হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুয়ায়ী কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে পালিত হয় জগদ্ধাত্রীপুজো। শাক্ততন্ত্র, হিন্দুতন্ত্র বা বৌদ্ধতন্ত্র মতেও এই পুজোর উল্লেখ রয়েছে। মার্কণ্ডেয় পুরাণে দুর্গা ও জগদ্ধাত্রী একজন অভিন্ন দেবী হিসেবে পরিচিত। জগৎকে যিনি ধারণ করে আছেন তিনিই জগদ্ধাত্রী। জগদ্ধাত্রী চতুর্ভুজা। চার হাতে রয়েছে শঙ্খ, চক্র, ধনু ও বাণ। দেবী সিংহবাহিনী, রক্তাম্বরা, গাত্রবর্ণ উদিত সূর্যের আভার মতো। গলায় ঝুলছে নাগযজ্ঞোপবীত।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
শ্রীশ্রীচণ্ডীতে রয়েছে মহিষাসুর নানা রূপ ধারণ করে দুর্গাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। তেমনই একবার হাতির রূপ ধারণ করেছিল মহিষাসুর। তখন সেই হাতিকে বধ করতে উদ্যত হন দুর্গা। সেই উদ্দেশ্যে এক চতুর্ভুজা দেবীর স্বরূপে আবির্ভূত হন তিনি। চক্র দ্বারা সেই হাতির মুণ্ডচ্ছেদ করেন তিনি। দেবীর এই রূপটিই হল জগদ্ধাত্রী। তাই ধ্যানমন্ত্রে উল্লেখ না-থাকা সত্ত্বেও মূর্তিতত্ত্বে জগদ্ধাত্রীর বাহন সিংহ এক মৃত হাতির শরীরের উপর দাঁড়িয়ে। সংস্কৃতে হাতিটির নাম করী, তাই সেই অসুরের নাম করীন্দ্রাসুর। তাকে বধ করেন জগদ্ধাত্রী।
আরও পড়ুন-মিধিলির ল্যান্ডফল বাংলাদেশে, সামান্য বৃষ্টি বিভিন্ন জেলায়
পুরাণ অনুযায়ী মহিষাসুরের অত্যাচারে সকলে ত্রস্ত ও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। মহিষাসুরের হাত থেকে মুক্তির জন্য তাঁরা মা দুর্গার শরণে যান। তখন মহিষাসুর বধ করেন দেবী দুর্গা। ওই ঘটনার পর উল্লসিত হয়ে পড়েন দেবতারা। তাঁদের মধ্যে অহংবোধ জন্মায়, তাঁরা ভাবতে শুরু করেন যে দুর্গা আসলে তাঁদের শক্তির সম্মিলিত রূপ, একা তাঁর কোনও অস্তিত্ব নেই। দেবতাদের অহংকার ও গর্ব দেখে তাঁদের পরীক্ষা করেন দুর্গা। দেবতাদের উদ্দেশে একটি তৃণখণ্ড নিক্ষেপ করেন। বজ্র দিয়ে ইন্দ্র সেই তৃণটি ধ্বংস করতে পারেন না। আবার অগ্নিদেবের মায়া সেই তৃণকে পুড়িয়ে ফেলতে অক্ষম হয়। পবনদেব সেই তৃণ ওড়াতে অসফল হন।
আরও পড়ুন-ইডির হানা, ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার
বরুণদেব সেই তৃণের সামান্য অংশ জলে ভাসিয়ে দিতে পারেননি। তাঁরা বুঝতে পারেন এ কোনও রহস্য। এর পর দেবতাদের সামনে উপস্থিত হন দুর্গার সালঙ্করা, চতুর্ভুজা স্বরূপ জগদ্ধাত্রী। দেবতাদের বুঝিয়ে দেন যে তিনিই জগতের ধারিণী শক্তি। ইন্দ্রিয়কে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার জ্ঞান, অভিমান এবং অহংকার নাশের জ্ঞানপ্রাপ্ত হয় জগদ্ধাত্রীপুজোর মধ্যে দিয়ে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী যাঁরা নিজের ত্রুটি ও অহংকার সমাপ্ত করেছেন, তাঁদের হৃদয়ে জগদ্ধাত্রী বাস করেন।
