তারাপদ রায়। তখন টাঙ্গাইল থেকে সদ্য এসেছেন কলকাতায়। থাকেন ডেকার্স লেনে। পড়েন মৌলানা আজাদ কলেজে। ‘পূর্বমেঘ’ নামে একটি কাগজ প্রকাশ করেন। কবিতার কাগজ।
সেই তারাপদ রায় কিনা চোর-ছ্যাঁচ্চড় দলের পান্ডা?
ঠিক এমনটাই ভেবেছিলেন তাঁর এক বন্ধু-কবি। ঠিক কী ঘটেছিল? কেনই-বা এমন ভাবনা? একইসঙ্গে বলি, এই তারাপদ রায়ই হয়ে উঠেছিলেন গাঢ় অন্ধকারে সেই কবির পরিত্রাতা।
আরও পড়ুন-বিদেশ সফরে মলদোভার পোষ্য কুকুরের কামড় খেলেন অস্ট্রিয়ার প্রেসিডেন্ট!
‘সত্যসন্ধ’, একইসঙ্গে ‘মজারু’ তাঁর ছদ্মনাম। ধাঁধা, মজার খেলার পাশাপাশি সেই তিনি মস্তবড় কবি। তিনিই আবার পত্রিকার পাতায় সঙ্গীত সমালোচক, অনুষ্ঠান বিশ্লেষক। সেই তিনি, যিনি এই বঙ্গের প্রথম সারির প্রকাশনা সংস্থায় ব্লার্ব লিখেছেন দেড় দশকেরও বেশি সময় জুড়ে। সেইসঙ্গে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের শীর্ষপদে ছিলেন আসীন। দক্ষ প্রশাসক। আবার তাঁর হাতেই ম্যাজিকের ফুল ফুটত, সার্কাসের ঠিকুজি-কোষ্ঠী ছিল তাঁর নখদর্পণে, বানান ও ছন্দ বিষয়ে তাঁর পরামর্শ নিতেন তারাপদ রায়-সহ বন্ধু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং অন্যান্য কৃত্তিবাসী বন্ধুরা। রবীন্দ্র সদন-সহ নন্দন-চত্বরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের শিল্পী নির্বাচনেও ছিলেন সেই তিনি। শুধু কি তাই! কৃত্তিবাস পত্রিকার সম্পাদক রূপেও দায়িত্ব সামলেছেন বিভিন্ন সময়ে।
আরও পড়ুন-অবনতির শীর্ষে মধ্যপ্রদেশ, রিপোর্ট প্রকাশ তৃণমূলের
প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়। তারাপদ রায়ের বুক-আঁকড়ে থাকা আরেক বন্ধু। সেই বন্ধুকেই তারাপদ রায় তাঁর নাম-মাহাত্ম্যে বাঁচিয়েছিলেন এক দুর্দিনে।
ধান ভানতে শিবের গীত ঠিকই, কিন্তু ‘তারাপদ রায়’ কীভাবে ক্রমে শালপ্রাংশু হয়ে উঠেছিলেন সাহিত্যমহল থেকে ভিন্ন মহলে, সেটাই বলার অভিপ্রায়ে এই কথার মালা।
কীভাবে কবিতাই হয়ে উঠেছিল প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়ের প্রণয়ী, তাঁর ত্রাতা-রক্ষাকর্তা, সেই সত্যি-গল্প। মনুমেন্টের সামনে থেকে একটা বাস ছাড়ত তখন। ৩২সি। বাঘ-মার্কা সরকারি বাস। শ্রদ্ধানন্দ পার্কের গা ঘেঁষে দক্ষিণেশ্বরের দিকে চলে যেত বাসটা। ১৯৫৬ সালের কথা।
আরও পড়ুন-সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারে বিশেষ গুরুত্ব
