দুই সখী শকুন্তলাকে নিয়ে তপোবনের ছোট ছোট গাছগুলিতে জল দিতে এসেছিলেন। আর আমাদের প্রাচীন নায়িকা-রমণীরা স্বভাবতই বড় পেলব, আর দেহতত্ত্বে বড়ই ভঙ্গুর, হাঁটেন গজগমনে, কথা যত বলেন, বোঝান তার চাইতে বেশি। নাটকের সারা প্রথম অঙ্ক জুড়ে শকুন্তলা তাঁর প্রথম-দেখা নায়ক-পুরুষের সঙ্গে একটা কথাও বললেন না, অথচ প্রথমাঙ্কের শেষেই আমরা বুঝলাম— এই দুজনের প্রেম হয়ে গেল! বস্তুত প্রেম এখানে বড়ই পরনির্ভর— প্রথমে সখী-নির্ভর, তারপর রাজ-নির্ভর। নায়িকাদের এমনই মহতী অবস্থা যে, গালের ওপর খুচরো চুল এসে পড়লেও তা সরিয়ে দেবার জন্য সখীকুলের ডাক পড়ে— অভিসারের সময় মালাগাছিও তাঁর গলায় পরিয়ে দিতে হয় অন্যা রমণীকে, তাঁরা নিজে কিছু করতে পারেন না—
দে লো সখী দে পরাইয়ে গলে,
সাধের বকুলফুলহার।
আধফোটা জুঁইগুলি যতনে আনিয়া তুলি,
গাঁথি গাঁথি সাজায়ে দে মোরে
করবী ভরিয়ে ফুলভার।
তুলে দে লো চঞ্চল কুন্তল
কপোলে পড়িছে বারেবার।
আরও পড়ুন-আদানির সঙ্গে ব্লক চুক্তি
ঠিক এই চরিত্রের এক অকর্মণ্যা, অথচ চরম-মধুর ব্যঞ্জনায় স্ফুটাস্ফুট শরীর-লাবণ্যে শকুন্তলার হাত ধরে দুই সখী অনসূয়া-প্রিয়ংবদা গাছে জল দিতে এসেছিলেন। ঠিক তখনই নবমালিকা ফুলের লতানে গাছটির ওপর নজর পড়ে প্রিয়ংবদার। এর আগে বকুলগাছ নিয়ে খানিক কথা হয়েছে তিন সখীতে। মনে তো রাখতেই হবে যে এই তপোবনের পরিবেশে এবং মানসিকতায় গাছগাছালিও এক বড় ভূমিকায়। সদ্যযৌবনবতী এই তিন সখীর কৌতূহলের অন্যতম জায়গা হল কোথায় কোন্ লতা জড়িয়ে উঠেছে। প্রথমেই এক বকুল গাছের পাতায় শিরশিরানি দেখে শকুন্তলা ভাবলেন বুঝি পাতার আঙুল নাড়িয়ে বকুল গাছ ডাকছে বুঝি তাঁকে। কিন্তু একটু এগোতেই প্রিয়ংবদা সখী শকুন্তলাকে বললেন— আরে! দাঁড়াও দাঁড়াও, তুমি এই এলে ওর কাছে আর এখনই দেখছি এই বকুলগাছ যেন তার ঈপ্সিত লতা-নায়িকাটিকে পেয়ে গেছে— ত্বয়া উপগতয়া লতা-সনাথ ইব অয়ং কেশর-বৃক্ষকঃ প্রতিভাতি।
আমরা শুধু বলতে চাইছি পুষ্পিণী লতার সঙ্গে রমণী-শরীরের তুলনা করাটা প্রাচীন কবিদের একটা অন্যতম কল্প। কিন্তু একই সঙ্গে কবি প্রিয়ংবদার মুখ দিয়ে শকুন্তলাকে একাত্ম করে দিলেন বনজ্যোৎস্না নবমালিকার সঙ্গে এবং সকৌতুকে বললেন— শকুন্তলা বনজ্যোৎস্নাকে এত করে দেখছে এই জন্যই যে, এই লতাগাছি যেমন, আঁকড়ে ধরবার মতো উপযুক্ত একটা গাছ পেয়েছে তেমনই শকুন্তলাও নিজের অনুরূপ একটা বর পাবে, সেইজন্যই এই লতাগাছিকে এত দেখা। সত্যি বলতে কী, লতার মতো অনন্ত বনিতাকুলের এই আলম্বন বিভাব নান্দনিক রসশাস্ত্রগুলির বিষয় হতে পারে— কেননা, নাট্যশাস্ত্রে নায়ক এবং নায়িকা যেমন নাটকের আলম্বন, তেমনই তাঁরা নিজেরাও পরস্পরের আলম্বন, কিন্তু আজকের এই উদোম স্বাধীনতার দিনে কোনও রমণী লতাগাছির মতো প্রেমিক কিংবা স্বামীকে অবলম্বন হিসেবে আঁকড়ে ধরছেন— ‘ইহা অতি অশ্রদ্ধেয় কথা’।
