মূল্যবৃদ্ধি হবে, হবেই

এ এক অনিবার্য আগামী। বাজারে দাম চড়ছে। আগামীতে আরও চড়বে। এই প্রায় বেলাগাম ঊর্ধ্বগমনে রাশ পরানোর হিম্মৎ মোদি সরকারের নেই। সহজ সত্যিটাকে তুলে ধরছেন আকসা আসিফ

Must read

পাইকারি মূল্যসূচক প্রায় এক বছর ধরে দু’অঙ্কে দাঁড়িয়ে, এখন তো প্রায় ১৪.৫ শতাংশ। এহ বাহ্য ! এই মূল্যসূচক আরও, আরও বাড়বে, বাড়বেই। অবশ্যম্ভাবী ফল হল : মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে, অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ব্যাহত হবে, শেয়ার বাজারে তার ছাপ পড়বে, সুদের হার বাড়বে, ফলে বাড়ির বাজার, দীর্ঘস্থায়ী ভোগ্যপণ্য এবং পুনর্নবীকরণ সম্ভব এরকম শক্তি ক্ষেত্রে তার ফলাফল বিশ্রীভাবে টের পাওয়া যাবে। আর ব্যাঙ্কগুলো ভাববে, পুরনো হিসেব শিকেয় তুলে তারা নতুন ঋণ বাজারে ছাড়তে পারে। তার অনিবার্য প্রভাবে ঋণখেলাপির হার নতুন করে বৃদ্ধি পাবে।

কয়েক মাস আগেও পাইকারি মূল্যসূচক দাঁড়িয়ে ছিল ১২ শতাংশে আর ভোগ্যপণ্যের মূল্যসূচক দাঁড়িয়ে ছিল ৬ শতাংশে। তখন অনেকেই ভেবেছিলেন ও দুটো আর বাড়বে না। তা তো হলই না। উলটে বিশ্ববাজারে এমন একটা উৎকট পরিস্থিতির উদ্ভব হল যে ওই দুটো সূচকই চোঁ-চোঁ করে বেড়েছে।

স্মর্তব্য, মার্কিনমুলুকে মুদ্রাস্ফীতির হার ৮.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ইউরোপের বাজারে তা ৭.৫ শতাংশ। অথচ, আমেরিকা আর ইউরোপ, উভয়েই ভেবেছিল ২ শতাংশের আশেপাশে মুদ্রাস্ফীতির হার আটকে রাখা যাবে। কিন্তু সে আশা দুরাশায় পরিণত হয়েছে। ২০২১-এর শেষ পাদে তেলের দাম ব্যারেল-পিছু ৯০ ডলারের বেশি হল। খাবারদাবার আর ধাতুনির্মিত সামগ্রীর দাম দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেল। চিনের ওপর আমেরিকা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করায় অবস্থা আরও খারাপ হল।

এসব সত্ত্বেও নির্মলা সীতারমণের মতো অতিবোদ্ধারা আশা করেছিলেন, ২০২১-এ যাই-ই হোক, ২০২২-এ ভোগ্যপণ্যের দাম কমবে। নির্মলাদেবী ফেব্রুয়ারিতে যে বাজেট পেশ করলেন তাতে ধরা হল তেলের দাম ব্যারেল-পিছু বড়জোর ৭৫ ডলারে দাঁড়াবে ২০২২-’২৩ অর্থবর্ষে।

কিন্তু সেসব আশাবাদী ভাবনার কাঁথায় অগ্নিসংযোগ করে যুদ্ধ বাধল ইউক্রেনের বুকে। যুদ্ধে ব্যাহত হল সমুদ্রপথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। বিশ্বব্যাপী কৃষিজাত সামগ্রীর রফতানি মার খেল ব্যাপকভাবে।

তখনও অনেকে খোয়াব দেখলেন, অচিরেই যুদ্ধ বন্ধ হবে আর সেই সঙ্গে দাম হবে নিম্নমুখী। কিন্তু বাস্তবে যা হল তা পুরোপুরি অন্যরকম। যুদ্ধ কবে যে থামবে তা কারও জানা নেই। যুদ্ধ থামলেও রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘদিন জারি থাকবে। যুদ্ধে ইউক্রেনের ফসল উৎপাদন মার খেয়েছে। অতএব আন্তর্জাতিক বাজারে গম, ভুট্টা আর সূর্যমুখী তেলের জোগানে টান পড়বেই পড়বে।