শীতকাল। সন্ধের মুখ। দুপুরে এক বন্ধুর সঙ্গে চৌরঙ্গিপাড়ায় সিনেমা দেখেছেন তারাপদ সুহৃদ প্রণবকুমার। বন্ধুকে ছেড়ে দিয়ে মনুমেন্টের সামনে এসে বাসস্টপে দাঁড়িয়েছেন। বাস নেই। এক ঝালমুড়িঅলার কাছ থেকে এক আনার মুড়ি কিনে একটা দুটো করে মুখে দিচ্ছেন। বাসস্টপে লোক বেশ কম। ছুটির দিন ছিল বোধহয়। পকেটে প্রাইভেট টিউশনের সাতাশটা টাকা। তখন তিরিশ পেতেন প্রণব। তিন টাকা সেদিনই দুপুরে খরচ করেছেন। কটস-উলের শার্টের বুকপকেটে পেন। ভিতরের পকেটে টাকাটা। নিচের দু-পাশের পকেটে রাজ্যের কাগজ। তখন ধুতি পরতেন। বঙ্গবাসী কলেজের ছাত্র। ইউনিয়ন করেন। কবি হিসেবে অল্পস্বল্প পরিচিতিও ঘটে গেছে। বেশ কয়েকটা কবি সম্মেলনেও যাতায়াতের সুযোগ হয়েছে বারকয়েক।
আরও পড়ুন-দু’দিন পরেই শুরু বিজিবিএস: অংশ নেবেন দেশ-বিদেশের শিল্পপতিরা, দেখে নিন তালিকা
তেমনি একটা কবি সম্মেলনের চিঠি ছিল প্রণবকুমারের পাশের পকেটে। শিবপুর বি-ই কলেজের শতবার্ষিকী। সেই উপলক্ষে কবি সম্মেলনের নেমন্তন্ন। পরমেশ ধর (কবি) তখন ওই কলেজের ছাত্র। তাঁরই মুখ্য উদ্যোগে কবি সম্মেলন। টাটকা চিঠিটা প্রণবকুমারের পকেটেই ছিল।
বাস নেই। মুড়ি চিবোচ্ছেন প্রণব। হঠাৎ এক দীর্ঘকায়, সুঠাম, মাঝবয়সি স্বাস্থ্যবান লোক সামনে এসে দাঁড়াল। পরিষ্কার গলায় ইংরেজি, হিন্দি মেশানো ভাষায় প্রশ্ন করল— আচ্ছা, আপনি কি কোনও কলেজে পড়েন?
প্রশ্নের কারণ বুঝতে না পেরে জবাবে প্রণব বললেন, হ্যাঁ। কেন বলুন তো?
আরও পড়ুন-ছটপুজোর প্রস্তুতি দেখতে গিয়ে গ্রামবাসীদের ধাওয়া
লোকটা তখন বলল, পাটনায় থাকি আমি। পেনের ব্যবসা করি। কলকাতায় এসেছি। ইচ্ছে রয়েছে, কলেজগুলোতে ঘুরে ঘুরে পেন বিক্রি করব। কিন্তু অচেনা শহর। আপনি যদি আপনাদের কলেজের ব্যাপারে কোনও সাহায্য করতে পারেন—
বঙ্গবাসী কলেজে তখন ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে চিপস্টোর খোলা হয়েছে। কম দামে খাতা বই, টুকিটাকি জিনিসপত্র দেওয়া হয়। আরও দু-একটা কলেজেও রয়েছে চিপস্টোর। সেখানে অনায়াসেই পেন চলতে পারে। তারাপদর বন্ধুর মাথায় খেলে গেল ব্যাপারটা। উৎসাহিত হয়ে বললেন, কোনও অসুবিধা নেই। কী পেন আপনার? কী রকম দাম? কমিশন কত? ইত্যাদি নানান প্রশ্ন একের-পর এক করে যেতে লাগলেন। ইতিমধ্যে একটি বাস বোধহয় এসে ছেড়ে গেছে। খেয়াল করেননি। এ-ও খেয়াল করেননি যে, কথা বলার ঝোঁকে কখন থেকে যেন লোকটি এক-পা, দু-পা করে এগিয়ে চলেছে। প্রণবও পাশাপাশি হেঁটে চলেছেন।
হঠাৎ খেয়াল হল। লোকটি আচমকা প্রশ্ন করল, আপনার পকেটে ওটা কী পেন?
