লক্ষ্মী এবং শ্রী। সম্পদ ও সমৃদ্ধির দেবী। ধনৈশ্বর্য প্রদান করেন। সৌভাগ্যদায়িনী।
এমনটাই তো জেনে এসেছি এতদিন।
কিন্তু এখন?
কী আশ্চর্য! ঋক্ বেদে শ্রী কিংবা লক্ষ্মী, কোনও শব্দটাই সৌভাগ্যদেবী অর্থে ব্যবহৃত হয়নি।
ঋক্ বেদে ‘শ্রী’ শব্দটা কম করে ৮১ বার ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু কোত্থাও ‘শ্রী’ সৌভাগ্যের দেবী নন। অষ্টম মণ্ডলের দ্বিতীয় সূক্তে আছে ‘অশ্রীর ইব জামাতা’। অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ তার অর্থ করেছেন ‘কুৎসিত জামাতার ন্যায়’। সকালবেলা দিনের আলো থাকতে থাকতে জামাই কেন শ্বশুরবাড়ি যায় না, কেন সে সন্ধের আঁধার নামলে তবেই সেখানে যায়, এই প্রসঙ্গে সূক্তটি বলতে চেয়েছে, জামাই বাবাজীবন কুৎসিত বলেই, কুশ্রী হওয়ার কারণেই, অন্ধকারে তার যাতায়াত। অর্থাৎ শ্রী শব্দটা এখানে সমৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। দরিদ্র্য বা বিত্তশালী বোঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়নি। এটার প্রয়োগ শোভাময় বা সৌন্দর্যবান অর্থে। সৌন্দর্যবান নয় বলেই জামাতা ‘অশ্রী’।
আরও পড়ুন-লক্ষ্মী মেয়ের আজ কোনও লক্ষ্মণরেখা নেই
অথর্ববেদেও ‘লক্ষ্মী’ শব্দটি পাওয়া যায়। সেই লক্ষ্মী কখনও ভাল, কখনও মন্দ। ৭.১১৫.১ নং সূক্তে লক্ষ্মীকে পাপী লক্ষ্মী বলা হয়েছে, ‘প্র পতেতঃ পাপি লক্ষ্মী নশ্যেতঃ প্রামুতঃ গত’। আবার, খানিক পরেই, ৭.১১৫.৪ নং সূক্তে পূণ্যা লক্ষ্মীর প্রসঙ্গ উঠেছে। ‘রমন্তাং পুন্যা লক্ষ্মীর্যাঃ পাপীন্তা অনীনশম্’।
সুতরাং, মোদ্দা কথা হল, বেদে লক্ষ্মী সৌভাগ্য, সম্পদের সঙ্গে সম্পর্কিতা নন। তিনি বরং দেহসৌন্দর্য, পাপ এসবের সঙ্গে সৎযুক্ত হতে পারেন।
এই লক্ষ্মীকে Abstract Noun থেকে সরে এসে Proper Noun হিসেবে পাই শতপথ ব্রাহ্মণে। গুণবাচক বিশেষ্য যখন নামবাচক বিশেষ্য হল, তখন লক্ষ্মী শরীরী রূপ ধারণ করলেন। শতপথ ব্রাহ্মণের ১১.৪.৩.১ শ্লোকে সেই কথাটি বিবৃত হল।
আরও পড়ুন-ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পে দ্বিতীয়, প্রথম হওয়ার যুদ্ধে রাজ্য, সর্বাধিক কর্মসংস্থান
প্রজা সৃষ্টির জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মা তপস্যায় বসেছিলেন। তপস্যা করতে করতে তিনি যখন ক্লান্ত হয়ে পড়লেন, তখন তাঁর শরীর থেকে বেরিয়ে এলেন শ্রী। শ্রী যখন প্রজাপতি তপঃক্লিষ্ট শরীর সঞ্জাত হলেন, তখন তাঁর শরীর তিরতির করে কাঁপছিল। তা বলে তাঁর জ্যোতির্প্রভা এতটুকু কমেনি। কম্পমানা শ্রীর জ্যোতিষ্মতী মূর্তি দেখে তাঁকে পাওয়ার জন্য দেবতার দল ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। তাঁরা শ্রীকে মেরে তাঁর সম্পদগুলো আত্মসাৎ করতে চান। প্রজাপতির কাছে সেই আর্জি পেশ করেন তাঁরা।
