চায়ে চুমুক

এই চা দিবসের গুরুত্ব অন্য। কারণ যাই হোক, চা শব্দটা শুনলেই তামাম দুনিয়ার চা-প্রেমীদের মন-প্রাণ তরতাজা অনুভূতিতে ভরে ওঠে মুহূর্তে।

Must read

আজকে আন্তর্জাতিক চা দিবস। যদিও এই চা দিবসের গুরুত্ব অন্য। কারণ যাই হোক, চা শব্দটা শুনলেই তামাম দুনিয়ার চা-প্রেমীদের মন-প্রাণ তরতাজা অনুভূতিতে ভরে ওঠে মুহূর্তে। এক কাপ চা দিয়ে দিন শুরু করার আগে জেনে নিন তার কেরামতি। শরীর-স্বাস্থ্যের পরম বন্ধু হল চা, আবার বেশি খেলেও অপকার। জানালেন ডায়াবেটিক এডুকেটর, ডায়েটেশিয়ান সোনালি ঘোষ। লিখেছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

আরও পড়ুন-সর্বোচ্চ বকেয়া বাংলার, স্বীকার

আজ ১৫ ডিসেম্বর। ২০০৫ সাল থেকে এই দিন পৃথিবীর সমস্ত চা উৎপাদনকারী দেশগুলো আন্তর্জাতিক চা দিবস হিসেবে পালন করে। যদিও বিশ্ব চা দিবস পালিত হয় ২১ মে। এমন চা দিবস আরও রয়েছে।
চা গাছের বৈজ্ঞানিক নাম হল ক্যামেলিয়া সিনেনসিস। সাধারণত পাহাড়ি অঞ্চলে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে একটু উঁচুতে চায়ের ফলন ভাল হয়। চায়ের বৈশিষ্ট্য হল একটি কুঁড়ি আর দুটো পাতা সমন্বিত। উপরেরটি বড় পাতা অপরটি ছোট পাতা। দুটো পাতা দু’ধরনের চা-এর কারিগর। বড় পাতা থেকে যে চা হয় তা উচ্চমানের এবং ছোট পাতার চা কম মানের হয় যাকে গুঁড়ো চা বলা হয়। কুঁড়ি থেকে হয় হোয়াইট টি। প্রথমে চিনে একে ‘চা’ (cha) বলা হত। ইউরোপিয়ান কান্ট্রিতে ‘চায়’। ধীরে ধীরে টি(Tea) কথাটা প্রচলিত হয়।

আরও পড়ুন-বিতর্কিত ইউএপিএ প্রয়োগ বাংলায় অনেক কম, জানাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক

নানা জাতের চা-এর মধ্যে রয়েছে অসমের চা, যাকে সিটিসি বলা হয়। একে গুঁড়ো বা দানা চা বলে চেনে সবাই। এছাড়া রয়েছে গ্রিন টি। এই চা ফার্মেন্টেড করে তৈরি হয়। তৃতীয় ধরনটি হল ওলং টি (Olong Tea) লম্বা পাতার থেকে এই চা হয়। ডুয়ার্স বা দার্জিলিংয়ে পাওয়া যায় এই চা। চা-কে দু’ভাবে পাওয়া যায়, অরগ্যানিক এবং ননঅরগ্যানিক। অরগ্যানিক যেটা বায়বীয় সার থেকে তৈরি। ননঅরগ্যানিক চা-তে কিছু কিছু কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। পরিবেশগত অবস্থান আবহাওয়া অর্থাৎ রিজিওন বা অঞ্চল, রোপণের সময়কাল এবং প্রস্তুতির যে প্রযুক্তি বা ম্যানুফ্যাকচারিং সেই অনুযায়ী চা-এর বিভিন্ন ধরনের ভাগ হয়।

আরও পড়ুন-গ্রামে থেকে শহরে উত্তরণের দলিল ১৪৪এ, ১৫-১৬য় জয় নিশ্চিত

উৎপাদন অনুযায়ী প্রথমেই গ্রিন টি-র কথা বলা যেতে পারে। এই চা পৃথিবী-বিখ্যাত, যার মধ্যে অক্সিডেশন প্রসেস একেবারেই হয় না। এই চা ফার্মেন্টেড করা হয়। গ্রিন টি-তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে উপাদানটি রয়েছে তা হল উচ্চমানের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যার নাম পলিফেনল। ক্যাটেচিন (catechin) নামক পলিফেনলসের গ্রুপ ভীষণ শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের জোগান দেয়। গ্রিন টি তৈরির ফার্মেন্টেশন পদ্ধতির মাধ্যমে চা-এর মধ্যে সেই অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের পরিমাণ আরও বেশি বাড়িয়ে দেওয়া হয়। শরীরের জন্য যা ভীষণ উপকারী। অক্সিডেশন হয় না বলে এই চায়ের গুণমান সম্পূর্ণ বজায় থাকে। গ্রিন টি-এর পর রয়েছে ইয়েলো টি, ব্ল্যাক টি, ওলং টি, হোয়াইট টি, রুইবোস টি, রেড টি— এই সব নানাধরনের চা।