উত্তর দেওয়ার আগেই বুকপকেট থেকে উঁকি মারা পৈতেয় পাওয়া শেফার্স পেনটি লোকটি তুলে নিয়েছে হাতে। তারপর বলল, আর কী রয়েছে পকেটে? চটপট দেখি। তীক্ষ্ণ শীতল কণ্ঠ। বিনীত ভঙ্গিটি একেবারে অদৃশ্য। পরিষ্কার আদেশের সুর।
বাসস্টপ থেকে প্রণব তখন অনেকটা দূরে চলে এসেছেন। একেবারে নির্জন চারপাশ। প্রণব স্তম্ভিত। আড়ষ্ট কাঠ। শুকনো তালুতে জিভ ঠেকিয়ে চেঁচাতে চাইলেন— চোর, জোচ্চোর!
লোকটির দৃঢ় হাত প্রণবের ঠোঁটের ওপর এসে পড়ল। আর সেই মুহূর্তে ময়দানের অন্ধকার ঘাস আর গাছের আড়াল ফুঁড়ে হাজির হল আরও দু’জন লোক। একজনের হাতে টর্চও ছিল।
তিনজনে ঘিরে ফেলেছে প্রণবকে। তাঁর শেফার্স পেনটি তখনও লোকটার বাঁ হাতে ধরা।
আরও পড়ুন-দিঘায় জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধন কবে জানিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী
পরিষ্কার বাংলায় নবাগতদের একজন বলল, কী হয়েছে?
লোকটা বলল, এই ছেলেটা আমার পেন ছিনতাই করছিল।
প্রণব ততক্ষণে একটুর জন্য ভরসা পেয়েছেন। কান্নাভাঙা গলায় বললেন, ‘না না, বিশ্বাস করুন, ওটা আমার পেন। ওই লোকটাই…’— কথা শেষ হল না। বাঙালি লোকটি ততক্ষণে প্রণবের পাশ-পকেটে হাত ঢুকিয়ে যাবতীয় কাগজপত্র বার করতে শুরু করেছে। আর মুখে বলে চলেছে, ছি-ছি, ভদ্রলোকের ছেলে হয়ে এইসব করা!
তারাপদর বন্ধুটি ততক্ষণে বুঝে গেছেন, তিনজনে একই দলের। এর পরেই ভিতরের পকেটের সাতাশটা টাকা তুলে নিল ওরা। পকেটের কাগজপত্রগুলো আঁতিপাঁতি করে খুলে খুলে দেখছে বাঙালি লোকটা। অবর্ণনীয় মুহূর্ত। প্রতিটি খাম খুলে খুলে দেখছে। কোথাও টাকা-পয়সা লুকোনো রয়েছে কি না! বি-ই কলেজের কবি সম্মেলনের কার্ডটায় যখন টর্চ ফেলে দেখছে লোকটা, তখন প্রণব মরিয়া হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ওটা দিন আমায়। ওর মধ্যে কিছু নেই।… তখন কি জানতাম, ওর মধ্যেই সব ছিল?’
কার্ডটার ওপর চোখ বোলানো শেষ করে লোকটা খামটা দেখল। দেখল প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়ের নাম। তারপর প্রশ্ন করল, এ চিঠিটা কার?
প্রণব জবাব দেবেন না। দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে থাকলেন। নাম পর্যন্ত জেনে গেল লোকটা! তখন প্রণবের অন্যরকম ভয়। থানা-পুলিশ হাজত ঘুরছে তাঁর মাথায়। চোখে ভাসছে বাড়ির সব ক’টি মুখ। বন্ধু-বান্ধবদের।
লোকটির গলা কখন যেন নরম হয়ে গেছে। প্রণবকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কবিতা লেখেন? তারাপদ রায় বলে কাউকে চেনেন?’
আরও পড়ুন-লুকিয়ে গ্রাহকদের ওপর করের বোঝা চাপাল কেন্দ্র, ভারতীয় ডাক বিভাগের ২৭টি পরিষেবায় জিএসটি
বাকিটা প্রণবকুমারের বয়ানে বলি।
‘তারাপদ রায়! আমি নিজের কানকে তখন অবিশ্বাস করছি। টাঙ্গাইলের ছেলে, নতুন এসেছে। মৌলানা আজাদে পড়ে। ‘পূর্বমেঘ’ বলে একটা কাগজ চালায়। কবিতার কাগজ। সে-ও এই দলের!
বিস্ময় কখন পালটা প্রশ্ন হয়ে গেছে খেয়াল করিনি। বলে উঠেছি, কোন তারাপদ? ডেকার্স লেনে থাকে? সে-ও আপনাদের দলে?
