ফুসফুসের ক্যানসার প্রতিরোধে

প্রতিবছরের মত গতকাল ১ অগাস্ট পালিত হল ‘বিশ্ব ফুসফুস ক্যানসার’ দিবস। দীর্ঘমেয়াদি ধূমপানই এই রোগের পিছনে ৮৫ শতাংশ দায়ী। এছাড়াও রয়েছে আরও বহুবিধ কারণ। যেহেতু এই রোগের কোনও প্রতিষেধক নেই, তাই জনসচেতনতা বৃদ্ধিই প্রতিরোধের একমাত্র উপায়। জানাচ্ছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

শ্বাসতন্ত্রের যাবতীয় রোগের মধ্যে ফুসফুসের ক্যানসার সবচেয়ে মারাত্মক রোগ৷ এই রোগটি প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে বিশ্বজুড়ে জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রতিবছর অগাস্ট মাসের এক তারিখে ফুসফুসের ক্যানসার দিবসটি পালিত হয়। ১৯ শতকে ফুসফুসের ক্যানসার একটি বিরল ঘটনা ছিল। ২০ শতকের প্রথম দিকেও এই মারণ ক্যানসার এত বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছয়নি। কিন্তু ধূমপানের ফলে ফুসফুসের ক্যানসারের ঘটনা ক্রমাগত বেড়েছে। মানবদেহে ১২.৮% ক্যানসার ফুসফুসে হয়। ক্যানসার-মৃত্যুর ১৭.৮% ফুসফুসের ক্যানসারের কারণেই ঘটে।

আরও পড়ুন-মণিপুরে জঙ্গলরাজ চলছে, ফের বোঝাল সুপ্রিম কোর্ট

ধূমপান
১৯৫০ এর দশকে করা এপিডেমিওলজিক কেস-কন্ট্রোল স্টাডিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে ফুসফুসের ক্যানসার এবং ধূমপানের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৬২ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে ধূমপানের ফলে ফুসফুসের ক্যানসার হয়। ৯৪% ফুসফুসের ক্যানসার ধূমপানের কারণে হয়। মহিলাদের মধ্যে প্রায় ৮০% এবং পুরুষদের প্রায় ৯০% ফুসফুস ক্যানসার হয় ধূমপানের কারণে।
প্যাসিভ স্মোকিং
প্যাসিভ স্মোকিং বা পরোক্ষ ধূমপানও ক্ষতিকারক । প্যাসিভ স্মোকিং ফুসফুসের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় ২০-৩০%। বাড়ির মহিলাদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া জরুরি কারণ তাঁরাই প্যাসিভ স্মোকিংয়ে আক্রান্ত।

আরও পড়ুন-হাত গুটিয়ে সরকার, মণিপুর-কটাক্ষ তৃণমূলের

বিষাক্ত পদার্থ
নির্দিষ্ট কিছু রাসায়নিক বিষাক্ততার এক্সপোজারে ফুসফুসের ক্যানসার হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে বিপজ্জনক পদার্থ যেমন রেডন, আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, নিকেল, ইউরেনিয়াম এবং কিছু পেট্রোলিয়াম পণ্য।
পারিবারিক ইতিহাস
যাঁদের পরিবারে ফুসফুসের ক্যানসারের ইতিহাস রয়েছে তাঁদের পরিজনদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার দ্বিগুণ ঝুঁকি রয়েছে। বেশ কিছু অন্যান্য গবেষণাও বলছে যে ফুসফুসের ক্যানসারে জেনেটিক ইতিহাস একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর।

আরও পড়ুন-তাঁতশিল্পে রাজ্যের অনবদ্য অবদান, ‘স্কচ অ্যাওয়ার্ড’ পেল সরকারি তাঁতবস্ত্র বিপণনী তন্তুজ

