আবার স্ক্রাব টাইফাস

বর্ষাকালে যখন ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া নিয়ে সবাই জেরবার ঠিক তখনই গোদের ওপর বিষফোড়া হল স্ক্রাব টাইফাস। এ-বছর কলকাতা-সহ রাজ্যে ডেঙ্গুর সঙ্গেই জাঁকিয়ে বসেছে এই রোগটি। আক্রান্ত হয়েছে বেশ কয়েকজন শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক। কী এই স্ক্রাব টাইফাস? কেন হয়? চিকিৎসাই বা কী জানাচ্ছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

বর্ষাকাল মানেই পোকামাকড়, মশা-মাছির বাড়বাড়ন্ত। আর এর থেকে নানা রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি। এ বছরও তাঁর ব্যতিক্রম নেই। ডেঙ্গুর কথা তো শোনা যাচ্ছেই, সেই সঙ্গে নতুন আতঙ্ক হল স্ক্রাব টাইফাস। আজ থেকে প্রায় বছর দুই আগে এই রোগটি শহরে প্রথম ধরা পড়ে। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ড হেলথে ভর্তি হওয়া একটি শিশুর শরীরে ছিল এই রোগের লক্ষণ। রোগটি যদিও ছোঁয়াচে নয় কিন্তু সময়মতো চিকিৎসা করাতে হবে। না হলে জটিলতা বাড়তে পারে। রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।

আরও পড়ুন-জকোভিচের জরিমানা

হেলাফেলার নয় এই রোগ। মূলত শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে এই রোগে। বর্ষাকালে যখন একগুচ্ছ রোগের ছড়াছড়ি তখন স্ক্রাব টাইফাস দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে তুলেছে। এই শহরে ইতিমধ্যে মোটামুটি দশজন শিশুর এই রোগে আক্রান্ত হবার খবর পাওয়া গিয়েছে।
কী এই স্ক্রাব টাইফাস
স্ক্রাব টাইফাস শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ টাইফাস থেকে যার অর্থ হল ধোঁয়াটে বা অস্পষ্ট। এঁটুলি পোকার মতো দেখতে ট্রম্বিকিউলিড মাইটস বা টিক-এর মতো পরজীবী পোকার কামড় থেকে এই রোগের জীবাণু মানবদেহে ছড়ায়। এই পোকাগুলির আকার ০.২ মিলিমিটার থেকে ০.৪ মিলিমিটার পর্যন্ত হয়। বিশেষজ্ঞের মতে এটি একটি জুনোটিক ডিজিজ। এই ধরনের রোগকে পশুমারী বলে। একটি ব্যাকটেরিয়ার কারণে এই রোগ হয়। পোকার কামড়ে শরীরের কোনও নির্দিষ্ট অংশে কালো পোড়া-মতো দাগ থেকে যায়। দেখতে খানিকটা সিগারেটের ছ্যাঁকার মতো। ওরিয়েন্টিয়া সুসুগামুশি নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট একটি রোগ। এটি বুশ টাইফাস নামেও পরিচিত। স্ক্রাব টাইফাসের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, শরীরে ব্যথা এবং কখনও কখনও ফুসকুড়ি।

আরও পড়ুন-সহজেই জিতল ডায়মন্ড হারবার

সাধারণত গ্রামবাংলার কৃষিজমিতে এই ধরনের পোকা থাকে। শহরে অ্যাপার্টমেন্টে বা বাড়িতে ঝোপঝাড়, গাছপালা কিংবা পোষ্যের গায়ে এই ধরনের পোকা দেখা দেয়। প্রথমে কামড়ালে কোনও ব্যথা-যন্ত্রণা কিছুই থাকে না কিন্তু পরে শরীরে ভিতরে গিয়ে তা সমস্যার সৃষ্টি করে।
স্ক্রাব টাইফাসের বেশিরভাগ ঘটনা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চিন, জাপান, ভারত এবং উত্তর অস্ট্রেলিয়ার গ্রামীণ এলাকায় শোনা গিয়েছে। স্ক্রাব টাইফাস পাওয়া যায় এমন এলাকায় থাকলে বা সেসব জায়গায় ঘুরতে গেলে যে কেউ সংক্রামিত হতে পারে।

আরও পড়ুন-১৯৭৮ সালের পর ফের এই বছর যমুনা ছুঁল তাজ মহলের দেওয়াল

কী করে বুঝবেন
সর্দি-গর্মি ছাড়া ৪-৬ দিন টানা জ্বর দেখলে ফেলে রাখা যাবে না। সেটা ডেঙ্গু বা স্ক্রাব টাইফাস, যে-কোনও একটি হতে পারে।
জ্বর মোটামুটি ১০৪ পর্যন্ত উঠতে পারে এবং সঙ্গে সর্দি থাকবে।
অসহনীয় মাথাব্যথা হতে পারে।
শরীর ব্যথা এবং পেশিতে প্রবল ব্যথা হয়।
লার্ভা মাইট কামড়ানো ক্ষতস্থানটা কালো পোড়া গর্তের মতো হয়।
লো-ব্লাড প্রেশার হয় ফলে দুর্বল লাগে।
মানসিক পরিবর্তন হতে পারে, সঙ্গে মানসিক বিভ্রান্তি, কোমা পর্যন্ত হতে পারে।
লিম্ফ নোডগুলো বেড়ে বা ফুলে ওঠে।
সারা গায়ে ফুসকুড়ি। পিঠ এবং বুক থেকে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে।
যেখানে এই পোকাটি কামড়ায় চারপাশটা লাল হয়ে যায়।