আরও পড়ুন-ক্যাগের সতর্কবার্তা, ঋণের ফাঁদে জর্জরিত গুজরাত
আরও সমস্যায় পড়েছি এতকালের চর্চিত প্রেম-নামক বায়বীয় বস্তুটির অন্তর্গত স্বভাব নিয়ে। সেখানে অখিল রমণীকুলের হৃদয়-বিশ্রান্তির মধ্যে যে স্বতঃসিদ্ধ অবলম্বন-মানস যৌবনাবধি নিহিত থাকে, সেটা যে বস্তুত আলম্বনী-বৃত্তিহীন এক আত্মমেহন-মাত্র, এ-ব্যাপারে আমার কোনও ধারণা ছিল না। এটা হতেই যে আমার শরীরের মতো আমার মনও প্রাচীন হয়ে উঠেছে, তাতে আধুনিক যুক্তিগুলি তেমন করে বুঝতে পারছি না। কিন্তু মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, তাঁদের সত্তা-সম্বন্ধে নিত্য এবং নৈমিত্তিক শ্রদ্ধাবোধের অংশ বাদ দিলে শরীর, মন, অন্তর্বৃত্তি এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে মেয়েদের স্ব-ভাষিত নিরালম্ব ভাবটুকু আমি এতটাই গুলিয়ে ফেলি যে, আমাকে অকথ্যভাবে প্রাচীন বানিয়ে তোলে। কথাটা আমি বলেও ফেলেছিলাম একটা সেমিনারে।
আরও পড়ুন-রসরাজ
সেটা মেয়েদের ওপরেই একটা সেমিনার— প্যার্টিয়ার্কি, উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট— এমনই একটা বিষয় ছিল বোধহয়। সেখানে শুনতে এসেছেন যাঁরা তাঁরা সকলেই স্ত্রীলোক— ছাত্রী থেকে শিক্ষিকা— কৈশোরগন্ধী যুবতী ছাত্রী থেকে যুবতী, প্রৌঢ়া, অবসরমুখী শিক্ষিকারা। বক্তাদের তালিকায় মান্যা এবং গণ্যা মহিলারা ছাড়াও একটিমাত্র পুরুষ এবং আমি— সর্বশেষ বক্তা। মান্যারা বলছিলেন— তাঁদের অবরুব্ধ ক্ষোভ, পৌরুষেয়তার বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ এবং নারীর জীবন-যন্ত্রণা। চৈতন্যচরিতামৃতের ভাষায় ‘সেই হয় অকথ্য-কথন’। পুরুষ মানুষ যে কত খারাপ হতে পারে তার নারকীয় উচ্চারণ শুনে আমার প্রতিপদেই মনে হচ্ছিল যে, এই বিদ্বৎসভায় আমার কোনও বক্তৃতা দেবার যোগ্যতাই নেই। পুরুষের জঘন্য দৃষ্টিপাত থেকে আরম্ভ করে তার প্রবৃত্ত, objectification, comodification, সব এমন রমণীয় পক্ষপাতে এমন কঠিন ভাবে উচ্চারিত হল যাতে একটা আশা রইল যে, সেই পুরুষ বক্তাটি এর বিরুদ্ধে কিছু অন্তত বলবেন। আমার ঠিক আগেই তিনি বলতে উঠলেন। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম— পুরুষ-বিরোধিতায় তিনি মহিলা অধ্যাপিকাদের চেয়েও দশ গুণ বেশি। তিনি আরও ঝাঁঝালো ভাষায় অগণিত কঠিন মুখভঙ্গিতে, পৌনঃপুনিক হস্ত-সঞ্চালনে সভাগৃহকে একেবারে আন্দোলিত করে ফেলার চেষ্টা করলেন।
