানে তিনি পরিচিত হলেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, সাধনা রায়চৌধুরি প্রমুখ প্রগতি আন্দোলনের কর্মীদের সঙ্গে। সেখানে তিনি বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ নাটক দেখে অত্যন্ত মুগ্ধ হলেন। বিজন ভট্টাচার্যের ‘গর্ভবতী জননী’ এবং ‘দেবীগর্জন’ নাটক দুটিতে তিনি অভিনয় করলেন। সলিল চৌধুরির লেখা দুটি নাটক ‘জনান্তিকে’ এবং ‘সংকেত’ তাতেও তিনি অভিনয় করলেন। দক্ষিণীর জন্য তিনি অভিনয় করলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নষ্টনীড়’ গল্পে নাট্যরূপে চারুলতার ভূমিকায়। রাজেন তরফদারের পরিচালনায় তিনি অভিনয় করলেন রবীন্দ্রনাথের ‘চিরকুমার সভা’ নাটকে শৈলবালার চরিত্রে। উৎপল দত্তের লিটল থিয়েটার গ্রুপের সঙ্গে তিনি যুক্ত হন এবং সেখানে তিনি উৎপল দত্তের পরিচালনায় ‘গোস্ট’ নাটকে ১৯৫০ সালে অভিনয় করলেন রোজিনা চরিত্রে। এবং ১৯৫২ সালে ‘ডলস হাউজ’ নাটকে তিনি অভিনয় করলেন নোরার ভূমিকায়। গ্রুপ থিয়েটারে অভিনয় করে তিনি প্রাণের স্পর্শ পেতেন।

আরও পড়ুন-বিপ্লবের বহ্নি ও এক নিষ্কম্প দীপশিখা

ছবির জগতে প্রবেশ
সত্যজিৎ রায়ের সব কাজের প্রেরণা তাঁর স্ত্রী বিজয়া রায়। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে স্বীকার করেছেন, ‘করুণা উচ্চশিক্ষিত এবং পুরোপুরি শহুরে মেয়ে। কিন্তু ওর মুখে লাবণ্য এবং শান্ত ভাব দেখে মানিকের মনে পড়েছিল সর্বজয়ার কথা। করুণা অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। কাজেই ও সহজেই নিজেকে সর্বজয়ার ভূমিকায় গড়ে তুলবে বলে মানিকের বিশ্বাস ছিল।’ করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় যে খুব ভালভাবে সত্যজিৎ রায়ের মুখরক্ষা করেছিলেন তাতে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। বিরাট অভিজ্ঞতা হল ছবির জগতে এসে। ভাঙা বাড়িতে ছেঁড়া শাড়ি পরে রয়েছেন সর্বজয়া। উঁচু করে খোঁপা বাঁধা। নাকছাবি, মাদুলি আর টিপ নিয়ে সত্যিকারের গ্রাম্যবধূ। করুণার শিশুকন্যা রুনকিও অভিনয় করেছিল এই ছবিতে ছোট্ট দুর্গার চরিত্রে। সত্যজিৎ রায় এরপরেও করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়েছিলেন তাঁর পরবর্তী ছবি অপরাজিত, দেবী এবং কাঞ্চনজঙ্ঘাতে। অপরাজিততে অপুর মায়ের ভূমিকায় তিনি এত অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন সে সম্পর্কে বিজয়া রায় আমাদের জানাচ্ছেন, ‘‘অপরাজিত যদি মেন অ্যাওয়ার্ড না পেত তাহলে মেয়েদের মধ্যে করুণা অ্যাওয়ার্ড পেত। করুণার দারুণ নাম হয়েছে।” অনেক কাগজে লিখেছে যে ছবিটার নাম ‘আনভ্যাংকুইশড্’ না হয়ে ‘দ্য মাদার’। হওয়া উচিত ছিল। ‘দেবী’ এবং ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ দুটি ছবিতেই তিনি ছবি বিশ্বাসের বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন। দেবী ছবিতে তিনি হরিসুন্দরীর ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করলেন। কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবিতে লাবণ্যের অভিনয়ের দাপটটুকুও তিনি দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন।