আরও পড়ুন-আগামীকাল বাইশ গজে মুখোমুখি ভারত ও পাকিস্তান, বাড়ছে স্নায়ুর চাপ

কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন
স্ক্রাব টাইফাসের লক্ষণ বা উপসর্গ অন্যান্য অনেক জ্বরের পূর্ব লক্ষণের মতোই। স্ক্রাব টাইফাস পাওয়া যায় এমন এলাকায় থাকলে বা সেসব জায়গায় ঘুরে আসার পর জ্বর এলে বা উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
যদি সম্প্রতি কোথাও বেড়াতে গিয়ে থাকেন, তারপর উপসর্গ এসেছে তা হলেও চিকিৎসক বা স্বাস্থ্য আধিকারিককে জানান।
এই রোগের লক্ষণ বুঝলে অনেক সময় বিশেষজ্ঞরা রক্তপরীক্ষা করতে বলেন। অ্যালাইজা পরীক্ষা বা আইজিএম পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগ শনাক্ত করা যায়।

আরও পড়ুন-বিদেশী বান্ধবীর বহুতলের নীচে চিকিৎসকের দেহ ঘিরে ঘনীভূত হচ্ছে রহস্য

বিগত বছরে কোভিডের মধ্যেও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল স্ক্রাব টাইফাস। এবার বর্ষার শুরুতেই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় স্ক্রাব টাইফাস হানা দিলেও কলকাতায় এতদিন এর কোনও রোগী ছিল না। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। শহরেও হানা দিয়েছে রোগটি। বর্ষায় যেহেতু গাছপালা, ঝোপঝাড়ের সংখ্যাটা বেড়ে যায়— তাই স্ক্রাব টাইফাসের ঝুঁকি তৈরি হয়।
কত বছরের বাচ্চা
একেবারে ছোট্ট শিশুর স্ক্রাব টাইফাসের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। একটু বড় বয়সেই এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে ছোটরা।

আরও পড়ুন-বাংলাদেশে দাপট দেখাচ্ছে ডেঙ্গু, মৃত শতাধি

চিকিৎসা
স্ক্রাব টাইফাসের চিকিৎসায় দেরি হলে হতে পারে কিডনি ফেলিওর, লিভারের সমস্যা। বেশি হয়ে গেলে কানে ব্যথা এবং সেখান থেকে কানেও শুনতে পায় না অনেকে। শেষ পর্যায় হতে পারে এনকেফেলাইটিস অথবা মায়োকার্ডাইটিস রোগ। সময়মতো চিকিৎসা না হলে একাধিক অরগ্যান ফেলিওর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এতে মৃত্যুর ঝুঁকিও বেড়ে যায়। ঠিক সময়ে রোগের চিকিৎসা শুরু করা জরুরি। ৫ থেকে ৭ দিন অ্যান্টিবায়োটিক খেলে রোগী ভাল হয়ে যায়। সাধারণত অ্যাজিথ্রোমাইসিন বা ডক্সিসাইক্লিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক এই রোগের মূল ওষুধ। তিন থেকে পাঁচ দিন থাকে এই জ্বর। তার থেকে বেশি থাকলে সতর্ক হতে হবে।

আরও পড়ুন-বৃষ্টি-বন্যায় বিধ্বস্ত উত্তর ভারতের একাধিক রাজ্য, হিমাচলে মৃত্যু শতাধিক মানুষের

গর্ভবতী মহিলা
গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে স্ক্রাব টাইফাস শনাক্ত হলে বিশেষ সতর্কতা জরুরি। ওই সময় যে কোনও গ্রুপের ওষুধ দেওয়া যাবে না সন্তানসম্ভবা মাকে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া সাধারণ জ্বর ভেবে ওষুধ খেলে গর্ভপাত হতে পারে অথবা মৃত সন্তান প্রসব করতে পারে।
ডেঙ্গু এবং টাইফয়েড ভেবে ভুল নয়
ডেঙ্গু বা টাইফয়েডের সঙ্গে স্ক্রাব টাইফাসের উপসর্গগুলির অনেক মিল রয়েছে। ফলে প্রাথমিকভাবে এই রোগকে চিহ্নিত করা মুশকিল। শরীরে জীবাণু সংক্রমিত হওয়ার দশদিন পর লক্ষণ দেখা দিলে কেউ কেউ ডেঙ্গু হয়েছে মনে করেন। এই উপসর্গগুলি দেখা দেওয়ার ৩ থেকে ৫ দিন পরে শরীরের বিভিন্ন অংশে ফুসকুড়ি দেখা দেয়। এটাও খানিকটা ডেঙ্গুর মতোই, অ্যালার্জি হয় শরীরে। তাই অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যান।

Latest article