আরও পড়ুন-বিশ্বভারতীর উপাচার্য এখন রাজনৈতিক নেতার ভূমিকায়
কিন্তু মহিলা শ্রোতাদের মধ্যে আমি কোনও তরঙ্গ দেখলাম না। যখন মহিলারা বলছিলেন, তখন থেকেই এঁদের প্রতিক্রিয়ার মধ্যে পুরুষ-সমাজের বিরুদ্ধে সার্বিকভাবে চেতিয়ে ওঠার কোনও লক্ষণই দেখলাম না, আমার পার্শ্ববর্তিনী এক মহিলা বক্তাকে সেটা একটু জানাতেই তিনি বললেন— এরা কিছুই বোঝে না। এরা দুপুরবেলা কলেজে এসে কতগুলো আকাট ছাত্রীকে পড়াবে, আর বাড়ি ফিরে গিয়ে গুণধর স্বামীকে ফুলকো লুচি খাওয়ানোর জন্য ময়দা ঠাসবে। আমি খুব চাপা গলায় তাঁকে বললাম— আপনি বোধহয় ফুলকো লুচিও পছন্দ করেন না এবং গুণধর স্বামীও পছন্দ করেন না। তিনি বললেন— না, না আমি সেই অর্থে গুণধর বলিনি। আসল সেও চাকরি করে, তুইও চাকরি করিস। তাহলে তুই বাড়ি গিয়ে ময়দা ঠাসবি কেন? তোর স্বামীকে বল না ময়দা ঠাসতে। আমি বললাম— তাহলে ফুলকো লুচিটার কী হবে? কঠিনহৃদয়া অধ্যাপিকা বললেন— অই-তো! আপনারা সব বাইরে মোষ চরিয়ে এসে বাড়িতে ফুলকো লুচি খাবেন, আর আপনার বউ সারা দিন পরিশ্রম করে এসে ময়দা ঠাসবে, অমন লুচি আপনারা মুখে তোলেন কী করে? আর মশাই! আমি আপনাকে বলছি কেন? সমস্ত পুরুষ মানুষরাই এইরকম। মেয়েরা ময়দা ঠাসছে আর আপনারা দিন-রাত মেয়েদের ঠেসে বেড়াচ্ছেন, এমনকী যে কোনও অসুবিধে হলেই ঠেস দিতেও ছাড়ছেন না।
আরও পড়ুন-ফের আন্তর্জাতিক পুরস্কার রাজ্যের বার্লিনে ৮ মার্চ
সভায় তখন সেই একমাত্রিক পুরুষটির আগুনে-বক্তৃতা চলছে। সামনের শ্রোতৃবর্গ ‘সেমিনার’-এর যান্ত্রিকতায় প্রহর গুনছেন। আমারও অত আগুনেপনা ভাল লাগছে না। আমি সেই পার্শ্ববর্তিনীর কাছে বরং একটা সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করে বললাম— দেখুন, ঠাসাঠাসির মধ্যে একটা গভীর পারস্পরিকতা আছে এমনকী ঠেসাঠেসি অর্থাৎ ঠেস দিয়ে কথা বলার মধ্যেও একটা মজা আছে কিন্তু। এই যে আমরা ভিড় বাসে ঠাসাঠাসি করে যাই, এখানে পরস্পরের সহায় না হলে…। কথাটা পড়তে পেল না, মহিলা বললেন— ঠাসাঠাসির মধ্যে পারস্পরিকতা? তাই না? ভিড় বাসে ঠাসাঠাসি হলে মেয়েদের কী অবস্থা হয় জানেন না? ছেলেরা সেখানে। আমি মনে মনে বললাম— ন্যাপলা! আর নামিস