প্রজাপতি বলেন, স্ত্রী হত্যা অন্যায়। সুতরাং দেবতারা স্ত্রীকে প্রাণে না মেরে বরং তাঁর সম্পদগুলো নিয়ে নিন।
আরও পড়ুন-ত্রিকোণ প্রেম! হরিদেবপুরের যুবক খুন, আটক বান্ধবী
দেবতার দল তাতেই খুশি। সেইমতো তাঁরা শ্রী-র সম্পদগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিলেন। অগ্নি নিলেন অন্ন, বরুণের ভাগ্যে জুটল সাম্রাজ্য, ইন্দ্র পেলেন বল, ত্বষ্টা পেলেন রূপ, বৃহস্পতি কবজা করলেন ব্রহ্মার বচন, এমনকী সরস্বতীর ভাগ্যেও জুটল শ্রীর ঐশ্বর্য।
সম্পদ হারিয়ে ব্যাকুল শ্রী বলে উঠলেন, প্রজাপতি, এরা তো আমার সবকিছু নিয়ে নিল। আমাকে রিক্ত করে দিল।
প্রজাপতি শ্রীর দুঃখ বুঝলেন। তাই তাঁকে বললেন, যজ্ঞেনৈনান্ পুনর্যাচস্ব। অর্থাৎ, চিন্তার কিছু নেই। যজ্ঞের মাধ্যমে শ্রী হৃত সম্পদের সবকিছুই ফিরে পাবেন।
শ্রী এই বর পেয়েই খুশি।
আরও পড়ুন-মালবাজারের ঘটনার প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্টে উঠে এল তথ্য
তা বলে, দেবতারাই যে কেবল শ্রী ও তাঁর সম্পদ পেয়েছিলেন, এমনটা নয়। পুরাণ বলছে, দানবরা যখন ধার্মিক ছিল, তখন তারাও শ্রীকে পেয়েছিল। ক্রমে তারা অহঙ্কারের চরম সীমায় পৌঁছে যায়। পাপাচারে মেতে ওঠে। শ্রী তখন তাদের ছেড়ে চলে যান। এই জন্যই শ্রী ইন্দ্রকে উপদেশ দেন, যেকোনও কাজে সফল হতে হলে চরিত্রবল থাকাটা জরুরি। চরিত্রবলেই কৃতকার্য হওয়া সম্ভব। দুশ্চরিত্র হলেই শ্রীহীন হতে হয়।
এসব কাহিনির ভেতরকার তাৎপর্য খুব স্পষ্ট। মানুষ যা যা আকাঙ্ক্ষা করে, যা যা পেতে চায়, শ্রীলক্ষ্মী সে সবকিছুরই দেবী। তবে চরিত্রহীন হলে শ্রীহীন হতে হয়।
একসময় এই লক্ষ্মীশ্রী সমুদ্র গর্ভে চলে গিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন-বলি থেকে টলি বয়কট ট্রেন্ডে নাকাল সবাই
দুর্বাসা মুনি অপমানিত হয়ে সেবার ইন্দ্রকে অভিশাপ দেন। সেই অভিশাপের ফলে ইন্দ্র শ্রীহীন লক্ষ্মীছাড়া হয়ে পড়েন। লক্ষ্মী তাঁকে ছেড়ে সমুদ্রের তলায় আশ্রয় নেন। তাঁর অন্তর্ধানে পৃথিবী শস্যহীন হয়ে পড়ে। সমুদ্র মন্থনের ফলে ফের লক্ষ্মীশ্রী শ্বেতবস্ত্র পরে সাগর থেকে উঠে আসেন। তখন থেকেই শ্রীময়ী লক্ষ্মী সুখ-সমৃদ্ধির অধিষ্ঠাত্রী দেবী। তাঁকে লাভ করার জন্য দেব-দানবের ভয়ানক যুদ্ধ হয়েছিল।
