জন্মদিনে হরগোবিন্দ খোরানা

ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিখ্যাত বিজ্ঞানী জীব-রসায়নবিদ হরগোবিন্দ খোরানা। শারীরবিদ্যা বিভাগে পেয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার। প্রোটিন সংশ্লেষে জিনের ভূমিকা বের করাই ছিল তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু। আজ জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধা জানালেন অর্পণ পাল

Must read

আমরা যেসব ভারতীয়ের জন্য সত্যিকারের গর্ববোধ করি, তাঁদের মধ্যে প্রথম সারিতেই থাকেন এই মানুষটি। তাঁর কৃতিত্বকে আমাদেরই অর্জন বলে গণ্য করি; অথচ, তিনিই এক কালে এই দেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে হয়েছিলেন আমেরিকার পাকাপাকি বাসিন্দা এবং নাগরিকও, সেই পরিচয়েই তাঁর নোবেল-লাভ।
হ্যাঁ, আমরা বিখ্যাত রসায়নবিদ হরগোবিন্দ খোরানার কথা বলছি। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই বিজ্ঞানী আমেরিকান নাগরিক হয়ে গিয়েছিলেন ১৯৬৬ সাল থেকেই (নোবেল পাওয়ার দু-বছর আগে), অথচ বড় হওয়া এবং পড়াশুনো অবিভক্ত ভারতে (এখনকার পাকিস্তানের মুলতান-এর রাইপুর গ্রামের ভূমিপুত্র) হলেও তাঁকে আমরা ভারতীয় বলেই জেনে এসেছি। নোবেল পুরস্কার পাওয়া এই গ্রহের সবচেয়ে সম্মানের একটা ব্যাপার, সেই তালিকায় যত বেশি এ দেশের মানুষের নাম থাকবে, আমাদের গর্ব তো ততটাই বাড়তে থাকবে, তাই না?

আরও পড়ুন-শহর সাজিয়েও বিদ্যুতের খরচে লাগাম কলকাতা পুরসভার, বছরে সাশ্রয় ৫০ কোটি টাকা

ছোট্ট করে জীবন-কথা
অত্যন্ত গরিব এক হিন্দু পরিবারে জন্ম তাঁর। বাবা গণপত রাই খোরানা ছিলেন সরকারি দফতরের একজন নিচুতলার কর্মী। মাইনে পেতেন খুবই সামান্য, তাতে সংসার চলত না মোটেই। ওইরকম দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও তাঁর বাবা তাঁর এবং আরও চারটি সন্তানের জন্য পড়াশুনোর বন্দোবস্ত যতটা পেরেছিলেন করেছিলেন। এতটাই অভাবের সংসার ছিল যে ছোটবেলায় তাঁকে রোজ ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে আশেপাশের বাড়ি থেকে রান্নার জন্য জ্বালানি কাঠ কুড়িয়ে বা চেয়েচিন্তে আনতে হত। আর ওইরকম একটা পরিবারে স্বাভাবিকভাবেই কেউ বাচ্চার জন্মতারিখ নির্দিষ্ট করে নথিভুক্ত করে রাখে না, যে কারণে তাঁর জন্মসাল ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ হিসেবে জানা থাকলেও নির্দিষ্ট করে জন্ম-তারিখটা বলা যায় না। তবু তিনি নিজে সারা জীবন ওই বছরের জানুয়ারির ৯ তারিখটাকে নিজের জন্মদিন বলে মেনে চলেছিলেন। সেই হিসেবে আজ তাঁর জন্মদিন। একশো পেরিয়ে তিনি আরও দু-বছরে পা দিলেন।

আরও পড়ুন-বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সাংবিধানিক ধারা প্রয়োগের আর্জি, সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ যুব তৃণমূল নেতা