না। মহিলা-মহোদয়াকে বললাম— আমি ওই বাসের ঠাসাঠাসির কথা বলিনি, আপন লেডিস সিটের সামনে দাঁড়ানোর জায়গাটা নিয়েই ভাবছেন শুধু, বাসের আরও একটা বিস্তীর্ণ স্থান আছে, যেখানে সমস্ত পুরুষেরা ঠাসাঠাসি করে গন্তব্যস্থলে যায়। আর আপনাকে এটাও জানিয়ে রাখি— আমি বহুকাল ট্রেনে যাতায়াত করেছি। সেখানে অফিসযাত্রী বেশিরভাগ মহিলারা লেডিজ কম্পার্টমেন্টে ওঠেন না। তাঁরা বলেন— সেখানে নিত্যদিন এত চেঁচামেচি, এত ঝগড়া এবং এত অসহযোগিতা যে, সহ্য করা যায় না। সেখানে পুরুষদের নয়, জেনারেল কম্পার্টমেন্টে মাঝে মাঝে পুরুষদের একটু-আধটু এটা-ওটা অসভ্যতা থাকে বটে, কিন্তু সহায়তার জায়গা সেখানে অনেক বেশি।
আরও পড়ুন-ঘুষ নিতে গিয়ে ৪০ লক্ষ সমেত গ্রেফতার, বিজেপি বিধায়ক-পুত্রের বাড়িতে রাশি-রাশি টাকা
এক মহিলা এমনও বলেছিলেন যে, অফিস-টাইমে ট্রেনে ওঠার সময় কতবার যে গেটে-দাঁড়ানো ঝুলন্ত পুরুষেরা প্রায় পাঁজাকোলা করে ট্রেনের ভিতরে তুলে নিয়েছেন, তার জন্য পুরুষ-জাতির অন্যকৃত অপরাধও যেন ক্ষমা করে দেওয়া যায়।
অধ্যাপিকা মহিলা অত্যন্ত অপছন্দের সঙ্গেও আমার মত মেনে নিলেন না। ওদিকে আমরাও বক্তৃতার সময় হয়ে আসছিল। বিশেষত এই অধ্যাপিকাকে আর কিছু বোঝানোর চেষ্টা না করে এটাই আমি বিশ্লেষণ করে দেখলাম যে, মেয়েদের ‘এমপাওয়ারমেন্ট’-এর ব্যাখ্যান-বৈচিত্র্যের মধ্যে একাংশের মানসিকতা কিন্তু এইরকমই যেখানে একটা ফুলকো লুচি কিংবা ভিড়ে ঠাসাঠাসির মতো যে কোনও কথাই হোক না কেন, সেই শব্দ চয়ন করেই একটা পুরুষ-বিরোধিতার প্রকরণ তৈরি করা যায়। কেননা শব্দ এখানে উপলক্ষ মাত্র, যে কোনও শব্দই এঁরা পুরুষের বিরোধিতায় পর্যবসিত করতে পারেন।
আরও পড়ুন-সূর্যর স্ট্র্যাটেজি সভায় বিজেপির সহসভাপতি, ফের বাম-বিজেপি আঁতাঁত এল প্রকাশ্যে
পড়ন্ত বেলায় আমি বলতে উঠলাম, শ্রোত্রী মহিলারা কেউ কেউ সারা দিনের পৌরুষেয়তায় ক্লান্ত হয়ে ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছেন, তবু তখনও বসে আছেন অনেকে। আমি ঠাকুর স্মরণ করে বলতে উঠেই জানালাম— এতক্ষণ তো অনেক শুনলাম। আমি তো আবার রামায়ণ-মহাভারত ধুয়ে জল খাওয়াব। অতটা সহ্য হওয়ার আগে আমার একটা প্রশ্নের জবাব চাই আপনাদের কাছে। যদি সত্যি উত্তর দেন, তাহলে মহাভারতের দ্রৌপদীর কথা শোনাব, না হলে সারা দিন এত জ্ঞানের পর আমার এই মেঠো কথা না শুনলেও চলবে। বহু জায়গায় একই কথা বলে আমিও ক্লান্ত। তার থেকে শুধু প্রশ্নোত্তরীতেই এই পর্বটি শেষ হোক না। কিন্তু আমার প্রথম প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতেই হবে।