জেনেটিক মিউটেশন
জেনেটিক মিউটেশনও ফুসফুসের ক্যানসারকে ট্রিগার করে। বিশেষ করে, যদি ওই ব্যক্তি ধূমপানে আসক্ত হয়। এমনকী অন্যান্য কার্সিনোজেনের সংস্পর্শও এই রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
লক্ষণ
ফুসফুসের ক্যানসারের সাধারণ লক্ষণগুলো হল—
দীর্ঘস্থায়ী কাশি। এক্ষেত্রে শুকনো কাশি অথবা ঘন ঘন কাশি হতে পারে, কাশির সঙ্গে অতিমাত্রায় কফ হয়ে যেতে পারে অথবা রাতের দিকে কাশি প্রচণ্ড বেড়ে যেতে পারে।
কাশির সঙ্গে রক্ত বেরনো অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। এক্ষেত্রে কফের সঙ্গে অথবা থুতুর বা লালার সঙ্গে রক্ত লিক করে এবং দেখা যায় ফুসফুসের কোনও না কোনও জায়গায় বারবার ইনফেকশন হচ্ছে।

আরও পড়ুন-দেশের বৈদেশিক মুদ্রা ভাণ্ডারে বড় ধাক্কা, কমে গেল ডলার সঞ্চয়

বুকে ব্যথা। ক্যানসারাস টিউমারটি ফুসফুস ঝিল্লির আশপাশে হলে মাঝে মাঝে হালকা বুক ব্যথা হয়ে থাকে কিন্তু টিউমারটি যদি ফুসফুস ঝিল্লি ভেদ করে তাহলে অনবরত বুকে ব্যথা হতে থাকে।
ক্যানসারের প্রদাহের কারণেও জ্বর আসে। এক্ষেত্রে কোনও অ্যান্টিবায়োটিকও কাজ করে না এবং বারবার জ্বর আসতেই থাকে।
আঙুল ফুলে যায় এবং ব্যথা হয়, বিশেষ করে আঙুলের গোড়ার দিক এবং নখের চারপাশ। এই লক্ষণ দেখা মাত্রই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
রোগী সহজেই দুর্বল বা ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
তীব্র শ্বাসকষ্ট দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রেই।
শরীরের গাঁটে গাঁটে, যেমন হাঁটু, কনুই, কব্জি ইত্যাদিতে ব্যথা হতে পারে। এমনকী ব্যথার কারণে হাত নড়াচড়া করতে বা হাঁটতেও প্রচণ্ড অসুবিধা হতে পারে।
খিদে কমতে থাকে এবং ওজন হ্রাস পেতে থাকে।
অকারণে গলা বসে যাওয়া। গলার স্বর কর্কশ হয়ে যাওয়া।
নিউমোনিয়া বা ব্রঙ্কাইটিসের মতো শ্বাসযন্ত্রের পুনরাবৃত্তিমূলক রোগগুলিও ফুসফুসের ক্যানসারের লক্ষণ হতে পারে।
‘বিশ্ব ফুসফুস ক্যানসার দিবস’-এ ধূমপানের বিরুদ্ধে সচেতনতা প্রয়োজন।
কারণ সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, অতিমারিকালে ধূমপানের পরিমাণ ভয়ঙ্কর বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, স্ট্রেস, অ্যাংজাইটি ধূমপানের প্রবণতাকে দিনে দিনে বাড়িয়ে তুলছে।

আরও পড়ুন-প্রয়াত শোভনদেবের দাদা তপন চট্টোপাধ্যায়, শোকজ্ঞাপন মুখ্যমন্ত্রীর

চিকিৎসা
ফুসফুসের ক্যানসার সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন থেরাপি, টার্গেটেড থেরাপি, ইমিউনোথেরাপি বা এই ট্রিটমেন্টগুলির সংমিশ্রণের মাধ্যমে চিকিৎসা করা যেতে পারে। গত কয়েক বছরে গবেষণার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ফুসফুসের ক্যানসারের চিকিৎসায় নানা পরিবর্তন এসেছে। ফুসফুসের ক্যানসারের চিকিৎসা নির্ভর করে তার রোগের প্রকারের উপর।
ফুসফুসের ক্যানসার তিন ধরনের হয়— নন স্মল সেল টাইপ, স্মল সেল টাইপ এবং কার্সিনয়ড। এর মধ্যে স্মল সেল টাইপ সবচেয়ে খারাপ, বৃদ্ধি পায় ও শরীরে ছড়িয়ে পড়ে খুব দ্রুত।
রোগীর বুকের এক্স রে ও সিটি স্ক্যান দ্বারা প্রাথমিক নিরীক্ষণ করে রোগ নির্ণয় করা হয়।
রোগের পর্যায়কে স্টেজ ওয়ান থেকে স্টেজ ফোর অবধি ভাগ করা হয়। এর মধ্যে নন স্মল সেল টাইপ ও কার্সিনয়ড ক্যানসারের স্টেজ থ্রি- এ পর্যন্ত অস্ত্রোপচার দ্বারা এই রোগ নিরাময় সম্ভব হতে পারে। স্মল সেল টাইপ ক্যানসারে কিন্তু কেবল স্টেজ টু পর্যন্তই অস্ত্রোপচার দ্বারা নিরাময়ের সম্ভাবনা থাকে। টিউমারের ধরন, আকৃতি, তাঁর অবস্থান এবং রোগীর শারীরিক অবস্থার উপর নির্ভর করে সার্জারি কীরকম হবে ।
নন স্মল সেল লাং ক্যানসারের জন্য সার্জারি ছাড়াও কেমোথেরাপি, নিওঅ্যাডজুভেন্ট চিকিৎসা, টার্গেটেড থেরাপি, ইমিউনোথেরাপি ইত্যাদির মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়।

আরও পড়ুন-পাকিস্তানে জঙ্গি হামলা, মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫৪

স্মল সেল লাং ক্যানসারের জন্য কেমোথেরাপি, রেডিয়েশনথেরাপি, প্রিভেনটিভ রেডিয়েশনথেরাপি, সার্জারির মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়।
গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা
ফুসফুসের ক্যানসার কোনও জীবাণুঘটিত রোগ নয় তাই এর প্রতিষেধক আবিষ্কারেও বিজ্ঞানীরা সক্ষম হননি। জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমেই এই রোগের প্রতিরোধ করা সম্ভব।
ফুসফুসে ক্যান্সারের জন্য অন্যতম কারণ ধূমপান। ইদানীং মেয়েদের মধ্যেও ধূমপানের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে মেয়েরাও এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যাঁরা ধূমপান করেন না তাঁরাও সুরক্ষিত নন, কারণ হল নগরায়ণ। শিল্প কারখানা ও গাড়ি নির্গত কালো ধোঁয়াও ফুসফুসে ক্যানসারের কারণ হতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ যেমন— ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, অ্যাসবেসটস ইত্যাদি এই রোগ সৃষ্টি করতে পারে। বর্তমান উন্নত বিশ্বে পারমাণবিক বর্জ্যও ফুসফুস ক্যানসারের একটি বড় কারণ। ফুসফুসের প্রদাহজনিত রোগ যেমন— যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া ভাল হওয়ার পর সেই স্থানে ক্যানসার দেখা দিতে পারে।

আরও পড়ুন-অনাস্থা এড়িয়ে বিল পাশ কেন?

তাই ফুসফুসের ক্যানসারের রোধে এই রোগটির কারণগুলির প্রতিরোধ প্রয়োজন।
ধূমপান বর্জন করতেই হবে। সেই সঙ্গে সেকেন্ড হ্যান্ড স্মোকিং এড়িয়ে যান— ধূমপায়ী কোনও ব্যক্তির সংস্পর্শে থাকলে সেই ধোঁয়া আপনার জন্যও ক্ষতিকর ফুসফুসের ক্যানসারের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে।
কেউ যদি উচ্চ মাত্রার বায়ুদূষণ সম্বলিত এলাকায় বসবাস করেন তাহলে কীভাবে নিজেকে সুরক্ষিত রাখবেন এবং বাদবাকি ক্ষতিকর পদার্থগুলোর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকা বা কমিয়ে আনা কীভাবে সম্ভব তাকে সেটা খতিয়ে দেখতে হবে।

Latest article