ছায়া

অতি কষ্টে চোখ খুলে ঝর্না দেখল তার চারপাশে চাপ চাপ অন্ধকার। বিনবিন করে মশা ওড়াউড়ি করছে। ঝুপসি অন্ধকারে কোনও কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।

Must read

দেবেশ মজুমদার: অতি কষ্টে চোখ খুলে ঝর্না দেখল তার চারপাশে চাপ চাপ অন্ধকার। বিনবিন করে মশা ওড়াউড়ি করছে। ঝুপসি অন্ধকারে কোনও কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। অন্ধকারের একটা চাদর যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে ওকে। চোখটা টনটন করছে। একটানা তাকিয়ে থাকা যাচ্ছে না। নিশ্চয়ই সন্ধে হয়ে গেছে আর দরজা-জানলাগুলো বন্ধ, নাহলে ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে সামান্য হলেও আলো আসত। ভয় করছিল ঝর্নার। অন্ধকার ঘরে থাকতে ভীষণ ভয় করে ওর! ভূতের ভয়! ভুতের কথা ভাবতেই শিরদাঁড়া দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল।

আরও পড়ুন-আধার যুক্ত করার কাজ হবে এই মাসেই

ঝর্না উঠে বসার চেষ্টা করতেই টের পেল কোমর থেকে পায়ের পাতা অবধি অসহ্য যন্ত্রণা, নড়াচড়া করা প্রায় অসম্ভব। এদিকে অন্ধকার ঘরে থাকতেও ভয় করছে। শরীরের সমস্ত শক্তি একজায়গায় করে যতবার উঠার চেষ্টা করছিল ততবারই ব্যর্থ হচ্ছিল। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল ঝর্না। অগত্যা আবার শুয়ে পড়ল। কপালের টনটনে জায়গাটায় হাত দিতেই কেমন যেন চটচটে রসে ডুবে গেল হাতটা। হাতটা সরিয়ে আনল ঝর্না। আঁঠালো তরলের স্পর্শটাও হাতে লেগে আছে। আঁশটে একটা গন্ধ নাকে আসছে ওর। আবার হাতটা নিয়ে গিয়ে কপালে দিতেই বুঝল জায়গাটা দগদগ করছে। কে জানে কতটা রক্ত বেরিয়েছে। শরীরের নিচে শক্ত মেঝেটাও চটচটে আঁঠা আঁঠা হয়ে আছে। ঝর্না আন্দাজ করার চেষ্টা করল বাড়ির ঠিক কোন জায়গাটায় ও আছে। আলকাতরার মতো ঘন অন্ধকারে সেটাও ঠাহর করতে পারছিল না।

আরও পড়ুন-জাতীয় নির্বাচন কমিশনের নয়া সদস্য হলেন অরুণ গোয়েল

সঞ্জয় আর তার মা-বাবা মিলে যখন আচমকা ওর উপর চড়াও হল, তখন ও রান্নাঘরে। সবে ডালটা চড়িয়েছে। চড়, থাপ্পড়, কিল, ঘুসি তো ছিলই, সেটা রোজকার ব্যাপার, যেটা নতুন সেটা হল দরজার খিল দিয়ে পেট, কোমর, পা, পিঠ ও ঘাড়ে দমাদ্দম নাগাড়ে পিটুনি সঙ্গে গালিগালাজ তো ছিলই। সার শরীর আঘাতে আঘাতে কালশিটে পড়ে যাচ্ছিল। জ্বালা-যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠেছিল ঝর্না। সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তিন জনের ক্ষমতার সঙ্গে ও এক এঁটে উঠেনি। তবে এসব অবশ্য বেশিক্ষণ ঝর্নাকে সহ্য করতে হয়নি। ওই রকম অমানুষিক মারের চোটে একটু পরেই নিচু মশলার তাকের কোণায় কপালটা সজোরে ঠুকে গেছিল। ব্যাস্, তারপর তার আর কিচ্ছু মনে নেই।