সমবেত মহিলারা— প্রবীণা এবং নবীনা—তাঁরা সসম্ভ্রমে বললেন— আপনার মহাভারত-কথা শুনব বলেই বসে আছি। আপনার প্রশ্নটা বলুন, উত্তর দিচ্ছি। আমি বললাম— এটা ঠিক প্রশ্ন নয়, এটা একটা ‘সিচুয়েশন’, এখানে কীভাবে রি-অ্যাক্ট করবেন আপনারা, সত্য বলুন। ধরা যাক আপনি রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন। আপনি যুবতী। হ্যাঁ, এখানে যে-সব ছাত্রী আছো, তারা—
যেমন আছ তেমনি এসো
আর কোরো না সাজ।
বেণী নাহয় এলিয়ে রবে,
সিঁথে নাহয় বাঁকা হবে,
নাই বা হল পত্রলেখায়
সকল কারুকাজ।
কাজেই তোমাদের নিয়ে চিন্তা নেই, কিন্তু যাঁরা এখানে প্রৌঢ়া আছেন, যাঁদের ‘দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রাণের অন্ধকারে হয়েছে হলুদ/হিজলের জানালায় আলো আর বুলবুলি করিয়াছে খেলা’— তবু এখনও এমন মৃত্যুর মতো চেহারা নয় আপনাদের। কিন্তু ভাবুন, সেইসব দিনের কথা, যেদিন আপনারা রাস্তা পার হয়ে গেলে ফুটপাতে জলতরঙ্গ বাজত।
আরও পড়ুন-অমর্ত্যের আধার কার্ড মুহূর্তে ভাইরাল
আমার এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি সলজ্জ প্রৌঢ়াদের সংকোচে, সলজ্জে আরও যেন অবহিত বসতে দেখলাম। বললাম, ভাবুন সেই সব দিনের কথা, যেদিন ‘ধরণী তরুণা’ ছিল আপনাদের কাছে। সেইসব দিনে আপনারাও কিন্তু এই ছাত্রীদের মতো— ওই মালবিকা কিংবা বৈশাখীর মতো পথ হাঁটছিলেন আনমনে। কিন্তু ভাবুন একবার, আপনি পথ হাঁটছেন, কিন্তু আপনার সম-সমাজ রাষ্ট্রের ইচ্ছার মতো সৎ বিরোধী রাজনীতিবিদদের চরমতম বিরক্তি জাগায়, এতটাই সাধু ধরা যাক, ধরা যাক আপনার সময়ের পুরুষেরা। এই পুরুষেরা আমাদের অভীষ্টতম আদর্শে তৈরি, তারা মিথ্যা কথা বলে না, অপরকে তিরস্কার করে না, গুরুজনের কথা শোনামাত্র পালন করে, সমস্ত প্রকার স্ত্রীলোকের প্রতি তাঁদের মাতৃদৃষ্টি।
আরও পড়ুন-দুই কন্যার কথা
এই যে আপনি পথ হাঁটছেন বিধাতার আদি-সৃষ্টির গরিমায়, আমাদের শহরের সমস্ত উচ্চাবচ ঔদ্ধত্য আপনার শরীরে বহন করে এই যে আপনি পথ হাঁটছেন, সেখানে কোনও পুরুষ পথিক আপনার দিকে তাকাচ্ছে না। কোনও যুবক এতটুকু সশ্লেষ শব্দ করেনি, শিষ দেওয়া, পঞ্চমের কোনও সুর, অনর্থক কোনও অমহিম উচ্চারণ, কিচ্ছু নেই। আর ওই যে পাড়ার ছেলেগুলো এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে জটলা করে, তারা সভ্যতার কোন মন্ত্রগুণে— আপনি হাঁটছেন— এমনটা দেখামাত্রই মাথা নিচু