রাম যখন অগস্ত্য মুনির আশ্রমে গিয়েছিলেন, তখন সেখানে আঠারোজন দেবদেবীর মন্দির দেখতে পেয়েছিলেন। মন্দিরগুলোতে আঠারোজন দেবদেবীর মূর্তিও ছিল। নারদ তাঁকে বলেছিলেন, তিনি নিজে এই দেবদেবীর পুজো করেন। অন্যদেরও ওইসব দেবদেবীর পূজা অর্চনা করার উপদেশ দেন নারদ। ওই অষ্টাদশ দেবদেবীর মধ্যে লক্ষ্মীও ছিলেন।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের প্রকৃতি খণ্ডে এই লক্ষ্মীদেবীর অন্য কাহিনি বর্ণিত। সেখানে প্রকৃতি কৃষ্ণের আদেশে পঞ্চমূর্তিতে বিভাজিত হয়। এই পঞ্চমূর্তি হল দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, সাবিত্রী এবং রাধা।
আরও পড়ুন-আটমাসের শিশুকন্যা-সহ ভারতীয় বংশোদ্ভূত চারজনকে অপহরণ করে খুন
এসব বৈদিক পৌরাণিক মহাকাব্যিক গালগল্পের বাইরে গিয়ে মহাভারত অন্য কথা শুনিয়েছে। ১৩.৪৬.১৫ নং শ্লোকে মহাভারতকার জানাচ্ছেন, নারী নিজেই দেবত্বের প্রতিমূর্তি। সেজন্যই শ্রী আদতে স্ত্রী। অন্য কেউ নন।
এই জানাটাই বাস্তববুদ্ধি সম্মত। এই জানাটায় দ্বিমত হওয়ার সুযোগও কম।
কিন্তু এই যে কোজাগরী পূর্ণিমার লক্ষ্মী পুজো, এর পেছনের গল্পটা কী?
এক যে ছিল রাজা। সে রাজা ছিল ভারি দয়ালু। তিনি আদেশ জারি করেন যে তাঁর রাজ্যের বাজারে কিছু বিক্রি না হলে তিনি নিজেই তা ন্যায্য মূল্যে কিনে নেবেন। বাজারে এক কর্মকার একদিন লোহার তৈরি একটা মেয়ে পুতুল নিয়ে এল। সেটা বিক্রি হল না। রাজা নিজের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মেয়েপুতুলটা কিনে নিলেন।
আরও পড়ুন-প্রস্তুতি তুঙ্গে, আজ শোভাযাত্রা কলকাতার রাজপথে
সন্ধ্যা নামল। রাজা শুনতে পেলেন, তাঁর ঠাকুরঘর থেকে একটা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। রাজা সেখানে গিয়ে দেখেন, এক পরমা সুন্দরী কন্যা সেখানে হাপুস নয়নে কাঁদছে। তাকে জিজ্ঞেস করে রাজা জানতে পারলেন, সেই কন্যেটি আর কেউ নয়, সে হল রাজলক্ষ্মী। রাজলক্ষ্মী সেদিন রাজ্য ছেড়ে চলে যাবেন বলে মনস্থ করেছেন। তাই তিনি কাঁদছেন। রাজা অলক্ষ্মীকে ঘরে তুলেছেন। তাই-ই তাঁর এই সিদ্ধান্ত।
যাওয়ার আগে রাজ্যলক্ষ্মী রাজাকে বর দিয়ে গেলেন যে তিনি কীট পতঙ্গ, পশু পাখি, এদের কথা বুঝতে পারবেন। কিন্তু সেকথা অন্যকে বললে তাঁর মৃত্যু অনিবার্য।
পরদিন রাজাকে ছেড়ে গেলেন ভাগ্যলক্ষ্মী। তাঁরও যাওয়ার কারণ ওই একই। রাজা অলক্ষ্মীকে ঘরে এনেছেন। তাই তিনি চলে যাচ্ছেন।
একই কারণে রাজাকে ত্যাগ করলেন যশোলক্ষ্মী। তারপর কুললক্ষ্মী।
আরও পড়ুন-বন্দে ভারত এক্সপ্রেসে ধাক্কা খেল মোষের পাল
কুললক্ষ্মীর সঙ্গে রাজ্য ত্যাগ করছিলেন ধর্মরাজ। রাজা তাঁকে বললেন, “আপনি যেতে পারেন না। আমি আমার দেওয়া কথা রাখতে অলক্ষ্মীকে কিনে প্রাসাদে এনেছি। ধর্ম ত্যাগ করিনি বলেই অলক্ষ্মীস্বরূপা লোহার মেয়ে মূর্তিটি ছাড়তে পারিনি। প্রতিজ্ঞা পালন করেছি। সুতরাং আর যাই হোক, আপনি যেতে পারেন না।”
