একটা গোটা অধিবেশনে জলাঞ্জলি, দায়টা কার মোদিজি?

বাজেট অধিবেশনে সংসদীয় কার্যকলাপ কিছুই তেমন হল না। সময় নষ্ট হল বিরোধী কণ্ঠরোধের প্রয়াসে। তবু যেটা হল, সেটা বোধ হয় মোদি শিবিরের পক্ষে খুব সুখকর আগামীর ইঙ্গিত দিচ্ছে না। লিখছেন সাংসদ জহর সরকার

Must read

কেন্দ্রের সরকার বাহাদুর সদা-সর্বদা সংসদের কার্যকারিতা বা উৎপাদনশীলতাকে ঘণ্টা-মিনিটের তুলাদণ্ডে বিচার করেন। কিন্তু এবার যে সংসদের বাজেট অধিবেশন একেবারেই অসংসদীয় কারণে অনির্দিষ্ট কালের জন্য মুলতুবি হয়ে গেল, তার বেলা! এ যে একেবারে হৃদয় বিদারক ঘটনা। সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত তথ্য উপাত্ত অনুযায়ী লোকসভার কার্যকারিতা ৮৩.৮ শতাংশ থেকে কমে ৫.২৯ শতাংশে এসে ঠেকেছে।

আরও পড়ুন-দরিদ্র কৃষককে কৃষিকাজে সাহায্যে এগিয়ে এল শিবির

লোকসভায় হুল্লোড়বাজির কারণে নষ্ট হয়েছে প্রায় ৯৬ ঘণ্টা ৩০ মিনিট আর রাজ্যসভায় নষ্ট সময়ের পরিমাণ ১০৩ ঘণ্টা ৩০ মিনিট। এই যে সংসদের অধিবেশন বারবার ব্যাহত হল, এই যে সংসদীয় কার্যকলাপ বারংবার বিঘ্নিত হল, লক্ষণীয়ভাবে সেজন্য দায়ী কিন্তু বিরোধীরা নয়, দায়ী সরকার পক্ষ। প্রতিদিন সকাল-বিকেল অধিবেশন বসামাত্র শাসক বেঞ্চ থেকে আওয়াজ উঠেছে ‘মাফি মাঙো’, ‘ক্ষমা চাও’। একজন বিরোধী নেতা কেমব্রিজ গিয়ে একটা বিবৃতি দিয়েছিলেন যেটাকে শাসক পক্ষ বিজেপির দেশবিরোধী বলে মনে হয়েছে। তারই প্রতিক্রিয়ায় এই ক্ষমাপ্রার্থনার জন্য জোর-জবরদস্তি, গলাবাজি।

আরও পড়ুন-সরকারি উদ্যোগে রাজ্যে অ্যাপ ক্যাব পরিষেবা

যখন ঔপনিবেশিক শাসনের জেরে জনতা রাস্তায়, স্বাধীনতা সংগ্রামের শরিক হয়ে তারা যখন পিঠ বাঁচিয়েছিল, আজ তারাই উগ্র জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠে জাতীয়তাবিরোধী মন্তব্যের বিরুদ্ধে উষ্মা প্রকাশ করছে। এই উগ্র জাতীয়তাবাদীর দল ইচ্ছাকৃতভাবে ভুলে যেতে চাইছে ভারত ছাড়ো আন্দোলনকে দমন করতে মরিয়া ব্রিটিশ শাসকদের সহায়তা দানের কথা বাংলার গর্ভনরকে সরকারিভাবে জানিয়েছিলেন হিন্দু মহাসভায় মুখ্য নেতা, কিংবা ব্রিটিশদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিজের কারামুক্তির ব্যবস্থা করতে লজ্জা পাননি হিন্দুত্ববাদী এক নেতা। একদা যারা ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকাকে জাতীয় পতাকা হিসেবে মান্যতা দিতে অস্বীকার করেছিল আজ তারাই কিনা জাতীয় পতাকার অবমাননা করা হচ্ছে এই অজুহাতে মানুষজনকে হেনস্তা করছে।

