বাঙালির বিলাপে বসন্ত বিলাস
বিশ্বজিৎ দাস
তবু আগুন বেণীমাধব, আগুন জ্বলে কই!
কেমন হবে আমিও যদি ‘শিমুল পলাশ’ হই…
আগুন ছাড়া মানুষ বাঁচবে কী করে! দেবরাজ জিউস তো পৃথিবী থেকে সব আগুন তুলে নিয়েছেন। শান্ত নরম পৃথিবীতে আগুন নেই। বেণীমাধবরাও আগুনের ঠিকানা জানে না। প্রমিথিউস ভার নিলেন পৃথিবীতে আগুন নিয়ে আসার। শূন্য গোলকের ভিতরে আগুনের শিখাকে লুকিয়ে নিরাপদে পৃথিবীতে পৌঁছে দিলেন। এই আগুনই পুড়িয়ে দিল প্রমিথিউসের হৃদয়। ককেশাস পাহাড়ের রাস্তায় যখন ফুল ফুটেছে তখন প্রমিথিউস বন্দি। প্রকৃতির পাহাড়ি বসন্ত তাকে স্পর্শ করতে পারছে না। হারকিউলিস ককেশাসের পাহাড়ে কলিজা-খেকো ইগল বধ করে মুক্ত করলেন প্রমিথিউসকে। তখন থেকেই প্রকৃতিকে আগুন ঢেলে সাজালেন শিমুল-পলাশ-কৃষ্ণচূড়ায়। বেণীমাধবের হৃদয় বলে উঠল— বসন্ত এসে গেছে।
আরও পড়ুন-‘গণতান্ত্রিক ভারত’ আজ ‘বিরোধাভাস’
ব্যাসদেবের শিবপুরাণ : বসন্তে ফুল গাঁথল
ব্যাসদেবের শিবপুরাণ বলছে ঋতু বসন্তের জন্ম কিন্তু এমনি এমনি হয়নি। সে-সময় ত্রিলোক দাপাচ্ছিল তারকাসুর। এমন অত্যাচারী হয়ে উঠেছিল যে, তার অত্যাচারে দেবতারা স্বর্গচ্যুত হয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েন। তাঁরা বুঝলেন, এই অসুরকে বধ না-করতে পারলে কিছুতেই তাঁদের মুক্তি নেই। কিন্তু তাকে বধ করা বড় কঠিন কাজ। কারণ, ব্রহ্মার বরে তাকে বধ করতে পারবেন একমাত্র মহাদেবের ঔরসজাতপুত্র। আর সেখানেই যত গন্ডগোল। গোল বাধালেন মহাদেব। মহাদেবের যে সংসারে একেবারেই মন নেই, বিয়েরও কোনও ইচ্ছে নেই, দিনরাত যোগসমাধিতেই মগ্ন থাকেন। বিয়ে না করলে পুত্র হবে কোথা থেকে? পুত্র না হলে দেবতারা মুক্তি পাবেন কেমন করে?
দেবতারা পড়লেন মহাবিপদে। তাঁরা শরণাপন্ন হলেন ব্রহ্মদেবের। ব্রহ্মা আর উপায় না-দেখে মদনদেবকে আদেশ দিলেন শিবের ওপর মদনবাণ প্রয়োগ করতে।
তখন রতিদেবীকে সঙ্গে নিয়ে মদনদেব কৈলাসে হাজির হলেন।
আরও পড়ুন-বাম আমলের স্বজনপোষণ, চিরকুট-সুপারিশের প্রকাশ্যে স্বীকারোক্তি, হাটে হাঁড়ি ভাঙলেন উদয়ন
মদনদেবের প্রথমেই মনে হল, শিবকে কামবাণে ঘায়েল করার আগে প্রকৃতিকে সেভাবেই সাজিয়ে তুলতে হবে। যাতে শিবের মনে কামনা জাগানোর উপযোগী প্রকৃতি তৈরি হয়। আর এটা করতে গিয়ে তিনি ঋতুচক্রে একটি নতুন ঋতুই সৃষ্টি করে ফেললেন। সেই ঋতুর নাম দেওয়া হল ‘বসন্ত’। বসন্তের আবাহনে তখন ধরায় মলয় বাতাস বইল, গাছে গাছে নতুন পাতা মুকুলিত হল, শাখায় শাখায় পুষ্পমঞ্জরী এল। কোকিল পঞ্চমে গেয়ে উঠল গান।
কাব্যপ্রিয় বাঙালির কলমে বসন্ত