আরও পড়ুন-ঐন্দ্রিলা স্মরণে
শান্তিপুরের জগদ্ধাত্রী
এখন জগদ্ধাত্রীপুজো বলতে সারা পৃথিবীর মানুষ চন্দননগরের পুজোকেই বোঝেন। কিন্তু এই পুজোর সূচনা হয়েছিল শান্তিপুরে। একটি গাছতলায়। শান্তিপুরের চন্দ্রচূড় তর্কমুনির কামরাঙা গাছতলায় পঞ্চমুণ্ডির আসনে প্রথম দেবী জগদ্ধাত্রীর পুজো হয়। আবার কারও কারও মতে, ১৭৬২ সালে নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন হয়। তবে সেটি নাকি ছিল শুধুমাত্র ঘটপুজো। প্রতিমা ছিল না সেখানে। আর সেই কারণেই উঠে আসে শান্তিপুরের নাম।
আরও পড়ুন-মনবীরের গোলে জিতল ভারত, ২০২৬ বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব
স্থানীয় ইতিহাস বলছে, শান্তিপুরের হরিপুর নিবাসী তন্ত্রসাধক চন্দ্রচূড়ের সাধনায় পাওয়া যায় দেবী জগদ্ধাত্রীর বর্ণনা। ১৮০২ সালে নদিয়ায় রাজত্ব ছিল রাজা গিরিশচন্দ্র রায়ের। শান্তিপুরের হরিপুরে তখন ১০৮ ঘর ব্রাহ্মণের বাস। তাঁদের মধ্যে থেকে চন্দ্রচূড়কে রাজা নিজেই অনুরোধ জানিয়েছিলেন রাজসভায় থাকার জন্য। সেই সময়ে ভোরবেলা প্রথমবার জগদ্ধাত্রীর মূর্তি গড়ে পঞ্চমুণ্ডির আসনে কামরাঙা গাছের নিচে পুজো করা হয়েছিল দেবীকে। কথিত আছে, তার পর থেকেই কৃষ্ণনগর, চন্দননগর এলাকায় জগদ্ধাত্রী পুজোর শুরু হয়।
আরও পড়ুন-জেসিবির ধাক্কায় মৃত কনস্টেবলের পরিবারের পাশে মুখ্যমন্ত্রী, আর্থিক সাহায্যের ঘোষণা
চন্দননগরের এই পুজোর সূচনা
কারও কারও মতে, কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র প্রথম জগদ্ধাত্রীপুজো শুরু করেছিলেন। কিংবদন্তি অনুসারে তখন নবাব আলিবর্দির রাজত্বকাল। সে-সময়ে একবার রাজার কাছ থেকে ১২ লক্ষ টাকা নজরানা দাবি করা হয়। নজরানা দিতে অপারগ হলে রাজাকে বন্দি করে মুর্শিদাবাদে (মতান্তরে মুঙ্গেরে) নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তির পর নদীপথে কৃষ্ণনগরে ফেরার সময় ঘাটে বিজয়াদশমীর বিসর্জনের বাজনা শুনে রাজা বুঝতে পারেন সেই বছরের মতো দুর্গাপুজো পেরিয়েছে। তখন রাজা খুব কষ্ট পান যে তিনি দুর্গাপুজো করতে পারলেন না। কিন্তু সেই রাতেই দুর্গা জগদ্ধাত্রীর রূপে রাজাকে দেখা দেন এবং বলেন, পরবর্তী শুক্লানবমী তিথিতে রাজা যেন তাঁর পুজোর আয়োজন করেন। এরপর ১৭৬৬ সালে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রীপুজোর শুরু। কেউ কেউ বলেন কৃষ্ণচন্দ্র নয়, কৃষ্ণচন্দ্রের প্রপৌত্র গিরিশচন্দ্রই কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রবর্তক।
এদিকে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দেখাদেখি ফরাসিদের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীও শুরু করলেন তৎকালীন ফরাসডাঙা বা অধুনা চন্দননগরে জগদ্ধাত্রীপুজো। তিনি চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টির নিচুপট্টিতে জগদ্ধাত্রীপুজোর সূচনা করেছিলেন।