আরও পড়ুন-এমপি কাপে শেষ চারে মল্লিকপুর ও হরিণডাঙা

মৃণাল সেনের ‘ইন্টারভিউ’
ইন্টারভিউ ছবির নায়ক রঞ্জু (যে ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন রঞ্জিত মল্লিক) সেখানে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় রঞ্জুর বিধবা মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ইন্টারভিউ দিতে যাওয়া নায়কের স্যুট ট্রামে চুরি হয়ে যাওয়ার জন্য মায়ের কথামতো ধুতি-পাঞ্জাবি পরে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলেন ছবির নায়ক।
ঋত্বিক ঘটকের অসমাপ্ত ছবি ‘কত অজানারে’, শংকরের লেখা কত অজানারে উপন্যাসের চিত্ররূপ দিতে এগিয়ে এলেন ঋত্বিক ঘটক। সে ছবিতে করুণা লেডি ডাক্তারের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। মাত্র চারদিন কাজ করেছিলেন। করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝেছিলেন কী অসাধারণ কাজ হতে চলেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছবিটি সম্পূর্ণ হল না। প্রযোজকের সঙ্গে পরিচালকের মতান্তরের কারণে ওই ‘কত অজানারে’ ছবিটির শ্যুটিং বন্ধ হয়ে যায়।

আরও পড়ুন-নন্দীগ্রামে বিরোধীরা ধূলিসাৎ, ১২-০-তে জয় সমবায় ভোটে, মাটি সরে যেতেই দলবদলুদের গুন্ডামির চেষ্টা

অন্যান্য ছবিতে তাঁর অভিনয়
নরেন্দ্রনাথ মিত্রের কাহিনি অবলম্বনে অগ্রগামী যখন ‘হেডমাস্টার’ ছবিটি তৈরি করছেন তখন হেডমাস্টারের ভূমিকায় ছিলেন ছবি বিশ্বাস। তাঁর স্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়। অগ্রদূত পরিচালিত ‘উত্তরায়ণ’ ছবিতেও তিনি অভিনয় করেছিলেন। শম্ভু মিত্র ও অমিত মৈত্রের যুগ্ম-পরিচালনায় তৈরি হয়েছিল ‘শুভবিবাহ’ ছবিটি। সেখানেও তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। পীযূষ দেবনাথের পরিচালনায় তিনি অভিনয় করলেন ‘নয়া মিছিল’ ছবিতে। আরও দুটি স্মরণীয় ছবিতে অভিনয় করলেন করুণা। ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত ‘অন্ত্যেষ্টি’ এবং ভবেন্দ্রনাথ সাইকিয়া পরিচালিত ‘সন্ধ্যারাগ’ ছবিটিতে তিনি অভিনয় করেছিলেন।

আরও পড়ুন-মেঘালয়ে বিপ্লব, উই কার্ডে ৯ দিনে নাম ৬০ হাজারের

পুরস্কার প্রাপ্তি
উল্টোরথ পত্রিকা যখন নিয়মিত পুরস্কার প্রদান করত ফিল্মফেয়ার-এর মতো তখন ১৯৫৫ সালে শ্রেষ্ঠ সহ-অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছিলেন করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই উল্টোরথ পত্রিকার পুরস্কার ‘পথের পাঁচালী’ ছবির জন্য। ১৯৫৯ সালে দ্বাদশ ব্রিটিশ আকাদেমি অব ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন অ্যাওয়ার্ড (সংক্ষেপে বাফতা) দেওয়ার জন্য যে ৬ জন বিদেশি অভিনেত্রীকে বেছেছিলেন তাঁদের মধ্যে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন। অন্যান্য শিল্পীরা হলেন ইনগ্রিড বার্গম্যান, আনা ম্যাগনানি, তাতিয়ানা সামজলোভা, জোয়ানে উডওয়ার্ড, গুইলেনা মাসিনা। লেখালেখির প্রতি তাঁর ছিল অদম্য আকর্ষণ। ১৯৪২ সালের ‘অরণী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম ছোট-গল্প ‘লক্ষ্যভেদ’। তাঁর লেখা মোট গল্পের সংখ্যা পনেরো। অনুবাদ করেছেন তিনটি।
২০০১ সালের ১২ নভেম্বর ৮২ বছর বয়সে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় পরলোক গমন করেন। তাঁর মৃত্যুতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল তা আজও পূরণ হয়নি।

Latest article