ধর্মরাজ দেখলেন, রাজার কথায় যুক্তি আছে। তিনি যেতে পারলেন না।
রাজা দিন দিন গরিব হতে থাকেন। তরকারিতে ঘি খাওয়াও বন্ধ করে দেন দারিদ্র্যের কারণে। একদিন শুনলেন, তাঁর পাতের কাছে ভিড় করা পিঁপড়ের দল নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে, আহা! গরিব রাজার কত কষ্ট। অলক্ষ্মী কিনে এমন অবস্থা যে ভাগ্যে ঘিও জোটে না।
পিঁপড়েদের কথা শুনে রাজা হেসে ফেলেন। রানি রাজার হাসির কারণ জানতে চান। রাজা বলেন, সে কথা বলা যাবে না। বললে আমার মৃত্যু হবে। রানি তবু নাছোড়বান্দা। রাজা বলেন, তবে চল গঙ্গার তীরে। সেখানেই সবটা বলব।
গঙ্গার তীরে পৌঁছে রাজা শোনেন, একটা ছাগলি ছাগলকে বলছে, ওই দ্যাখ! গঙ্গায় এক গোছা ঘাস ভেসে যাচ্ছে। আমাকে ঘাসটা এনে দে। মনের সুখে খাই।
আরও পড়ুন-প্রাকৃতিক বিপর্যয় নিয়ে বিজেপির ঘৃণ্য রাজনীতি
ছাগলটা উত্তর দেয়, খেপেছিস? অগাধ জলে ঘাস ভেসে যাচ্ছে। আনতে গিয়ে শেষে মরব নাকি আমি! আমি তো আর রাজার মতো বোকা নই, যে মেয়েমানুষের কথায় জীবন দেব।
ছাগল ছাগলির সংলাপ শুনে রাজা রানিকে সেখানে ফেলে ফিরে আসলেন প্রাসাদে।
রানি কেঁদে কেঁদে গঙ্গাতীরের জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে বেড়ান। একদিন শোনেন জঙ্গলের ভেতরে শাঁখ বাজছে। কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজ আসছে। রানি সেদিকে এগিয়ে যান। গিয়ে দেখেন, একদল ঋষিকন্যা পিটুলি দিয়ে মূর্তি গড়ে সেটির পুজো করছে। মূর্তিটি লক্ষ্মীদেবীর। নৈবেদ্য হিসেবে তারা সাজিয়ে দিয়েছে চিঁড়ে, নারকেল, পাটালি ইত্যাদি।
রানি জানতে চান, ঋষিকন্যারা কীসের পুজো করছে?
আরও পড়ুন-পুলিশের প্রশ্নে চুপসে গেলেন সৌমেন্দু
ঋষিকন্যারা রানিকে জানায়, এ হল আশ্বিন মাসের কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষ্মীর পুজো। এদিন লক্ষ্মী পুজো করে রাত জাগতে হয়। রাতে লক্ষ্মীদেবী বরদা হয়ে বলেন, কে জেগে আছ? যে জেগে থাকে, তাকেই তিনি বর প্রদান করেন। নিশীথে বরদা লক্ষ্মীঃ কো জাগর্তীতে ভাষিনা।
তস্মৈ বিত্তং প্রযচ্ছামি অক্ষৈঃ ক্রীড়াং করোতি যঃ।।
ঋষি কন্যাদের কথা শুনে রানি সেদিন পিটুলি দিয়ে লক্ষ্মীঠাকুর গড়ে রাত জেগে মা লক্ষ্মীর পুজো করলেন। সেই পুজোর কারণে, রাজার প্রাসাদ থেকে অলক্ষ্মী নিজে নিজেই চলে গেলেন। একে একে ফিরে এলেন রাজ্যলক্ষ্মী, ভাগ্যলক্ষ্মী, যশোলক্ষ্মী, কুললক্ষ্মী, সবাই। এমনকী রানিও।
সেই থেকে পৃথিবীতে কোজাগরী লক্ষ্মীর পুজো প্রচারিত হল।
কোজাগরী নামের মাহাত্ম্য বর্ণনায় ওই যে অক্ষ ক্রীড়ার কথা বলা হয়েছে, সেটা কী?