করে ইষ্ট-নাম জপ করছে, সহমর্মী বন্ধুকে আপনার দিকে আশ্চর্য-দৃষ্টিপাত করতে দেখে, তাকে সে বলল— এসো করি শাস্ত্র আলোচনা। কবিরা যাকে কনক-কলসের সঙ্গে তুলনা করে মুগ্ধ হয়েছেন, সে দুটি বস্তুত বহুতর শিরা-গ্রন্থিতে বর্তুল দুটি মাংসপিণ্ড ছাড়া কিছু নয়— স্তনৌ মাংসগ্রন্থী কনক-কলশাবিত্যুপমিতৌ। তোমার এই মুগ্ধ দৃষ্টিপাত যেখানে নষ্ট করছ, সেই দৃষ্টি তুমি ভগবদ-বিগ্রহ দর্শনে নিযুক্ত করো— শ্রুতিং চকারাচ্যুতসৎকথোদয়ে/ মুকুন্দলিঙ্গালয়-দর্শনে দৃশৌ।
আরও পড়ুন-‘সাহিত্য জগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি’, ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ মুখ্যমন্ত্রীর
আমার প্রশ্ন— এই মহতী বিদ্বৎসভার সমস্ত যুবতী-রমণীর প্রতি প্রশ্ন। এই প্রৌঢ়াকুলের পূর্বভাবিত তরুণী-স্বভাবের কাছে প্রশ্ন— আপনি রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন, তা সত্ত্বেও এই নিষ্ক্রিয়, নিস্তরঙ্গ, অনবদ্য, সাধুপুরুষ-সমাজের মধ্যে দিয়ে চলাফেরাটাই আপনারা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করবেন কিনা? আমি সারাদিন ধরে যে বক্তৃতা শুনেছি, তাতে বোঝা যায় যে এইরকমই একটা সাধুসমাজই আপনাদের নিতান্ত কাম্য হওয়া উচিত। আমার কথা শুনে সমবেত আবালিকা প্রৌঢ়রা একেবারে রে-রে করে উঠলেন। বললেন— না না, এইরকমটা আমরা চাই না। এত সাধু চাই না আমাদের। আমি প্রায় যুদ্ধজয়ের তৃপ্তিতে বললাম— তাহলে? এতটা জয়ীভাব অবশ্য বিদুষী রমণীরা পছন্দ করলেন না। বিশেষত সকাল থেকে যে বিরাট স্বাধীনতাসংগ্রাম চলেছে, যার মধ্যে পৌরুষেয়তার বিচিত্র অন্যায়গুলি সত্য বলেই প্রতিভাত ছিল বহুলাংশে, সেইখানে আমার প্রশ্নটা তাঁদের সাময়িক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে ফেলে দিল। তাঁরা সেই দোটানা নিয়েই বললেন যে, হ্যাঁ, সমাজটা কখনও এমন হতে পারে না যেখানে সমস্ত পুরুষ মানুষই খারাপ, তবে পুরুষের মধ্যে বিচিত্র কৌশলে নারী-নির্যাতনের ঘটনাও কিছু কম নয়। আগে যাঁরা বলে গেলেন, যে কোনও কারণেই হোক তাঁরা পুরুষদ্বেষী হয়ে পড়েছেন। আমরা পুরুষদ্বেষী নই, কিন্তু জীবনের বহুল ক্ষেত্রেই পুরুষদের আরও অনেক সংযত হবার প্রয়োজন আছে।
আমি বললাম— আপনারা ঠিক কথা বলছেন একেবারে।
আরও পড়ুন-অলিম্পিক সোনায় চোখ জকোভিচের