আরও পড়ুন-প্রয়াত বাবু মানি

হালকা একটা পোড়া গন্ধ নাকে আসছে। দুপুরের ডালটা কি? তাহলে এটা সম্ভবত এটা রান্নাঘরই। তবে বাড়িতে যে কেউ নেই সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে। ঝুঁঝকো অন্ধকারে পুরো বাড়িটা নিঝুম। তার মানে তাকে ওই অবস্থায় ফেলেই সঞ্জয় এবং তার শ্বশুর-শাশুড়ি পালিয়েছে! হয়তো ভেবেছিল সে মরে গেছে। সর্বাঙ্গে তীব্র ব্যথা নিয়েও অনেক কষ্টে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল ঝর্না। অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে। দেওয়াল হাতড়ে হাতড়ে সুইচবোর্ড খুঁজে আলো জ্বালতে গিয়ে দেখল কোনও লাভ নেই। হয় লোডশেডিং নয়তো ইলেকট্রিকের লাইনটা ওরা কেটে দিয়ে গেছে।
বছরখানেক আগেই বর্ধমানের কাছে তালিত অঞ্চলের এই ফাঁকা জায়গায় সঞ্জয় বাড়িটা করেছিল। বাড়ি মানে দুটো টালির ঘর, একটা রান্নাঘর আর একটা বাথরুম–পায়খানা। চতুর্দিক শুনশান, কেবল গাছপালা আর পানাপুকুর। জনবসতি এখনও নামমাত্র এই এলাকায়। গাছপালার মাঝাখানে ফাঁকা জায়গাটা বেশ ভাল লাগত ঝর্নার। জানালার বাইরের আম গাছটায় অনেক রকমের পাখি আসত। সকালে-বিকেলে ওদের কলকলানিতে ওর মন ভাল হয়ে যেত। ভুলে যেত সঞ্জয়ের গালিগালাজ, মারধর আর শাশুড়ির গঞ্জনাকে।

আরও পড়ুন-আধার ও স্বাস্থ্যসাথী ছাড়াই লক্ষ্মীর ভাণ্ডার

তালিতের বাড়িটা করার আগে সঞ্জয়রা বর্ধমান শহরে একটা ভাড়া বাড়িতে থাকত। ওই বাড়ির লাগোয়া একটা ফ্ল্যাটবাড়িতে প্রায়ই ইলেক্ট্রিকের কাজ করতে যেত সঞ্জয়। সেখানে আবার ঝর্নাও এক বুড়ির কাছে আয়ার কাজ করত। বাড়িতে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরি করত। সারাদিন বুড়িটাকে নিয়েই কেটে যেত ঝর্নার। সঞ্জয় ইলেক্ট্রিকের কাজ করতে এলে বাড়িতে কেউ না থাকলে ঝর্না ওর কাজে সাহায্য করত। ধীরে ধীরে ওরা দুজন দুজনকে ভালবেসে ফেলে। তার পর যা হয়… মাধ্যমিক পাশ ঝর্নার মনে হয়েছিল তার অকর্মণ্য, মাতাল, বৌ-মেয়ে পেটানো বাপের হাত থেকে নিস্তার পেতে গেলে সঞ্জয়ের হাত ধরা ছাড়া উপায় নেই! কিন্তু পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার পর সঞ্জয়ের বস্তির বাড়িতে এসে বুঝল সব সংসারই আদতে অচল টাকার এপিঠ আর ওপিঠ! নিত্যি তাকে উঠতে-বসতে গঞ্জনা দিত শাশুড়ি-শ্বশুর। সে ভিখিরির মতো কানাকড়িও না দিয়ে তাদের সোনার ছেলের বৌ হয়ে এসেছে! লজ্জা থাকলে সে যেন অবিলম্বেই বাপের কাছ থেকে টাকাপয়সা, গয়নাগাটি, জিনিসপত্র নিয়ে আসে ইত্যাদি ইত্যাদি। তারা সঞ্জয়কে ওসকাতেও ছাড়ত না এবং বলাই বাহুল্য, সঞ্জয় তাদের দল ভারী করে বাধ্য ছেলের মতো দু-চার ঘা লাগিয়ে তাদের যোগ্য সঙ্গত করত। সঞ্জয়কে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু পারেনি। উপরন্ত দিন দিন ওর ভালবাসার মানুষটাকে কেমন অপরিচিত লাগত। বেঁচে থাকার জন্য গরিবের গলার জোর আর খিস্তিই ভরসা। সেসবের জোরেই ঝর্না যাবতীয় চাপ ঠেকিয়ে রেখেছিল এতদিন। কিন্তু শেষরক্ষা বুঝি হল না।

আরও পড়ুন-বীরবাহার জুতো ধরে ক্ষমা চান শুভেন্দু

শরীরটাকে হিঁচড়ে দরজার কাছে এল ঝর্না। একবার ঠেলতেই দরজা খুলে গেল। যন্ত্রণার মধ্যেও তার ঠোঁটে ব্যঙ্গের হাসি খেলে গেল। তাহলে ওরা পাকাপাকি ভাবেই পালিয়ে গিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। এত ভয় ওর মতো একটা তুচ্ছ মেয়েকে। ঝর্না একবার ভাবল চিৎকার করে কাউকে ডাকবে। কিন্তু শুনবে কে? সে বুঝতে পারছে এখনই থানায় যাওয়া উচিত। তিনজন কোনও রকম শাস্তি ছাড়াই বেঁচে থাকবে, এ হতে দেওয়া যায় না। কিন্তু এই শরীরটা নিয়ে সে অতদূর যেত পারবে কি? আচমকা ও দেখল রাস্তার মিটমিটে আলোর মধ্যে দিয়ে কে যেন ওর বাড়ির দিকেই আসছে। কে রে বাবা! সঞ্জয় নাকি? দেখতে আসছে ও মরে গেছে না বেঁচে আছে? রাস্তায় আলো কম থাকলেও আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। লোকটা এগিয়ে আসছে ওর দিকে। ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে তার অবয়ব। ধীরে ধীরে আরেকটু কাছে এলে ও দেখল সঞ্জয় নয়, তবে বেশ চেনাই একজন। কিন্তু কে? কিছুতেই মনে করতে পারছে না!

আরও পড়ুন-কেন বিশ্বকাপ, এখন বুঝছি, আজ সন্ধে সাড়ে ৭টায় উদ্বোধন এই আল বায়েত স্টেডিয়ামে

আচমকা ঝর্নার মনে পড়ে গেল লোকটার নাম। বিনোদ! সঞ্জয়ের ফোনে একটা ভিডিওতে সে একে কয়েকবার দেখেছে। সাইকেল চুরির অপরাধে কিছু লোক তাকে প্রচণ্ড মারছিল…আর সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে হাতজোড় করে তাদের কাছে কেঁদে-কেঁদে প্রাণভিক্ষা করছিল…তা সত্ত্বেও কারও মায়া হয়নি। সেই লোকগুলো ওকে নৃশংস ভাবে পিটিয়ে-পিটিয়ে একেবারে মেরেই ফেলল! এই চূড়ান্ত অমানবিক ঘটনার পুরোটা রেকর্ড করে সেটা ছড়িয়ে দিয়েছিল কেউ। ভিডিওটা দেখে খুব কষ্ট হত ঝর্নার। বিনোদের ওই রক্তমাখা মুখটা ভুলতে পারেনি।

আরও পড়ুন-বিদ্যালয়ে গিয়ে ক্লাস নিলেন বিডিও

বিনোদ প্রায় তার সামনে চলে এসেছে। ধবধবে জ্যোৎস্নায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তার ঠোঁটের কষ বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে, যেমনটা ওই ভিডিওতে তার মুখে দেখা যাচ্ছিল। ঝর্না আতঙ্কে পাথর হয়ে গেল। গলা দিয়ে আওয়াজ বের করার শক্তিটুকু পর্যন্ত যেন লোপ পেয়েছে! কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। কিন্তু…কিন্তু…কী আশ্চর্য, বিনোদের চোখে তো রিরংসার ছিটেফোঁটাও নেই! ছলছলে চোখে বরং গভীর সমবেদনার ছাপ। সে পরম মমতায় ঝর্নার দিকে তার হাত বাড়িয়ে দিল। কেন কে জানে, ঝর্নার আর ভয় করছিল না। ভুল হোক বা ঠিক, তার আবারও মনে হচ্ছিল বিনোদের হাত ধরে চলে যায়। এই বাড়িতে তো তার জন্য আর কিছুই পড়ে নেই। তার কথা ভাবারও কেউ নেই। জানলা দিয়ে উঁকি দিয়ে ঘরের ভেতর নিজের পুড়ে কাঠ হয়ে যাওয়া মৃতদেহটাকে শেষবারের মতো দেখে নিল ঝর্না।
ওরা হেঁটে যাচ্ছিল। এক থেকে দুই, তিন, চার, পাঁচ… অগুন্তি হয়ে ওরা হেঁটে যায়। তবুও এই নির্লিপ্ত চরাচরে নির্মম চাঁদের আলো ওদের কোনও ছায়া ধরে রাখে না। অঙ্কন : শংকর বসাক

Latest article