আরও পড়ুন-কুড়মিরাই আন্দোলন নিয়ে বিভক্ত হয়ে গেল, সমাধানসূত্র মিলল না

সংসদে বিজেপি সাংসদদের আচার-আচরণে একটা কথা পরিষ্কার, তাঁরা ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের নির্দেশানুসারেই অধিবেশন বসলেই হইহট্টগোল শুরু করত। আসল উদ্দেশ্য হল, বিরোধীদের কথা বলার সুযোগ না দেওয়া। বিরোধীরা মুখ খুললেই যদি ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আগে মোদি-আদানি সম্পর্ক রসায়ন শাসক শিবিরের বিড়ম্বনার কারণ হয়, সেজন্যই এই বন্দোবস্ত, ১৩ মার্চ, সোমবার থেকে টানা দু’সপ্তাহ ধরে এই পরিকল্পনামাফিক অধিবেশন পণ্ড করার প্রকল্প চলেছে। একেবারে নিয়ম করে চলেছে।
এর ফলে যেটা হয়েছে সেটা সম্ভবত মোদিজির কল্পনাতে ছিল না।

আরও পড়ুন-আন্দোলনের নামে বাম গুন্ডামি

কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে কাজে লাগিয়ে মোদিজি যে তাঁর বিরোধী দলগুলোকে হেনস্তা করে তাদের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করতে চাইছেন, সেটা ক্রমে সকল বিরোধী দলগুলোর কাছে একেবারে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে।
বিরোধী দলগুলো বুঝতে পারছিল এতদিন ধরে যে মোদিজি তাঁদের এক-এক করে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে দিয়ে হেনস্তা করাবেন। কিন্তু রাহুল গান্ধীর ওপর খড়্গহস্ত হওয়ার পর যারা এতদিন গা বাঁচিয়ে চলার পরিকল্পনা নিয়ে চলছিল তারা বুঝতে পারল, খুব ভয়ানক দিন সমাগত প্রায়। অবিজেপি দলগুলোর মধ্যে নৈকট্য বৃদ্ধি পেল। এতদিন তৃণমূল কংগ্রেস কংগ্রেসের হাইকমান্ডের একতরফা সিদ্ধান্ত নেওয়া নিয়ে বিরক্ত ছিল। কিন্তু ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সেই বিরক্ত সরিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসও বিজেপি বিরোধী জোটে তাদের অবস্থান দৃঢ়তর করেছে।
আদানি ইস্যু মোদি এবং বিরোধী পক্ষ উভয়ের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। রাজনীতিতে অর্থের প্রয়োজনীয়তা কথা মোদিজির চেয়ে বেশি কেউ জানেন বলে মনে হয় না। মোদিজি জানেন বিধায়ক- সাংসদদের স্বপক্ষে আনতে হলে দুটো উপায় খুবই কার্যকর, কথায় কথায় কেন্দ্রীয় এজেন্সি নামিয়ে হেনস্তার ব্যবস্থা করা আর কাঁচা টাকা ছড়ানো। দলবদলুদের নিয়ে কীভাবে সরকার গড়তে হয় সে-বিষয়ে বিজেপি যারপরনাই দক্ষতা অর্জন করেছে।

আরও পড়ুন-ঠিকাশ্রমিকদের বায়োমেট্রিক হাজিরা, দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানা

কোনও কিছু ছাড়া ব্যবসায়ী শ্রেণি রাজনৈতিক দলের পিছনে অর্থব্যয় করে না সেটা হিন্ডেনবার্গের সৌজন্যে একেবারে খুল্লামখুল্লা হয়ে পড়েছে। সেই লেনদেনের হিসাব আর কারও অজানা নয়। বস্তুতপক্ষে এতদিন যা কানাঘুষোয় শোনা যেত, একদিন যা গুজব-চর্চার বিষয় ছিল। হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টের সৌজন্যে সেটা এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। আর পর্দা ফাঁস হয়ে এই সত্য বেরিয়ে আসার সুবাদেই বিরোধীপক্ষে ঐক্যের সুর। সন্দেহ নেই মোদিজির সৌজন্যেই এই কাণ্ডটি ঘটেছে।

আরও পড়ুন-চালাকি করবেন না ধমক চন্দ্রচূড়ের

অধিবেশন পণ্ড হয়েছে। সংসদীয় কার্যকলাপ শিকেয় উঠেছে। ঘণ্টা-মিনিটের হিসাব ধরলে বাজেট অধিবেশন এবার নিষ্ফল পণ্ডশ্রম, অপচয়ের পরাকাষ্ঠা। কিন্তু তার প্রভাব জাতীয় রাজনীতিতে যা ঘটল, সেটা মোদিজির পক্ষে সুখকর নাও হতে পারে। দেওয়াল লিখন অন্তত তেমনটাই বলছে।

Latest article