স্বামী নির্মলানন্দ বলছেন, মূর্খরা পাশা খেলে রাত জাগে। তাদের কাছে অক্ষ হল পাশা।
বণিকরা ব্যবসার চিন্তায় কোজাগরীর রাজ জাগে। তাদের কাছে অক্ষ মানে ক্রয়বিক্রয় চিন্তা।
আরও পড়ুন-নৌকাডুবি, মৃত ১৫
আর শুদ্ধচিত্ত ব্যক্তিরা জপমালা নিয়ে জপ করে কোজাগরীর রাত কাটান। তাঁরা ‘কোজাগর্তি’র অর্থে বোঝেন, অত্মার দিক থেকে যিনি জাগ্রত থাকেন, তিনি মোক্ষরূপ শ্রেষ্ঠ বর পাওয়ার অধিকারী। তাই তাঁদের কাছে অক্ষ মানে রুদ্রাক্ষ, জপমালা।
এহেন লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে প্যাঁচা জুড়ে গেল কেমন করে?
রোমে শিল্প ও বিদ্যার দেবী ছিলেন মিনার্ভা। মিনার্ভার হাতে থাকত একটা প্যাঁচা। রোমক মিথোলজিতে প্যাঁচা জ্ঞানের প্রতীক হিসেবে স্বীকৃত। কোজাগরীর রাতে জপমালা জপধ্যান করে যাঁরা রাত কাটান, তাঁরা যে বিদ্যা-জ্ঞানের আরাধনা করেন, প্যাঁচা বস্তুত তারই প্রতীক।
স্থান-কাল-পাত্রের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চিন্তা ভাবনাও বদলে যায়। লক্ষ্মীর বাহনের ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটেছে।
প্রথম চন্দ্রগুপ্ত, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ও কুমারগুপ্তের কিছু কিছু মুদ্রায় লক্ষ্মীর বাহন সিংহ। বৃহৎ স্তোত্ররত্নাকরে মাধব ব্যাস আথর্বণ রহস্য থেকে যে লক্ষ্মীমন্ত্র উদ্ধার করেছেন, সেটাতেও লক্ষ্মী সিংহবাহনা।
আরও পড়ুন-সঙ্কটজনক মুলায়ম
গুপ্তোত্তর যুগের রাজা শশাঙ্ক। তাঁর সুবর্ণমুদ্রায় লক্ষ্মীর বাহন হাঁস।
কুমারগুপ্তের কোনও কোনও মুদ্রায় লক্ষ্মী ময়ূরকে খাবার দিচ্ছেন। আবার কোনও কোনও মুদ্রায় লক্ষ্মীর হাতে পদ্ম, সামনে একটা ময়ূর দাঁড়িয়ে আছে।
কালান্তরে দেখা গেল, দেবী দুর্গা লক্ষ্মীর কাছ থেকে সিংহকে নিয়ে নিয়েছেন। কার্তিক কেড়ে নিয়েছেন ময়ূর আর সরস্বতী হাঁস।
শেষে দেবী লক্ষ্মী পেচকবাহনা হয়েছেন।
কৃষির উদ্ভাবক অস্ট্রিকরা শস্যরক্ষার কারণে প্যাঁচাকেই তাদের শস্য দেবতা বলে ভাবতে শুরু করেছিল। প্যাঁচা নিশাচর, রাত্রিকালে তীক্ষ্মচক্ষু এবং ইদুঁর ও পোকামাকড়ের চরম শত্রু। প্যাঁচাই তাই ফসলের অবৈতনিক রক্ষক। এজন্যই ধান্যরূপা লক্ষ্মীর সঙ্গে প্যাঁচাকে এক করে দেখা হয়েছে। অনার্য সমাজ তাদের জীবনের পক্ষে শুভদায়ী টোটেম-প্রতীকগুলোকে আস্তে আস্তে দেবতায় রূপান্তরিত করে নিয়েছিল। এই zoomorphic বিবর্তনের কারণেই সম্ভবত কুষাণযুগে প্যাঁচার মূর্তি একটি অন্যতম শিল্প নিদর্শন। এটি বর্তমানে এলাহাবাদ মিউজিয়ামে রাখা আছে।