আরও পড়ুন-পূর্ব ভারতের প্রথম যোগ ও নেচারোপ্যাথি হাসপাতাল, মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্পের পথচলা শুরু
ইন্দ্রনারায়ণ তৎকালীন চাউলপট্টির সাধারণ ব্যবসায়ী থেকে নিজের উপস্থিত বুদ্ধির জোরে ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান হন। এরপর বাংলাদেশের যশোরের ইন্দ্রনারায়ণ দেওয়ানি ছেড়ে মুর্শিদাবাদের নবাবের দরবারে হিসেবরক্ষকের কাজে যুক্ত হন। এই চাউলপট্টি থেকেই তিনি নিজের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। ফরাসিদের সঙ্গে দারুণ ওঠাবসা ছিল তাঁর। চাউলপট্টি ছিল সেকালের বাংলার শস্যভাণ্ডার। লক্ষ্মীগঞ্জের বাজারে ছিল ১১৪টি ধানের গোলা, যার এক-একটিতে ৬০০০ মন ধান রাখা হত। শুধুমাত্র ১৭৩০ সালেই ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মোট ব্যবসার পরিমাণ ছিল আড়াই মিলিয়ন পাউন্ড। ব্যবসার পাশাপাশি সমাজসেবার কাজেও থাকতেন ইন্দ্রনারায়ণ। তখন কৃষ্ণচন্দ্র ও ইন্দ্রনারায়ণ বন্ধু হয়ে ওঠেন। কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রীপুজো দেখে প্রভাবিত হন তাঁরা। অনুকরণেই চন্দননগরে তিনি এই পুজোর প্রবর্তন করেন।
আরও পড়ুন-ছত্তিশগড়ে চলছে শেষ দফার ভোট, ২৩০ কেন্দ্রে নির্বাচন হচ্ছে মধ্যপ্রদেশে
চন্দননগরে ইন্দ্রনারায়ণের বাড়িতেই সেই জগদ্ধাত্রী পুজো হত। চাউলপট্টির এই জগদ্ধাত্রীই আদি মা নামে সকলের কাছে পরিচিত। গঙ্গার তীরে শিবঘাটি ঘাটের পাশে, লক্ষ্মীগঞ্জবাজারের পিছনের দিকে স্থিত এই বাজারে চালের ব্যবসায়ীরাই পুজোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। এখানকার ব্যবসায়ীরা এই প্রাচীনতম পুজোটি করেন। চাউলপট্টি জগদ্ধাত্রীপুজোটি প্রায় ৩০০ বছরের বেশি পুরনো। আদি মায়ের পুজো অত্যন্ত নিষ্ঠা ও ভক্তিভরে করা হয়। ষষ্ঠীর দিন থেকে শাড়ি ও সোনা-রুপোর গয়না দিয়ে সাজানো হয় মাকে। এত জাগ্রত এই আদি মা যে বহু মানুষ মানত হিসেবে সোনা-রুপো দান করেন বছর বছর আর সেইগুলি মাকে পরিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হয়। সপ্তমীর দিনে সাতটি বিশাল মাপের থালায় নৈবেদ্য নিবেদন করা হয়। প্রসঙ্গত, সপ্তমী থেকে নবমী— প্রতিদিনই ছাগবলি, আখ, কুমড়ো বলি দেওয়ার রেওয়াজ সেই শুরু থেকে এখনও রয়েছে। এ ছাড়া অষ্টমীর দিন ১০৮টি রক্তপদ্ম নিবেদন করারও রীতি রয়েছে।
এরপরেই রয়েছে লক্ষ্মীগঞ্জ কাপড়েপট্টির জগদ্ধাত্রীপুজো। যেটি চন্দননগরের দ্বিতীয় প্রাচীনতম পুজো। ১৭৬৮ সালে চাউলপট্টির চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতান্তর হওয়ায় কাপড় ব্যবসায়ী শ্রীধর বন্দ্যোপাধ্যায় (মতান্তরে শশধর) রীতিমতো চাঁদা তুলে এই পুজোর প্রবর্তন করেন।