এর প্রত্যক্ষ ফল যে আমাদের রান্নাঘরগুলোতে পড়বে তা একরকম পরিষ্কার। ইতিমধ্যে সংবাদমাধ্যমে এই খবর একেবারে প্রথম পাতায় জায়গা করে নিয়েছে যে, গৃহস্থের চিন্তা বাড়িয়ে আরও দামি হবে ভোজ্যতেল। এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন সলভেন্ট এক্সট্র্যাকটরস অ্যাসোসিয়েশন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

খনিজ তেলের দাম ব্যারেল-পিছু ১৩০ ডলার থেকে কমে ১০৬ ডলারে দাঁড়িয়েছে এটা যেমন সত্যি, তেমনই এটাও সত্যি যে, যুদ্ধ যদি চলতেই থাকে তবে এই দাম ফের ১৩০ ডলারে পৌঁছে যাবে।

কিন্তু মুশকিলটা হল এই নয়া জমানায়, যখন অন্ধরাই বেশি বেশি দেখে, তখন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মতো সংস্থাও ধৃতরাষ্ট্র সরকারের অনুগামী গান্ধারীর ভূমিকা পালনে তৎপর। শীর্ষ ব্যাঙ্ক বুঝেও বুঝতে চাইছে না। আন্তর্জাতিক অর্থনীতি এখন নয়া কোনড্রাটিয়েক চক্রের খপ্পরে পড়ে গিয়েছে।
চক্রটির এহেন নামকরণ রুশ অর্থনীতিবিদ নিকোলাই কোনড্রাটিয়েকের নামানুসারে। প্রযুক্তিগত পরিবর্তন গভীর হলে এই চক্র দেখা দেয় এবং এর স্থায়িত্বও সাধারণ বাণিজ্য চক্রের তুলনায় অনেকটাই বেশি।

কোনড্রাটিয়েক চক্র আদৌ দেখা দেয় কিনা কিংবা এই চক্র দেখা দেওয়ার সম্ভাব্য কারণসমূহ কী হতে পারে, তা নিয়ে অর্থনীতিবিদগণ কোনও ঐকমত্যে উপনীত হতে পারেননি। তবে এটা ঠিক যে, সত্যি সত্যি যদি নয়া কোনড্রাটিয়েক চক্র চালু হয় তবে ভোগ্যপণ্যের দাম কিন্তু অনেকদিন ধরে বাড়তেই থাকবে। মুদ্রাস্ফীতিকে সস্তার চাবুক মেরে পুরোনো দশায় ফেরত আনাটা অত সহজ হবে না।

লক্ষণীয়— তেল, তুলা, ইস্পাত, কয়লা, গম, পলিয়েস্টার এবং কমলালেবুর রসের মধ্যে, এগুলোর উৎপাদন ও মূল্যের ক্ষেত্রে, আপাতভাবে কোনও পারস্পরিক সম্পর্ক নেই। অথচ এগুলোর উৎপাদন যুগপৎ হ্রাস পাচ্ছে এবং এগুলোর দাম একসঙ্গে বেড়েই চলেছে। এ-ধরনের উৎকট চক্রের খপ্পরে অর্থনীতি বা বিশ্ববাজার আগে কখনও পড়েছে বলে মনে হয় না।

তেল আর কয়লা উৎপাদনকারী সংস্থাগুলো পরিবেশ সচেতনতার প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে বেশ কয়েক বছর বিনিয়োগে রাশ টেনেছে। নয়া খনি খোঁজা ও সেখান থেকে খনিজসামগ্রী উত্তোলনের পেছনে কাঁড়ি কাঁড়ি খরচে কিছুটা হলেও লাগাম পড়েছে। উৎপাদন বৃদ্ধিকে একমাত্র লক্ষ্য নির্ধারিত করে জিনগতভাবে উন্নত ফসলের ফলনেও এখন আর তেমন হুটোপাটি দেখা যাচ্ছে না। বিশ্ববাজার থেকে পণ্য আমদানি করে ভোক্তার চাহিদা মেটানোর পরিবর্তে ফের স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত দ্রব্যে চাহিদা মেটানোর বিশেষ আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। এ-সবের ফলেও কিন্তু বিশ্ববাজারে জোগানে টান পড়বে, পড়বেই।
আর তার ফলে মুদ্রাস্ফীতিতে অদূর আগামীতে লাগাম পড়বে, এমন সম্ভাবনা কিন্তু অতি-কম। কেন্দ্রীয় সরকার যদি সতর্ক হয়ে অবিলম্বে উপযুক্ত ব্যবস্থা না নেয়, তবে অধিকতর ‘বুরা দিন’-এর আগমন অবিলম্বে অবশ্যম্ভাবী।

Latest article