জোঁকের মুখে নুন পড়ল যেন! শেফার্স পেনটা এক ঝটকায় কেড়ে নিয়ে পাটনার লোকটিকে গলায় ধাক্কা মেরে ময়দানের গাঢ়তর অন্ধকারে ঠেলে দিলে বাঙালি লোকটি। মুখে অকথ্য খিস্তি।
তারপর আমার হাতে পেনটা তুলে দিয়ে বলল, খুব বেঁচে গেলেন আজ। ও লোকটা নামকরা গুণ্ডা। ইডেনে ক’দিন আগে বিরাট ছিনতাই করেছে। আপনাকে বাসে তুলে দিই। হ্যাঁ। আরেকটা কথা, তারাপদবাবুকে যেন বলবেন না এই ঘটনাটা।
আরও পড়ুন-শামি-জয়ের অপেক্ষায় ময়দান
চা খাবেন?’
প্রণবের মাথায় একটা বর্ণও ঢুকছে না। কী হল, কেন হল, ভাবতে গিয়ে সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। চা খাবেন না। কিন্তু তারাপদকে তিনি সেদিনই পাকড়াও করবেন। লোকটি তখনও কাকুতি-মিনতি করে বুঝিয়ে যাচ্ছে, তারাপদকে যেন কিছু না বলেন। তাহলে এসব ঘটনায় নাকি লোকটার মুখেও চুনকালি পড়বে।
বাসে উঠেও সেই রাতেই ফের নেমে গেলেন প্রণব। সোজা তারাপদ রায়ের বাড়িতে। ঘটনাস্থল থেকে ডেকার্স লেন সামান্য দূরে। তারাপদকে প্রণব সেদিন কীভাবে কী বলেছিলেন তা তাঁর সেভাবে মনে ছিল না পরবর্তী সময়ে। তবে এই ব্যাপারটা নিয়ে তারাপদ-প্রণবের বন্ধুমহলে বেশ কিছুদিন ধরে একটা গল্পই চালু হয়ে গিয়েছিল।
আরও পড়ুন-প্রয়াত হলেন ‘নেহরুর বউ’ বুধনি মেঝান ঘুচল অপবাদ
আসলে তারাপদ রায় তখন থাকতেন তাঁর মেসোমশাইয়ের বাড়িতে। মেসোমশাই ছিলেন স্বনামধন্য দেবী রায়। সেই সূত্রে পুলিশের অনেকেই তারাপদ রায়কে চিনতেন। ময়দান ডিউটিতে সে-রাতে যে দু’জন ছিল তাদেরই একজন সেই বাঙালি লোকটি। তারাপদ তাঁর মেসোমশাইকে বলে দিলে, ফল যে খুব সুখের হবে না, বুঝতে পেরে গিয়েছিল পুলিশটি। তাই এত অনুনয়, এত কাকুতি-মিনতি।
ঘটনাটা শুনে তারাপদ রায় সেদিন হো হো করে হেসেছিলেন। আরও রসালো করে মজাদার ভাবে ঘটনাটা বলেও ছিলেন অনেকদিন। কফি হাউসে, কৃত্তিবাসের আড্ডায়, কবি সম্মেলনে যাওয়ার বাসে, এখানে সেখানে।
প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় আজীবন মনে রেখেছিলেন ঘটনাটা। কবিতার পাশাপাশি তারাপদ রায় সেদিন অদৃশ্যে থেকেও বাঁচিয়েছিলেন বন্ধুবর প্রণবকে!