বাঙালির বসন্ত বিলাস নতুন নয়। প্রকৃতির রং আর কলমের রং বদলেছে রবিঠাকুরের অনেক আগেই। মধ্যযুগের বাঙালি কবি সৈয়দ আলাওলের কলমে। আলাওল কাব্যে বসন্তকে দেখেছেন কামের ঋতু হিসেবে। তিনি লিখেছেন, ‘মলয়া সমীর হৈলা কামের পদাতি।/মুকুলিত কৈল তবে বৃক্ষ বনস্পতি॥/কুসুমিত কিংশুক সঘন বন লাল।/পুষ্পিত সুরঙ্গ মল্লি লবঙ্গ গুলাল॥/ভ্রমরের ঝঙ্কার কোকিল কলরব।/শুনিতে যুবক মনে জাগে মনোভব॥’
আরও পড়ুন-কড়া পদক্ষেপ নিল রাজ্য, ২৩ হাজার শিক্ষককে শো-কজ, অনুপস্থিত কর্মীদের বেতন কাটার নির্দেশ
একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ
বসন্তের আধার নিয়ে বসে আছেন রবিঠাকুর— তাঁর অজস্র গানে, কবিতায়। বসন্তের কবিতা বা গান তাঁর সৃষ্টিই সবচেয়ে বেশি।
রবীন্দ্রনাথের মোট ২,২৩২টি গানের মধ্যে প্রকৃতি পর্বের গান আছে ২৮৩টি। এর মধ্যে বসন্ত পর্যায়ের গানের সংখ্যা ৯৮টি।
প্রতিটি ঋতুর সঙ্গে পরিচয় ঘটানোর জন্য রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বিভিন্ন ঋতু উৎসবের আয়োজন করতেন। তারও আগে কনিষ্ঠ সন্তান শমীন্দ্রনাথের আবদার মেনে ১৩০৩ বঙ্গাব্দের বসন্তের পঞ্চম দিনে তিনিই সূচনা করেছিলেন ‘ঋতুরঙ্গ উৎসব’। প্রথম ঋতুরঙ্গ উৎসবের জন্য রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ, প্রাণেশ হে,/আনন্দবসন্তসমাগমে॥/বিকশিত প্রীতিকুসুম হে/পুলকিত চিতকাননে॥/জীবনলতা অবনতা তব চরণে।/হরষগীত উচ্ছ্বসিত হে/কিরণমগন গগনে॥’
বসন্ত পঞ্চমীতে শমীন্দ্রনাথ ও আরও ২ জন ছাত্র বসন্ত সেজেছিল। ১ জন সেজেছিল বর্ষা, আর ৩ জন সেজেছিল শরৎ। সে-বছরের নভেম্বরে মাত্র ১১ বছর বয়সেই চলে গেলেন শমীন্দ্রনাথ— কবির প্রিয় শমী।
১৯২৫ সালে ‘ঋতুরঙ্গ উৎসব’ পরিবর্তিত হয় শান্তিনিকেতনের ‘বসন্ত উৎসব’-এ।
আরও পড়ুন-কড়া পদক্ষেপ নিল রাজ্য, ২৩ হাজার শিক্ষককে শো-কজ, অনুপস্থিত কর্মীদের বেতন কাটার নির্দেশ
রবীন্দ্রনাথ বসন্তের গানে লিখেছেন, ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।/তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে/কোরো না বিড়ম্বিত তারে।/আজি খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো,/আজি ভুলিয়ো আপনপর ভুলিয়ো,/এই সংগীত-মুখরিত গগনে/তব গন্ধ তরঙ্গিয়া তুলিয়ো।’
কবির প্রিয় আলয়ে আজও বাঙালি ছুটে চলেছে আরও একবার রাঙিয়ে নিতে-রাঙিয়ে দিতে। বাঙালির বসন্ত বিলাপের এ-যেন করুণ রাগ— যখন বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন— হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা অন্য কোন খানে…।
বসন্ত এলো রে
নজরুলও কম যাননি বসন্ত বিলাসিতায়। লিখেছেন, ‘বসন্ত এলো এলো এলো রে/পঞ্চম স্বরে কোকিল কুহরে/মুহু মুহু কুহু কুহু তানে…’। তবে জীবনানন্দ তাঁর বনলতার দোসর বসন্তকে আদরে রেখেছেন— ‘আজ এই বসন্তের রাতে/ঘুমে চোখ চায় না জড়াতে;/ওই দিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর,/স্কাইলাইট মাথার উপর,/আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর…’।
সেক্টর ফাইভের বহুতলের ছাদে দাঁড়িয়ে বনলতাদের মাথার উপরে স্কাইলাইটকে সাক্ষী রেখে পাখিরা গায় বসন্তের গান। বসন্ত বিলাপের গান। এ গানে প্রেম থাকে। থাকে বিরহ।
আরও পড়ুন-ভোটের মুখে বাতিল মুসলিমদের সংরক্ষণ
একাকী বিরহী বসন্ত
‘অনিমিষ একা’ জার্নালে সন্দীপন বসন্তকে একাকী, বিরহী দেখেছেন— ‘বসন্তকে ঋতুরাজ বলার পক্ষে আমি নই। এ ঋতুতে প্রথম আমি প্রেমে প্রত্যাখাত হই। রাতের ময়দানে হাওয়া বইছিল, আকাশে তারা ছিল, কিন্তু মনে হচ্ছিল গুটিবসন্ত ছেয়েছে আমাকে। ফিরে ফিরে বঙ্কিমের রোহিণীর মুখ ভেসেছিল। বসন্ত যেন হারানোর এক হাওয়া বইয়ে দেওয়া সময়।’
‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এ বঙ্কিম লিখলেন— ‘কোকিলের ডাক শুনিলে কতকগুলি বিশ্রী কথা মনে পড়ে। কী যেন হারাইয়াছি। যেন তাই হারাইয়া যাওয়াতে জীবনসর্বস্ব অসাড় হইয়া পড়িয়াছে। যেন তাহা আর পাইব না। যেন কী নাই। কেন যেন নাই। কী যেন হইল না। কী যেন পাইব না। কোথায় যেন রত হারাইয়াছি।’
আরও পড়ুন-ভোটের মুখে বাতিল মুসলিমদের সংরক্ষণ
আজি এ বসন্তে— বিলাপী রোহিণীরা। কেউ চাকরি হারিয়েছে। কেউ হারিয়েছে প্রাণের মানুষ। তবু তো মাঠা বুরুর পাহাড়ে, জঙ্গলমহলের পলাশে, টেরাকোটার দেওয়ালে, বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ে, দার্জিলিংয়ে রডোডেনড্রন-এ, কালিম্পংয়ের চা-বাগানে বসন্ত আসে।
বসন্ত রাগে এক পশলা দরবারি
আগ্রাসী ঋতু বসন্ত। কবি নির্মলেন্দু গুণ কবিতায় বলেছেন— বসন্তকে এড়ানোর সাধ্য নেই কারও। ‘বসন্ত বন্দনা’য় বলছেন— ‘এমন আগ্রাসী ঋতু থেকে যতই ফেরাই চোখ,/যতই এড়াতে চাই তাকে, দেখি সে অনতিক্রম্য।/বসন্ত কবির মতো রচে তার রম্য কাব্যখানি/নবীন পল্লবে, ফুলে ফুলে। বুঝি আমাকেও শেষে/গিলেছে এ খল-নারী আপাদমস্তক ভালোবেসে।’
‘নীরা’রা আজও এমন বসন্ত দিনে মুরগি কিনে বাড়ি ফেরে না। বরং শহুরে ক্যাফেতে মেঘমল্লার শোনে। সাইড স্ক্রিনে তখন বসন্ত রাগে এক পশলা দরবারি বেজেই চলে।
আরও পড়ুন-বার্সেলোনায় খেলেই মেসি অবসর নেবে, দাবি আগুয়েরোর
রক্তপ্রবাহে স্লোগান উঠেছে
বসন্ত কেবলই কাব্য নয়। কবিতা নয়। বসন্তের মাঝে লুকিয়ে থাকে জাগরণ। বসন্তই কখনও হয়ে ওঠে দ্রোহের প্রতিমূর্তি। রক্তপ্রবাহে স্লোগান তোলে— তোমাকে তোমাকে চাই।
বসন্ত যেন বারবার বাঙালির জীবনে ফিরে আসে হারানো অধিকার ফিরে পাওয়ার লড়াইয়ে। ৯ ফাল্গুন ওপার বাংলার ছাত্র-যুবকেরা বাংলা ভাষার দাবিতে রাজপথ আপন প্রাণরক্তে রাঙিয়েছে। পলাশরাঙা বসন্তের প্রথম দিনেই জয়নাল, জাফর, কাঞ্চন, দীপালিদের রক্ত মিশেছে রাজপথে।
হে কবি নীরব কেন
সুফিয়া কামালের বসন্ত এসেছে অক্ষরে অক্ষরে, ‘হে কবি নীরব কেন, ফাগুন যে এসেছে ধরায়/ বসন্তে বরিয়া তুমি লবে নাকি তব বন্দনায়?’