মেধাবী ছাত্র
গ্রামের একটি স্কুলে পড়বার পর তিনি ভরতি হন লাহোরের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখান থেকেই রসায়ন নিয়ে বিএসসি এবং এমএসসি পাশ করেন ১৯৪৫ সালে। ওই বছরেই ভারত সরকার একটা নতুন স্কিম শুরু করে, খুব মেধাবী ছাত্রদের মধ্যে থেকে বেছে কয়েকজনকে বিদেশে পড়তে বা গবেষণা করবার জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। খোরানা, সৌভাগ্যক্রমে ওইরকম একটা দলে ঢুকে যেতে পেরেছিলেন। এরপর তিনি চলে গেলেন ইংল্যান্ডে, লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডিও করে ফেললেন বছর তিনেক বাদে। তাঁর গবেষণা ছিল ছত্রাক এবং পতঙ্গ মারবার ওষুধ নিয়ে।

আরও পড়ুন-চোখের আলোয় উদ্ভাসিত কবিগুরুর বাড়ি

গবেষণার শুরু
ততদিনে দেশ স্বাধীন হয়েছে। যদিও সবকিছুই যথেষ্ট অগোছালো। দেশের মাটিতে তখন জীব-রসায়ন বিষয়টায় উন্নত গবেষণার উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি মোটেই। সুতরাং তখন যে দেশে ফিরে লাভ নেই এটা তিনি বুঝে গিয়েছিলেন। আর তাঁর জীবনও একটা অন্যপথে বাঁক নিল ওই ’৪৮ সালেই। তখন তাঁর সঙ্গে সদ্য আলাপ হয়েছে এস্থার সিবলার (Esther Sibler) নামে সুইৎজারল্যান্ডের এক মহিলার। তিনিই খোরানাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে রাজি করান, যাতে খোরানা এক্ষুনি দেশে না ফিরে সুইৎজারল্যান্ড থেকে বছরখানেকের জন্য পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ করে ফেরেন। খোরানা চললেন সেই দেশে, যদিও তাঁর পকেটে তখন পয়সাকড়ি নেই বিশেষ। খুবই কষ্টেসৃষ্টে তিনি সেখানে ভ্লাদিমির প্রিলোগ (Vladimir Prelog) নামে জৈব-রসায়নের জগতে বিখ্যাত এক অধ্যাপকের কাছে গবেষণা করলেন বছরখানেক, এরপর চলে গেলেন কেমব্রিজে। এই ভ্লাদিমির সাহেবের সঙ্গে থাকবার ফলে তাঁর মনোজগতে বেশ বড় একটা পরিবর্তন আসে, বিজ্ঞানের দর্শনের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ওই সময় থেকেই শুরু। আর কেমব্রিজে যাওয়ার পর সেখানে সঙ্গ পেলেন দুই বড় মাপের ব্রিটিশ জীব-রসায়নবিদ জর্জ ওয়ালেস কেনার (George Wallace Kenner) এবং আলেকজান্ডার আর টড (Alexander R. Todd)-এর। এখানে থাকবার সময়েই তাঁর আগ্রহ জন্মায় প্রোটিন এবং নিউক্লিক অ্যাসিডের প্রতি। জীবদেহের মধ্যেকার প্রোটিনের মূল উপাদান এই নিউক্লিক অ্যাসিডের রাসায়নিক গঠন নিয়ে তখন তিনি মেতে উঠেছেন। ওই সময় কেমব্রিজে আরও একাধিক বিজ্ঞানী বিভিন্ন ধরনের প্রোটিন নিয়ে কাজ করছিলেন, সেই দলে ঢুকে গেলেন খোরানাও। এঁদের মধ্যে প্রায় অনেকেই পরে নোবেল পেয়েছিলেন।