আরও পড়ুন-বারাসতে কার্নিভাল আজ বিকেলে
এখন, যে কোনও প্যাঁচাই তো আর লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে অন্বিত হতে পারে না। কালপ্যাঁচা বা hawk owl কর্কশ স্বরে আর্তনাদের মতো ডাক ছাড়ে। Spotted owl গাছের বা দেওয়ালের কোটরে বাস করে। বড় আকারের পাটকিলে রঙের brown fish owl বা হুতোম প্যাঁচা ভয়ানক রবকারী। তাই, তাই-ই, ওগুলোকে ছেড়ে লক্ষ্মী প্যাঁচাকেই মা লক্ষ্মীর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল।
এর পেছনে তিনটে কারণ স্পষ্ট।
প্রথমটা আগেই বলা হয়েছে। ইঁদুর ভক্ষণকারী প্যাঁচা কৃষিজীবী মানুষের প্রিয় পাখি। জুমর্ফিক নীতিতে সেই প্যাঁচা প্রাণীদেহী দেবতা লক্ষ্মীতে উন্নীত হল।
দ্বিতীয়ত, লক্ষ্মীর মূর্তি কল্পনায় দেবীকে রূপের সর্বশ্রেষ্ঠ আধার হিসেবে তুলে ধরার লক্ষ্যে contrasting প্রেক্ষাপট হিসেবে কদাকার প্যাঁচাটাকে তাঁর পাশে জায়গা করে দেওয়া হল।
আরও পড়ুন-জলপাইগুড়িতে বাতিল করা হল কার্নিভ্যাল
তৃতীয়ত, লক্ষ্মী প্যাঁচা সাদা। ‘সর্ব দোষ হরে গোরা।’ সেই নীতি মেনে শ্বেতবর্ণের লক্ষ্মীপ্যাঁচাই হল সুন্দরীতমা দেবীর কুৎসিৎ বৈপরীত্য প্রকাশক বাহন।
১৮২৪-এ কলকাতায় এসেছিলেন ফ্যানি পার্কস। তিনি খবর পেলেন, এলাহাবাদে একটা লটারি হচ্ছে। বিজয়ী প্রাইজ হিসেবে পাবে ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করা একটা চেস্টনাট ঘোড়া। ফ্যানি ওই লটারির টিকিট কাটলেন শ্রী ও সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মীকে মনে মনে স্মরণ করে। চেয়েছিলেন, তাঁর আস্তাবলে চেস্টনাটের ঘোড়াটা লক্ষ্মী হয়ে থাকুক।
এসব কথা তিনি নিজেই লিখে গিয়েছেন তাঁর ‘ওয়ান্ডারিংস অফ আ পিলগ্রিম ইন সার্চ অফ পিকচারেস্ক’বইতে।
অর্থাৎ, শুধু বঙ্গ মননে নয়, কেবল ভারতীয় হিন্দু চিন্তনে নয়, সম্পদ পেতে গেলে লক্ষ্মীর শরণাপন্ন হতে হয় বুঝেছেন বিদেশিনীও।
লক্ষ্মীকে, শস্যকে, ধানকে, ধনকে নিয়ত রক্ষা করছে বলে প্যাঁচাও গুটিগুটি পায়ে তাঁর পায়ের কাছটাতে বসেছে।
আর ওদিকে দাশরাথি রায় গেয়ে চলেছেন,
“ঘুমে লক্ষ্মী হন বিরূপা
জাগরণে লক্ষ্মীর কৃপা
নৈলে কেন জাগে কোজাগরে।’’