সুযোগ এসে গেলেই সকলে অতিমাত্রায় চড়ে যায়। এই পুরুষদ্বেষিতা যেমন চড়া সুরে বাঁধা, তেমনই পুরুষ বলেই তাঁদের অসংযমের কোনও মাত্রা নেই, আর— মেয়েরাও সেইরকম— তাঁদের অসুন্দর এবং অনাকর্ষণীয় হয়ে ওঠার সামান্যতম কোনও চিহ্ন নেই। আমি বললাম, এ এক অনিবার্য পরিস্থিতি, কারও রেহাই নেই এখানে। বিধির বিধান এমনই স্বতঃসিদ্ধ যে, ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’ হয়েই আছে মেয়েরা, নইলে দেখুন, রবীন্দ্রনাথ তো রাস্তায় দাঁডিয়ে মেয়েদের ‘উরি উরি, উরি বাবা’ বলতে পারেন না, কিন্তু তিনি এটা বুঝেছেন যে পুরুষ মানুষ মেয়েদের দেখে নানা শংসা করবে, এমনকী মেয়েরা সেটা আশাও করবে। তা নইলে অমন কাকুতি করে দেবযানী বলতেন না
যদি সখা, হেথা কেহ গেয়ে থাকে গান
চিত্তে যাহা দিয়েছিল সুখ, পরিধান
করে থাকে কোনওদিন হেন বস্ত্রখানি
যাহা দেখে মনে তব প্রশংসার বাণী
জেগেছিল ভেবেছিলে প্রসন্ন-অন্তর
তৃপ্ত চোখে আজি এরে দেখায় সুন্দর,
সেই কথা মনে কোরো অবসরক্ষণে
সুখস্বর্গ-ধামে।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিজনোচিত বেদনাবোধে এক রমণীর পরম ঈপ্সিত সৌজন্যবোধ যেভাবে দেখিয়েছেন— আজি এরে দেখায় সুন্দর, এই পরিমিত সৌন্দর্য-চেতনা সাধারণ আমার মতো পুরুষের কাছেই আশা করা যায় না। যার জন্য বৃহস্পতি-সূত কচকে বলতে হয়েছে—
আর যাহা আছে তাহা প্রকাশের নয়
সখী। বহে যাহা মর্মমাঝে রক্তময়
বাহিরে তা কেমনে দেখাব।
আরও পড়ুন-জেএনইউ চত্বরে ধরনা দিলেই দিতে হবে ২০ হাজার টাকা জরিমানা
সাধারণ্যে যেটা ‘মর্মমাঝে রক্তময়’ সেটা সে প্রকাশ করে ফেলে, কেননা তার রাবীন্দ্রিক সৌজন্যবোধ এবং সৌন্দর্য-তাত্ত্বিক দায় নেই। সবচেয়ে বড় কথা সেই বিদ্যা, সেই রমণীর হৃদয়-বোধ অথবা সেই পরিশীলন-বোধই কি জনে জনে থাকা সম্ভব, যাতে সমস্ত উচ্ছ্বাস যা প্রাথমিকভাবে শারীরিক মাত্রা নেয়। এমনকী বেশ শরীর-শরীর শব্দেই রবীন্দ্রনাথ থেকে আমরা শত উদাহরণ দিতে পারি, যেখানে অদ্ভুত সেই রাবীন্দ্রিক সৌজন্যের মধ্যেও রমণীশরীরের প্রত্যঙ্গ-প্রশংসা বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর আছেন যেমন মহান কবিরাও যাঁরা সাধারণ্যের মাত্রা ব্যবহার করেও, যদিও সেটা কোনওভাবেই ফুটপাতের আমিষগন্ধী শব্দরাশির কাছাকাছি যাবে না, কিন্তু খুব হালকা চালে, অতি-সুকৌশলে এও কি একটা প্রশংসার ভঙ্গি নয়— দুধ চিনি ননী আর/ ভাল যাহা দুনিয়ার/ তাই দিয়ে মেয়েগুলি তৈরী।
আরও পড়ুন-বিদেশিদের সঙ্গে খেলেই নতুনরা শিখবে : হরমন