আরও পড়ুন-ওপেনএআই-র সিইও পদ থেকে অপসারিত চ্যাটজিপিটি-স্রষ্টা অল্টম্যান
শুধু প্রণবকুমার নয়, গোমড়াথেরিয়াম বহু মানুষকেও কলমের গুণে হেসে-খেলে বাঁচার দিশা দেখিয়েছিলেন তারাপদ রায়।
এই প্রতিবেদকের নাম তখন একটি পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্বে সবে জুড়েছে। সেই পত্রিকার সঙ্গে তারাপদ রায়ের বেশ হরদম দহরম। বিস্তর ধারাবাহিক লিখেছেন। বইমেলা বিশেষ সংখ্যা থেকে পুজো সংখ্যা, তারাপদময় সেই পত্রিকার সূচিপত্র। এত লেখালেখি, এত ভালবাসাবাসি যতটা না পত্রিকার কারণে, তার চেয়ে বেশি যিনি বিভাগীয় সম্পাদক হিসাবে সেতু তৈরি করেছিলেন, মূলত সেই গুণবতীর ক্যারিশমায়। সেই পত্রিকা সম্পাদক তখন অন্যত্র নাম লিখিয়েছেন। ফলে সম্পর্কের সেতু ছিন্ন। দায়িত্ব পড়ল, তারাপদ রায়ের সঙ্গে হেঁইসা মারো হেঁই করে পুনরায় সম্পর্ক তৈরির।
আরও পড়ুন-আজ ছটপুজোয় ঘাটে মুখ্যমন্ত্রী
শুধুমাত্র পত্রিকার পাতায় কিংবা টিভির পর্দায় তাঁকে দেখাদেখি। সে মুখে মায়ার ছায়া নেই, তাঁর মেধাবী কেতায়-কথায় লোকে হাসলেও নিজে হাসেন না। কণ্ঠস্বরেও রামায়ণ-মহাভারত কিংবা গ্রহান্তরের জীব যেন! স্বাভাবিক ভাবে, মনের মধ্যে পুঞ্জীভূত মেঘ। মানুষটিকে ফোন করলে, তিনি কীভাবে গ্রহণ করবেন! শেষমেশ বেশ ধক নিয়ে ফোনটা করা গেল। ‘পদ’ যুক্ত নামের প্রথম অংশটুকু শুনেই বললেন, ‘রমাপদ চৌধুরি নাকি?’
না-না বলে হামলে পড়তেই বললেন, ‘তাহলে আবার পদে-পদে পদস্খলন শুরু হল?’
বুঝতে বাকি রইল না, নিজের নামযুক্ত ‘পদ’-এর সঙ্গে নয়া বিভাগীয় সম্পাদকের আ‘পদ’ যোগ করে ফেলেছেন। বিপদ বুঝে চুপকথাতেই ঢোঁক গিলি। তারাপদই শুরু করলেন, ‘পদহস্ত প্রক্ষালন করে ফেলুন। বলুন, কী চাই?’
পদ্য, গদ্য দুটোই চাই।
আরও পড়ুন-রেলে নাভিশ্বাস দেশবাসীর, বিমান ভাড়াকেও হার মানাচ্ছে টিকিটের দাম
তারপর থেকে যখনই লেখার আদান বা দক্ষিণা প্রদানের বিষয়ে ফোন করতে হয়েছে, তখনই তারাপদ ‘পদ’-যোগে পদময় করে ছেড়েছেন। কখনও নিরাপদ, দুর্গাপদ, হরিপদ, কালীপদ, বিষ্ণুপদ, শক্তিপদ—চর্যাপদের লুইপাদ, ভুসুকপাদ, কাহ্নপাদ পদকর্তাদেরও টেনে এনে পদান্তর করেছেন বহুবার।
‘কেমন আছেন?’ এই জিজ্ঞাসায় বলতেন, ‘টানাটুনির সংসার, টেনেটুনে বেঁচে আছি।’
এমনটা চলতে চলতে, তারাপদর বাড়িতে তখন চলাচল বেড়েছে। দুটো ‘চালসেদ্ধ’, ‘ডালসেদ্ধ’ মুখে-পেটে চালান দেওয়ার জন্য প্রতিবেদককে চালনা করেছেন। প্রায়শই, অন্যান্য সাহিত্যিক বন্ধুদের কাছে বইয়ের লেনদেনের সেতু-বন্ধু হয়েছি স্বেচ্ছায়, স্বাচ্ছন্দ্যে। একদিন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে তাঁর একটি বই পাঠানোর প্রসঙ্গে সাহস করে বলে ফেলি, সুনীল পান করে মাতাল হন, আর আপনি মাতালদের নিয়ে কৌতুক লিখে চলেন?
‘কী বলতে চাইছ? সুনীল পানাসক্ত? মানা শক্ত।’
আরও পড়ুন-১২ বছর পর বিশ্বজয়ের মুখে রোহিতরা, আজ বিশ্বকাপ ফাইনাল, তিনের বদলা তেইশে?