আরও পড়ুন-রেকর্ড বিকিকিনি সবলা মেলায় জেলার হস্তশিল্পেই বাজিমাত

নোবেল
ইতিমধ্যে ১৯৫২ সালে তিনি ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর ডাক পেয়ে গিয়েছেন। এখানে যতদিন ছিলেন, ততদিন এবং এরপর যেখানে যোগ দেন সেই উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়েও আসবার পর তিনি গবেষণা করতে থাকেন ওই নিউক্লিক অ্যাসিড নিয়েই। আর ওই ১৯৫২ সালেই তিনি বিয়ে করেন এস্থার সিবলার-কে। এই মানুষটির অবদান খোরানার জীবনে সবচেয়ে বেশি। তাঁর গবেষণার ফলাফল তাঁকে স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য করেনি। ১৯৬৮ সালে যখন ঘোষণা করা হল সে বছরের শারীরবিদ্যায় নোবেল প্রাপকদের নাম, তখন তিনজনের সেই তালিকায় দেখা গেল স্থান পেয়েছেন হরগোবিন্দ খোরানা, বাকিরা হলেন মার্শাল নিরেনবার্গ (Marshall Nirenberg) আর রবার্ট হলি (Robert Holley)। এঁরা দুজনেই আমেরিকান।
নোবেল ছাড়াও খোরানা সম্মানিত হয়েছেন আরও বহুভাবে, বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকেই। আমেরিকার ‘ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স’-এর সদস্যপদ পেয়েছিলেন (১৯৬৬), পেয়েছিলেন রয়্যাল সোসাইটির সদস্যপদ (১৯৭৮), আমাদের দেশ থেকে পেয়েছিলেন পদ্মবিভূষণ (১৯৬৯), এবং বছর কয়েক আগে ২০০৭ সালে তাঁর সম্মানে ভারত এবং আমেরিকার মধ্যে ‘খোরানা প্রোগ্রাম’ নামে একটা কর্মসূচি চালু হয়, যেখানে এই দুই দেশের মধ্যে বিজ্ঞান এবং আরও কিছু ক্ষেত্রে দক্ষ কর্মীর আদানপ্রদান সহজতর এবং ঝঞ্ঝাটহীন হয়। হরগোবিন্দ প্রয়াত হয়েছেন ২০১১ সালের জুন মাসে। তার আগেই পৃথিবী ছেড়েছিলেন তাঁর স্ত্রী এবং এক মেয়ে। এখন অন্য দুই মেয়ে বেঁচে। এ দেশের এক সময়কার বাসিন্দা হলেও পরে তিনি আমেরিকার জীবন-যাপনেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন-কলকাতা পুরসভায় বায়োমেট্রিক হাজিরা চালু হল

তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু
তাঁর গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল আরএনএ-যুক্ত (রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড, দেহকোষে থাকা এক ধরনের জটিল রাসায়নিক অণু, যা প্রোটিন সংশ্লেষে বিশেষ ভূমিকা নেয়) জিন-এর রাসায়নিক গঠন বের করা। পরে তিনি এবং তাঁর সহ-গবেষকেরা কোষের নিউক্লিক অ্যাসিডের মধ্যে থাকা নিউক্লিওটাইড কীভাবে প্রোটিন তৈরিতে সাহায্য করে, সেটা বের করবার কাজে যুক্ত হয়েছিলেন। প্রোটিন সংশ্লেষে জিনের ভূমিকা বের করাই তাঁদের নোবেল এনে দিয়েছিল। আমাদের অনেকেই জানি যে মোটামুটি বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের শুরুর দিকে কেমব্রিজেই দুই গবেষক জেমস ওয়াটসন আর ফ্রান্সিস ক্রিক-এর হাত ধরে কোশের আর এক দরকারি উপাদান ডিএনএ-র (ডি-অক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড) গঠন আবিষ্কৃত হয়। পরবর্তী সময়ে জিনতত্ত্ব যেভাবে নতুন-নতুন দিকে বাঁক নিতে থাকে (যেমন জিনের প্রতিরূপ তৈরি বা কৃত্রিম জিন তৈরি) সে-সবেরই ভিত্তি ছিল খোরানা বা ক্রিক-ওয়াটসনের ওই সময়কার কাজগুলো। এক অখ্যাত গ্রামের অতি সাধারণ পরিবারের সাদামাটা ছেলেটি গোটা বিশ্বের জীব-রসায়ন মানচিত্রে বড় মাপের একটা নিজস্ব এলাকা নির্মাণ করতে পেরেছিলেন, যে মানুষটির গড়ে ওঠবার পেছনে বড় ভূমিকা ছিল আমাদের দেশের মাটির, কয়েকজন মানুষেরও। এই ব্যাপারটার জন্যেই আমরা এখনও গর্ববোধ করতেই পারি।

Latest article