আরও পড়ুন-MGP-কে নিয়ে গোয়ায় জোট বার্তা মমতার

চায়ের উপকারিতা এবং অপকারিতা
চা অ্যাসিডিক ইন নেচার, তাই চা কখনও খালিপেটে খাওয়া উচিত নয়। অনেকে মনে করেন গ্রিন টি সকালে খালি পেটে খেলে ওজন কমাতে সাহায্য করবে বা শরীর ভাল থাকবে। কিন্তু জেনে রাখা দরকার, কোনও প্রকার চা-ই খালি পেটে খাওয়া উচিত নয়। সারারাতের পর সকালে একেবারে খালি পেটে এমনিতেই অ্যাসিড তৈরি হয়। ওই অবস্থায় চা পান শরীরে অ্যাসিড উৎপাদন আরও বাড়িয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, এর ফলে স্টমাক, কিডনি, লিভার— সবকিছুতেই প্রভাব পড়তে পারে। কখনওই খাবার খেতে খেতে বা জলখাবার খাওয়ার পরেই সঙ্গে সঙ্গে চা পান করা উচিত নয়। সকালে প্রথম চা-টা পান করবার আগে অল্প ভেজানো ছোলা বা অল্প মুড়ি বা দুটো বিস্কুট খেয়ে তবে চা পান করুন। জলখাবারের পনেরো মিনিট পর চা পান করলে বেশি ভাল।

আরও পড়ুন-নবরূপ পেতে চলেছে নয়াচর

চা আমাদের অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের জোগান তো দেয়ই, পাশাপাশি হার্টের রোগ থেকে সুরক্ষা দেয়। এর মধ্যে রয়েছে অ্যামাইনো অ্যাসিড, ফ্ল্যাভানয়েড, যা নাভার্স সিস্টেম, কিডনি ভাল রাখতে সাহায্য করে। চায়ের মধ্যে একটা ঔষধি গুণ রয়েছে ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করে। এছাড়া ডায়াবেটিস, কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ, আর্থ্রাইটিস, স্ট্রোক, ওবেসিটি কমাতে সাহায্য করে।
গ্রিন টি
গ্রিন টি-তে এত পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে যা আমাদের স্ট্রেস রিলিফ করে, উচ্চরক্তচাপের সম্ভাবনা কম করে, চুলের বাড়বৃদ্ধিতে খুব সাহায্য করে। ওজন কমাতে খুব কার্যকরী গ্রিন টি এবং সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হল ইমিউনিটি বুস্ট করতে বা রোগপ্রতিরোধ শক্তিকে বাড়াতে সাহায্য করে। গ্রিন টির আর একটা ভ্যারাইটি হল মাচা গ্রিন টি। গ্রিন টি গুঁড়ো করেই তৈরি হয় মাচা টি। এই চা তুলে নেওয়ার পর মাচার মধ্যে কিছুদিনের জন্য রেখে দেওয়া হয় তাই একে মাচা গ্রিন টি বলা হয়। মাচার মধ্যে রেখে ফার্মেন্ট করে শুকিয়ে গুঁড়িয়ে নেওয়া হয়। এই চা পাউডারের মতো হয়। মাচা টির প্রচুর উপকারিতা। ম্যাগনেসিয়াম, জিঙ্ক, কপার, আয়রন সবকিছুই থাকে এর মধ্যে কিছু কিছু পরিমাণে। মাচা গ্রিন-টির ব্যবহার মূলত হয় ইস্ট এশিয়ায়। ওখানে এই চা তাঁদের জীবনধারার অঙ্গ।