আরও পড়ুন-টাইগার থ্রি
এই অঞ্চলের অপর দুটি বিখ্যাত পুজো হল লক্ষ্মীগঞ্জ চৌমাথা (১৯০৩ খ্রিস্টাব্দ) ও লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারের (১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ) জগদ্ধাত্রীপুজো। আদি নিয়ম অনুযায়ী, উত্তর চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টি, কাপড়েপট্টি, চৌমাথা ও বাজার— এই চার পুজোতেই সিংহের রং সাদা থাকে। শহরের আরও একটি প্রাচীন পুজো রয়েছে, যেটি ১৮৩৫ সাল থেকে পুজো করা হয়। চন্দননগরের বাগবাজারের পুজো। এখানেও প্রাচীন মতেই মায়ের পুজো করা হয়।
দক্ষিণ চন্দননগরের হালদারপাড়ার আদিপুজো অশ্বত্থতলার বুড়িমার পুজো নামে পরিচিত। এই পুজো লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টি ও কাপড়েপট্টির পুজোর সমসাময়িক। এই পুজোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য দশমীর দিন ছেলেরা মেয়েদের মতো শাড়ি পরে এসে মাকে বরণ করেন। ছেলেদের মেয়ে সেজে আসা— এই প্রথা দেখতে ভিড় জমান বহু মানুষ।
আরও পড়ুন-অবৈধ বালিখাদানে অভিযান, মাফিয়াদের হাতে হেনস্থা হলেন তৃণমূল নেত্রী চৈতি
মা সারদার জগদ্ধাত্রী
পশ্চিমবঙ্গের জগদ্ধাত্রী পুজোগুলির মধ্যে অন্যতম হল বাঁকুড়ার জয়রামবাটির মা সারদার জন্মভিটের জগদ্ধাত্রীপুজো। মা সারদার বাড়িতেই প্রথম এখানে জগদ্ধাত্রীপুজো শুরু হয়। এক ব্রাহ্মণ পরিবারে ১৮৫৩ সালের ২২ ডিসেম্বর মা সারদার জন্ম হয়। কথিত আছে, মা সারদার মা শ্যামাসুন্দরী দেবীর হাত ধরে প্রথম ১৮৭৭ সালে এখানে এই পুজোর প্রচলন হয়েছিল। পরবর্তীতে সারদাদেবীও প্রতিবছর জয়রামবাটিতে গিয়ে এই পুজোর খুঁটিনাটি সমস্ত ব্যাপার দেখতেন। শোনা যায়, প্রথম বছর প্রতিমা নিরঞ্জনের দিন বৃহস্পতিবার ছিল। তাই মা লক্ষ্মীবারে বিসর্জন করতে দেননি জগদ্ধাত্রী প্রতিমা। পরদিন সংক্রান্তি ও তার পরদিন মাস পয়লা থাকায় ওই দু’দিনও বিসর্জন হয়নি। বিসর্জন হয়েছিল চতুর্থ দিনে। তাঁর প্রয়াণের পরেও বন্ধ হয়নি পুজো। বর্তমানে রামকৃষ্ণ মিশন এই পুজোর দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এখানে জগদ্ধাত্রীপুজোই প্রাচীন, তখনও কিন্তু জয়রামবাটিতে দুর্গাপুজো শুরুই হয়নি। ১৯২৫ সালে ঘট পেতে প্রথম দুর্গাপুজো শুরু হয়। অনেক পরে মাতৃমন্দিরে মাটির প্রতিমা তৈরি করে দুর্গাবন্দনা শুরু হয়। প্রতিবছর অষ্টমী তিথিতে কুমারীপুজো হয় এখানে। মা সারদা ঈশ্বরের পুনর্জন্মে বিশ্বাস করতেন বলে জানা যায়। শোনা যায় মা দুর্গার অন্য রূপ হিসাবে তাই জগদ্ধাত্রীকে এখানে পুজো করা হয়। মনে করা হয় মা দুর্গারই পুনর্রূপ হল মা জগদ্ধাত্রী।
আরও পড়ুন-আজ নবান্নে রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠক
গোপালপুরের জগদ্ধাত্রী
মাত্র ৪৫০ টাকা নিয়ে পথচলা শুরু করেছিলেন চার বন্ধু। সুকুমার অধিকারী, বাদল মণ্ডল, রবীন্দ্রনাথ মণ্ডল আর ভৈরব গড়াই। এই চার বন্ধুর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ১৯৭২ সালে শুরু হয়েছিল দেবী জগদ্ধাত্রীর এই আরাধনা। আজ ৫০ বছর অতিক্রান্ত গোপালপুরের বিখ্যাত জগদ্ধাত্রীপুজো। খুব সাদামাঠাভাবে শুরু হওয়া একটা পুজো আজ বিশাল আকার নিয়েছে। এই পুজোর অন্যতম উদ্যোক্তা সুকুমার অধিকারী প্রয়াত হয়েছেন আগেই। তাঁর পূর্ববর্তী জীবন কেটেছিল কৃষ্ণনগরে। গোপালপুরের এই জগদ্ধাত্রী প্রতিমা তাই বরাবরই তৈরি হয় কৃষ্ণনগরের ধাঁচে। মণ্ডপে মা আসেন সপ্তমীর দিনে। পরবর্তীতে গোপালপুর জগদ্ধাত্রীপুজো কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই পুজোয় নবমীর দিনেই একসঙ্গে হয় সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীর পুজো।
আরও পড়ুন-সুইপ ভালই মারতাম : বেকহ্যাম
দে মল্লিক বংশের জগদ্ধাত্রী
কলকাতায় দে মল্লিক বংশের সিংহবাহিনী বেশ বিখ্যাত। দেবী জগদ্ধাত্রীর যে মূর্তি এ-যুগে পুজিত হয়, প্রাচীনকালে তা ছিল কিছুটা অন্যরকম। সেই আদি সিংহবাহিনীর মূর্তি আজও রয়েছে কলকাতার মল্লিক বাড়িতে। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে গুপ্ত বংশের পতনের পর আর্যাবর্ত জুড়ে সক্রিয় হয়ে ওঠেন নানান প্রাদেশিক শাসকেরা। তার মধ্যে অন্যতম হল পুষ্যভূতি বংশের প্রশাসক প্রভাকরবর্ধন এবং তাঁর দুই সন্তান রাজ্যবর্ধন ও হর্ষবর্ধন। তাঁদের কুলদেবী ছিলেন জগদ্ধাত্রী। পরবর্তীকালে এই বংশের পতন হলে, দেবী মূর্তিটি জয়পুরের রাজা মানসিংহের কাজে চলে যায়। তিনি মা জগদ্ধাত্রীকে কুলদেবী হিসেবে আরাধনা করতেন। কিন্তু মুঘল আক্রমণের হাত থেকে দেবীকে রক্ষা করতে রাজপুরোহিত দেবীকে নিয়ে বহু দূরে চলে যান। পূর্ববঙ্গের চট্টগ্রামে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের গুহায় লুকিয়ে রাখলেন দেবীকে। সেখান থেকে মাকে উদ্ধার করেন বৈদ্যনাথ দে মল্লিক। বৈদ্যনাথবাবু স্বপ্নাদেশ দেখলেন সমুদ্রের ধারে এক পাথুরে গুহায় পড়ে রয়েছেন মা সিংহবাহিনী। দেবী তাঁকে আদেশ করলেন উদ্ধার করে নিয়ে যেতে। শুধু তাই নয়, দেবী স্বপ্নে পথনির্দেশও দেন তাঁকে। পরবর্তীতে মানসিংহের পুরোহিতের নির্দেশানুযায়ী, বৈদ্যনাথ দে মল্লিক সিংহবাহিনী পুজোর যে প্রথার প্রচলন করেছিলেন, আজও তা যথারীতি পালিত হয়। এই বংশে দুর্গা, জগদ্ধাত্রী এবং বাসন্তী— এই তিনটে পুজোই হয়। মা সিংহবাহিনী এখানে সিংহপৃষ্ঠাসীনা নন, তিনি সিংহের পিঠে দণ্ডায়মানা। বাহন সিংহটি দেবীর ডানদিকে না থেকে রয়েছে বাঁদিকে। সিংহের মুখটি অশ্বমুখী এবং সিংহের পায়ের তলায় একটি হস্তিমুণ্ড।