আমরা প্রসঙ্গ থেকে সরে এসেছি, ভাবছেন তো? আসিনি। আমরা বলতে চেয়েছি— রমণীরা সাধারণত নিরালম্ব নন। সেই যৌবন-বয়সে পুরুষের স্বচ্ছাস্বচ্ছ দৃষ্টিপাত এবং স্পষ্টাস্পষ্ট প্রশংসা-শব্দে যাদের আত্মভোগ্যতা এবং আত্মারামতা তৈরি হয়, সেখানে ‘মাই বডি মাই চয়েস’ বলে আপনাতে আপনি অবরুদ্ধ হয়ে থাকলে কবিত্বের অহংকারটুকুই নষ্ট হয়ে যাবে যে ভদ্রলোক নিজের দায়িত্বে লিখেছিলেন— শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী/ পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি/ আপন অন্তর হতে— সেই কবির অহংকারটুকু নষ্ট করে দিলে আজকের দিনের পুরুষদ্বেষী রমণীকুলের বহুতরার মতো অনন্ত নারী-বিদ্বেষী পুরুষও তৈরি হবে। এখন আমার আত্ম-পরিজনের মধ্যে, আমার বর্ষে-বর্ষে আসা ছাত্রীদের মধ্যে বিবাহের প্রসঙ্গ এলেই বহুল সন্দেহ তৈরি হতে দেখেছি, বৈবাহিক জীবনে দেখছি চরম অসহনীয়তা, ৪৯৮ ধারা প্রযুক্ত হচ্ছে মুড়ি-মুড়কির মতো— অথচ পারস্পরিক নির্ভরতার মধ্যে যে নান্দনিক সংবাদ আছে, সেটা এখন সবচেয়ে বেশি অপব্যাখ্যাত এক তত্ত্ব, যা তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা আপন তর্কশান্তির জন্য করে থাকেন। এই বুদ্ধিজীবীরা যেমন হৃদয় নামক বস্তুটি এতটুকুও বোঝেন না। তেমনই আছেন কতগুলি মনস্তত্ত্ববিদ যাঁরা বাঁধা গতে ‘ইনসিকিওরিটি’ দিয়ে কথা আরম্ভ করেন এবং সরল জিনিসকে জটিল করে তোলার তত্ত্ব বোঝেন স্বাধীত মুখস্থ বিদ্যায়, কিন্তু মন বোঝেন সব চাইতে কম।
আরও পড়ুন-কেন্দ্রের প্রস্তাব নাকচ করে আদানিকাণ্ডে বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়ল সুপ্রিম কোর্ট
আসলে নির্ভরতার মধ্যে নন্দনের সংবাদ আছে, সেটা বোঝার জন্য অনেক বেশি আত্মশক্তির প্রয়োজন আছে, প্রয়োজন আছে আত্মত্যাগের, প্রয়োজন আছে আপন অহংবোধের ঊর্ধ্বে ওঠার। আসলে যে অহংবোধে পুরুষ নারীদের ওপর নির্যাতন চালায়, সেই অহংবোধেই কিন্তু রমণীরাও পুরুষ-বিদ্বেষী হয়ে উঠছেন। অথচ বিফল হয়ে গেল বৈদিক কালের কত আধুনিক সেই মন্ত্র, সংজাম্পত্যং সুষমম্ আকৃণুষ্ব। এখানে ‘জাম্পত্য’ মানে দাম্পত্য, সেই দাম্পত্য যেন গভীর পারস্পরিকতা এবং পরস্পর-নির্ভরতায় গড়ে ওঠে। সবচেয়ে বড় কথাটা এখানে ‘সুষমম্’— স্বামী-স্ত্রী দুই পক্ষেই সমান এক আপেক্ষিক নির্ভরতা— দুই পক্ষকেই সেখানে খানিক অহংবোধ জলাঞ্জলি দিতে হয়। নান্দনিকতা আছে সেইখানেই— যেখানে আপন স্বতন্ত্রতার মধ্যেও অপরের জন্য অপেক্ষা এবং অনুসন্ধান থাকে— আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না/এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা।