সময় এখন ভিতরপানে চাহিবার

যাঁদের জেলের দারোগা বা ড্রিল সার্জেন্ট কিংবা ভূতের ওঝা হওয়া উচিত ছিল, তাঁরা শিক্ষকতা করতে এলে সমস্যা বাড়বে। লিখছেন অধ্যাপক স্বর্ণালী দত্ত

Must read

“সাম্প্রদায়িক ধর্মবুদ্ধি মানুষের যত অনিষ্ট করেছে এমন বিষয়বুদ্ধি করেনি। বিষয়াসক্তির মোহে মানুষ যত অন্যায়ী যত নিষ্ঠুর হয়, ধর্মমতের আসক্তি থেকে মানুষ তার চেয়ে অনেক বেশি ন্যায় ভ্রষ্ট অন্ধ ও হিংস্র হয়ে ওঠে, ইতিহাসে তার ধারাবাহিক প্রমাণ আছে; আর তার সর্বনেশে প্রমাণ ভারতবর্ষের আমাদের ঘরের কাছে প্রতিদিন যত পেয়ে থাকি এমন আর কোথাও নয়” (পারস্যে:৬)— ১৯৩২ সালে লেখা রবীন্দ্রনাথের কথাগুলো আজও কত প্রাসঙ্গিক। সময় বদলেছে কিন্ত বদলায়নি মানুষ ও তার মানসিকতা। ধর্ম এখনও সবার ঊর্ধ্বে এই ধর্মনিরপেক্ষ দেশে।

আরও পড়ুন-আদালত থেকে ফেরার পথে আসামিকে হত্যা, আইনজীবীর ওপর হামলা

সম্প্রতি উত্তর প্রদেশের মুজফ্ফরনগরের একটি বেসরকারি স্কুলের একটি ঘটনা মনে করিয়ে দিল উক্ত মন্তব্যকে। বেসরকারি স্কুলটির একজন শিক্ষিকা তাঁর ধর্ম বিদ্বেষের প্রকাশ ঘটালেন দ্বিতীয় শ্রেণির এক মুসলিম ছাত্রকে পিটিয়ে। না, তিনি নিজে হাতে করে মারেননি। তিনি বসে বসে নির্দেশ দিয়েছেন অন্যান্য হিন্দু বাচ্চাদের, তারা যেন এক এক করে তাদের ‘মুসলিম’ সহপাঠীর গালে চড় মারে। কী ভয়ানক সেই নির্দেশ এবং মর্মান্তিক সেই দৃশ্য। যিনি এই ঘটনাটি মোবাইলে রেকর্ড করেছেন অন্তর্জালে ছড়িয়ে পড়া সেই ভিডিও দেখলে লজ্জা লাগে সেই ব্যক্তির উল্লাস এবং শিক্ষিকার সন্তুষ্টি দেখে। আমরা শিখে এসেছি, শিক্ষকের দ্বারাই শিক্ষাবিধান হয়, প্রণালীর দ্বারা নয়। কিন্তু এ কীরকম শিক্ষক? কীই-বা তার শিক্ষার স্বরূপ? যে শিশুরা মাটির ডেলা, নির্দিষ্ট আকার পেতে শিক্ষকের কাছে যায় তাদের শিশুত্বকেই নষ্ট করে দিচ্ছেন ধর্মের পট্টি পরিয়ে। ধর্ম সকলকে মুক্তি দেয়। সে-কারণেই ধর্মকে মুক্ত রাখা উচিত। তার বদলে ধর্মকে মারতে শেখানো? এই শিক্ষাই কি আমরা চেয়েছিলাম? নিচু জাত, সংখ্যালঘু ধর্ম, অস্পৃশ্য এই শব্দগুলো উত্তরপ্রদেশের সেই শিক্ষিকার মজ্জাগত। সেই কারণেই তিনি খুব সহজেই পেরেছিলেন আট বছরের কচি মুখটার ঊর্ধ্বে তার অসুস্থ মানসিকতাকে প্রাধান্য দিতে।

আরও পড়ুন-‘জওয়ান’ মুক্তির আগে মেয়েকে নিয়ে তিরুপতি মন্দিরে শাহরুখ খান

শিক্ষিকার মতে, মুসলিম মায়েরা পরীক্ষার আগে তাদের বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরতে চলে যায়, মামার বাড়ি চলে যায়, ফলে দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণে তাদের পড়াশুনায় ক্ষতি হয়। তাইজন্য তিনি সকলকে বোঝাচ্ছিলেন! এ কেমন বোঝানো যেখানে নির্দিষ্ট একটি ধর্মকেই আক্রমণ করে কোণঠাসা করা হয়? এ কেমন শিক্ষা দেওয়া যেখানে আট বছরের বাচ্চার দুটো গাল লাল করে দেওয়া হয় গায়ের জোরে চড়ের পর চড় মারা করিয়ে? উত্তরপ্রদেশ এমন একটি রাজ্য যা ধর্মকে ধারণ করে না, বরং মারে। আমাদের বাংলার শিক্ষা আমাদের এই নৃশংসতা শেখায় না। পাঁচশো বছর আগে মহাপ্রভু এই জাতিভেদ, বর্ণবৈষম্যের মূলে মানবতার কুঠারাঘাত করেছিলেন। যবনকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন পরম আত্মীয় করে। হরিনাম সংকীর্তনের মাধ্যমে তিনি চণ্ডালের মধ্যেও তুরীয় আনন্দের অনুভব করিয়েছিলেন। চৈতন্যের এই ভক্তি আন্দোলনের হাত ধরেই বাংলায় স্বর্ণযুগ এসেছিল। এসেছিল প্রকৃত নবজাগরণ। বাংলার মাটি সবাইকে আশ্রয় দিয়েছিল মাতৃস্নেহে।

আরও পড়ুন-শিক্ষক দিবসে কী বললেন মুখ্যমন্ত্রী

বঙ্গভঙ্গের সময় রবীন্দ্রনাথের রাখিবন্ধন উৎসব বা কাজী নজরুলের সেই বিখ্যাত গান ‘মোরা একই বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু মুসলমান’ আমাদেরকে শিখিয়েছিল ভ্রাতৃত্বপ্রেম। বিবেকানন্দ উচ্চকণ্ঠে শুনিয়েছিলেন সেই বাণী— “হে ভারত, ভুলিও না— নীচ জাতি, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর তোমার রক্ত, তোমার ভাই। হে বীর সাহস অবলম্বন কর, সদর্পে বল— আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই। বল— মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই।’’ বা, “আমরা মানবজাতিকে সেই স্থানে লইয়া যাইতে চাই— যেখানে বেদও নাই, বাইবেলও নাই, কোরানও নাই; অথচ বেদ, বাইবেল ও কোরানের সমন্বয় দ্বারাই ইহা করিতে হইবে। মানবকে শিখাইতে হইবে যে, সকল ধর্ম ‘একত্বরূপ সেই একধর্ম’—এরই বিবিধ প্রকাশ মাত্র…।’’

আরও পড়ুন-রাজ্যপালকে রাজ্য সরকার, বেআইনি সার্কুলার এখনই প্রত্যাহার করুন

২০১৭ সালে প্রকাশিত ‘ক্ষমা কর, হে প্রভু’ উপন্যাসে রূপক সাহা দেখিয়েছেন আধুনিক গোরাকে। গোরা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র। গোরা দলিত আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়। সে মনে করে, ভারতবর্ষে দলিত, নীচুজাতরাই সবসময় লাঞ্ছিত, অপমানিত, বঞ্চিত, শোষিত। এদের সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে হয় অন্যের দাসত্বের জন্য। রবীন্দ্রনাথ যে অর্থে বলেছিলেন, ভারতবর্ষ শুধু ভদ্রলোকের ভারতবর্ষ নয়, এই সত্য গোরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছে। ফলে শিক্ষা জগতেও সে বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়েছে। শুধু গোরা কেন, এই লড়াই আমাদের সবার। জীবনানন্দ যে বাংলার মুখ দেখেছেন তার মধ্যে কোনও হিন্দু-মুসলিম ভেদ তিনি দেখেননি।

আরও পড়ুন-ধূপগুড়ির ভোটে আজ তৃণমূল-ঝড়

সংবাদমাধ্যমে শিক্ষিকা প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছেন কিন্তু সেই ক্ষমায় নেই কোনও আন্তরিক অনুশোচনা বা পাপ বোধ। সেই ক্ষমা চাওয়া নিতান্তই দায়সারা কাজ। তিনি অনুভব করতেই পারেননি যে, শিশুটির শুধু শারীরিক ক্ষতি হয়নি। মানসিক ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় সে লড়াই করছে নিজের সঙ্গে, নিজের ধর্মগত পরিচয়ের সঙ্গে। শরীরের আঘাত সেরে যায়। কিন্তু মনের আঘাত? এইটুকু বয়সে যে শিশু শিক্ষকের এই নৃশংসতা দেখল সে কি আর কখনও শ্রদ্ধা করতে পারবে কোনও শিক্ষককে? বিশ্বাস করতে পারবে সমাজকে? ২০২৩ সালে দাঁড়িয়ে শিক্ষিকার এহেন অমানবিক আচরণে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায় আর একজন শিক্ষিকা হয়ে। আবারও মনে পড়ে যায় — ‘‘যাদের উচিত ছিল জেলের দারোগা বা ড্রিল সার্জেন্ট বা ভূতের ওঝা হওয়া তাদের কোনোমতেই উচিত হয় না ছাত্রদিগকে মানুষ করিবার ভার লওয়া। ছাত্রদের ভার তাঁরাই লইবার অধিকারী যাঁরা নিজের চেয়ে বয়সে অল্প, জ্ঞানে অপ্রবীণ ও ক্ষমতায় দুর্বলকেও সহজেই শ্রদ্ধা করিতে পারে’’। (শিক্ষা, ছাত্রশাসনতন্ত্র)

Latest article