ক্রমে উঠে আসে, ‘তিন জোড়া লাথির ঘায়ে রবীন্দ্র-রচনাবলী লুটোয় পাপোশে’। রবীন্দ্রপিপাসু পাঠকদের মনখারাপ করা সুনীলের সেই বিখ্যাত, বিতর্কিত লাইন।
তারাপদ বলতে থাকেন, কীভাবে তাঁর আহিরীটোলার বাড়িতে আড্ডা দিতে দিতে সুনীল ঘুমের দেশে ডুবে যেতে চাইতেন আর চারদিকে রবীন্দ্র-রচনাবলীর ভিড়ে পা সোজা করতে পারতেন না। এবং সেই সুবাদে লিখে ফেলা সুনীলের সেই অমোঘ লাইন। এবং আরও হাজারো কথা।
আর এক প্রণম্য সাহিত্যিক শেখর বসুর সূত্রে, সুবাদে, বদান্যতায় কলকাতার শ্রীভূমি ফুলমেলায় সে-বছর ডাক পড়ল প্রতিবেদকের। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, কথার মালা গাঁথার জন্য। ফুলমেলার সেবার প্রথম বছর। মন্ত্রীসান্ত্রি-সহ একঝাঁক সাহিত্যিক, ক্রীড়াক্ষেত্র থেকে পর্দার নক্ষত্র— ভিড়াক্কার সেই অনুষ্ঠানে তারাপদ রায় বলতে উঠে বললেন, ফুল নিয়ে সেই চির পরিচিত চুটকি।
আরও পড়ুন-শারদ-সাহিত্যে ঐতিহ্য এবং আধুনিকতা
‘শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন এক ছাত্রকে, তোমার প্রিয় ফুলের নাম কী?
ছাত্রটি বলল, স্যার, চন্দ্রমল্লিকা।
শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন, চন্দ্রমল্লিকা বানান বলো।
ছাত্রটি মুহূর্তের মধ্যে বলল, না স্যার চন্দ্রমল্লিকা নয়, আমার প্রিয় ফুল গোলাপ।’
এই ফুলমেলায় নাগাড়ে অন্তত পাঁচবছর এসেছিলেন তারাপদ রায়। মেলা সম্পর্কে দু’কথা-চার কথার পর এই মোক্ষম চুটকিটি তিনি বলতেনই। সঙ্গে ছিল বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ— ‘যাঁরা শোনেননি তাঁদের জন্য তো বটেই, যাঁরা শুনেছেন তাঁদেরও জন্য আর একবার’।
একটিবার এই চুটকির সঙ্গে বলেছিলেন, সেই ‘ভুল’ কবিতাটি।
আরও পড়ুন-দুই তারাপদর গল্প
‘কোনটা যে চন্দ্রমল্লিকার ফুল/ আর কোনটা যে সূর্যমুখী—/ বারবার দেখেও/ আমার ভুল হয়ে যায়,/ আমি আলাদা করতে পারি না।/ ওলকপি এবং শালগম,/ মৃগেলের বাচ্চা এবং বাটামাছ,/ মানুষ এবং মানুষের মতো মানুষ— / বারবার দেখেও/ আমার ভুল হয়ে যায়,/ আমি আলাদা করতে পারি না।/ বই এবং পড়ার মতো বই,/ স্বপ্ন এবং দেখার মতো স্বপ্ন,/ কবিতা এবং কবিতার মতো কবিতা,/ বারবার দেখেও/ আমার ভুল হয়ে যায়,/
আমি আলাদা করতে পারি না।’
প্রিয় তারাপদবাবু, আমরাও আলাদা করতে পারি না বাজারচলতি চুটকির সঙ্গে আপনার লেখা সরস কথকতাকে। কারণ, আপনার সরস সমগ্র থেকেই যে বাজারে হাজারো ‘জোকস সমগ্র’র ছানাপোনা তৈরি হয়েছে। আপনার মেধাবী, মজাদার সরসতার সঙ্গে কিছু পানসে, পান্তাভাতে মার্কা ‘জোকস’— ডোডো-তাতাইরা যেন আপনাকেই পড়ে। হাসির হুল্লোড়ে বোঝা যায় আপনিই বঙ্গ সাহিত্যে সেই সরস ‘তারা’। যে সরসতার এখন ভীষণ অভাব বঙ্গসাহিত্যে।
আপনার মতোই।