আরও পড়ুন-নতুন বিদেশি নিয়ে ধীরে চলো নীতি, ইস্টবেঙ্গলে শুরু হচ্ছে যোগা ক্লাস

হোয়াইট টি
হোয়াইট টি মূলত কুঁড়ি থেকে হয়। কচি চা গাছ থেকে পাওয়া যায়। দার্জিলিং, শ্রীলঙ্কা, চিনে হোয়াইট টি-এর উৎপাদন হয়। এই চা দাঁত ও মাড়ি সুস্থ রাখতে সাহায্য করে, বোন ডেনসিটি বা হাড়ের ঘনত্ব বাড়াতে সাহায্য করে, ফলে হাড় মজবুত হয়। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস- এর সমস্যা কমাতে খুব সাহায্য করে হোয়াইট টি।
ওলং টি
এই চা ফার্মেন্টেড হয় কিন্তু পুরোপুরি অক্সিডাইস নয়, সেমি অক্সিডাইস। ফ্লেভার খুব ভাল হয়। এর উপকারিতা অসীম। লিকার চা যাঁরা খেতে চান, তাঁদের ব্ল্যাক টি না খেয়ে ওলং টি খাওয়াই উচিত। এই চা গ্রিন টির পরেই আসে। ওলং টি ওজন কমাতে সাহায্য করে। শরীরে রোগপ্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি করে, এর মধ্যে রয়েছে অ্যান্টি এজিং প্রপার্টি যা বয়সের ছাপ কমায়। হার্টের জন্য খুব ভাল ওলং টি।
ব্ল্যাক টি
এদেশে ব্ল্যাক টি বা কালো চা পান করার প্রচলন বেশি। কালো কড়া লিকারে দুধ মিশিয়ে চিনি দিয়ে খেতে পছন্দ করেন বেশি। কিন্তু কালো চা বেশি খাওয়া উচিত নয়, এতে শরীরে ট্যানিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। ট্যানিন হোক বা কাফেইন, যেটাই প্রবেশ করলে শরীরে টক্সিসিটির মাত্রা বেড়ে যায়। এতে গ্যাস ফর্ম করে, অ্যাসিডিটির সম্ভাবনা বাড়ে বিশেষ করে দুধ চায়ে। এছাড়া চিনিও কিন্তু অ্যাসিডিক ইন নেচার তাই চিনি দিয়ে চা খেলে অ্যাসিড বেড়ে যায়। চিনি ছাড়া লিকার বা দুধ চা খেলেও অ্যাসিড অনেক কম হয়। দুধ চা খুব বেশি না ফুটিয়ে আলগাভাবে মিশিয়ে খেলে ক্ষতি অনেক কম। শুধু লিকার চায়ের বদলে লেবু, মধু দিয়ে খেলে উপকার বেশি। চা বারবার গরম করে খাওয়া একেবারেই ঠিক নয়। ট্যানিন শরীরে আয়রন অ্যাবজর্পশন হতে দেয় না। তাই যাঁদের হিমোগ্লোবিন কম, তাঁদের খালি পেটে চা বা খাবার খাওয়ার সঙ্গে চা না খাওয়াই ভাল।

আরও পড়ুন-know the health benefits of different

হার্বাল টি
হার্বাল টি বা ভেষজ চায়ের সব গুণ থাকার পরেও এর কার্যকারিতা বাড়াতে কিছু কিছু হার্বস এই চায়ে ব্যবহার করা হয়। যেমন অশ্বগন্ধা, মূলেঠি, তুলসী, বড় এলাচ এগুলো ব্যবহার করা হয়। হার্বাল টি খাওয়া খুব ভাল। হার্বস ব্যবহার করার মুহূর্তে ওর মধ্যে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের পরিমাণ বেড়ে যায়। শরীরে ট্যানিন ও ক্যাফিন ইত্যাদির প্রভাব কমে যায়। শুধু কড়া লিকার চা না খেয়ে একটু লেবু বা অল্প মধু, অথবা আদা দিয়ে খেলে অনেক উপকার পাবেন।
টি ব্যাগ
অনেকে টি ব্যাগ-এর চাও পান করেন, যেটা উচিত নয়। গ্রিন টির ক্ষেত্রে বিশেষ করে টি ব্যাগ নিলে তা উচ্চমানের একেবারেই হয় না। এছাড়া টি ব্যাগে একটা কেমিক্যাল দেওয়া হয় ব্যাগটা ঠিক রাখার জন্য। ওই টি ব্যাগ যখন গরম জলে ডোবানো হয়, তার টক্সিন এফেক্ট অনেক বেশি হয়।
স্যালন টি
শ্রীলঙ্কার হাইল্যান্ড বা উচ্চভূমিতে এর উৎপাদন। এর মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এই চা ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করে, ওজন কমাতে খুব সাহায্য করে। হার্টকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। কিডনির সমস্যা থাকলে গ্রিন টি খাওয়া যেতে পারে।
আর্ল গ্রে টি
এই চা ফ্ল্যাভার অয়েল বারগামট (এক ধরনের লেবু জাতীয় ফলের তেল)-এর সঙ্গে ব্ল্যাক টিকে ব্লেন্ড করে তৈরি করা হয়। তবে এই চা বেশি না খাওয়াই ভাল, কারণ বেশি খেলে ত্বকের সমস্যা এবং পেশির শিথিলতা দেখা দেয়।
আইস টি
এটা একধরনের পাউডার চা যা নানা ফ্লেভার যেমন- আপেল, লেবু, পিচ,অরেঞ্জ, স্ট্রবেরি, চেরির সঙ্গে মিলিয়ে প্যাকেটে পাওয়া যায়। এর সঙ্গে বরফ, ঠান্ডা জল মিশিয়ে খাওয়া যায়। রিফ্রেশিং ড্রিঙ্ক বা পানীয় হিসেবে অনেকেই এই চা পান করতে ভালবাসেন।

Latest article