সেন্ট ভ্যালেন্টাইন’স ডে বা ভালবাসার দিন এবং বসন্ত উৎসবে অন্য মাত্রা যোগ করছে বাহারি রঙের ফুল। যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন রঙের গোলাপ, গাঁদা, রজনীগন্ধা, অশোক, হিমঝুরি, ইউক্যালিপ্টাস, রক্তকাঞ্চন, কুরচি, কুসুম, গামারি, গ্লিরিসিডিয়া, ঘোড়ানিম, জংলিবাদাম, জ্যাকারান্ডা, দেবদারু, নাগেশ্বর, পলকজুঁই, পলাশ, পাখিফুল, পালাম, বুদ্ধনারিকেল, মণিমালা, মহুয়া, মাদার, মুচকুন্দ, রুদ্রপলাশ, শাল, শিমুল, স্বর্ণশিমুল, কৃষ্ণচূড়া।
আরও পড়ুন-তৃণমূল কংগ্রেসের আইটি সেলের জরুরি ঘােষণা
বাঙালি বসন্তের বিশ্বায়ন
বাঙালি এখন বসন্ত বিলাসী— বসন্ত বিলাপি দেশে দেশে। ভিন রাজ্যেও। টিউলিপ থেকে সাকুরা সবই পলাশের সখী। গ্রাউন্ডহগ চুপিসারে যখন বসন্তের জানান দিয়ে যায় আমেরিকার পেনসিলভানিয়ায় ঠিক তখনই জাপানিরা করে হানামি (জাপানি বসন্ত)-র আয়োজন। এ-সময় ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় চেরি গাছ। চেরি ফুলকে জাপানিরা বলে ‘সাকুরা’। এই ফুল তাদের কাছে পবিত্র, সৌভাগ্যেরও প্রতীক। ফুল ফোটার উৎসব ‘হানামি’ পালনের শুরু হয় সেই সপ্তম শতকে। কৃষ্ণচূড়া যেমন জানুয়ারির শেষ থেকে শুরু করে এপ্রিল পর্যন্তও ফোটে, তেমনই সাকুরা অঞ্চল বিশেষে জানুয়ারি থেকে ফুটতে শুরু করলেও ‘হানামি’র আয়োজন শুরু হয় মার্চ থেকে। প্রকৃতি তখন সবচেয়ে মনোরম।
স্পেনের ভ্যালেন্সিয়ায় বসন্ত-সমাগমে শুরু হয় ‘লাস ফাইয়াস’। মাতা মেরির স্বামী সেন্ট জোসেফকে মনে রেখে এই উৎসব। প্রতিটি এলাকায় বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই কাঠ, কাগজ, মোম প্রভৃতি দিয়ে বড় বড় পাপেট বা পুতুল তৈরির কাজ শুরু হয়। বাজি পোড়ানো হয় উৎসবে। বাজির আগুনের লাল আভায় জ্বলজ্বল করতে থাকে যিশুর জীবনের সঙ্গে জড়িত নানা চরিত্র অবলম্বনে তৈরি বড় বড় পুতুল। বাঙালি নিমেষে মিলিয়ে নেয় নেড়া পোড়া সঙ্গে লাস ফাইয়াসকে। বলতে থাকে— আজ আমাদের নেড়া পোড়া কাল আমাদের দোল পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে, বল হরি বোল।
আরও পড়ুন-কেন্দ্রের বঞ্চনা, সুন্দরবনবাসীর সুরক্ষায় রাজ্যের উদ্যোগ
মেক্সিকোতে বসন্তবন্দনা হয় সাদা পোশাকে, যেন শান্তিনিকেতনে দোলের সকাল। প্রতি বছর মার্চের ২০ আর ২১-এ দলে দলে মানুষ ‘স্প্রিং ইকুইনক্স’ উদযাপন করতে সাদা পোশাক পরে শহর থেকে ৩০ মাইল উত্তর-পূর্বে অবস্থিত বিশাল তুতিহুয়াসান পিরামিডে সূর্যোদয় দেখতে যায়। অনেকেই ৩৬০ ধাপ সিঁড়ি চড়ে পিরামিডের মাথায় পৌঁছে যায়, সূর্যের কাছাকাছি গিয়ে সারা বছরের জন্য প্রাণশক্তি শুষে নেওয়ার সংস্কারে দু’হাত তুলে রোদ পোহায়।
পোল্যান্ডের মারজানা উৎসব
বসনিয়ায় বসন্তের অভ্যর্থনা হয় নবজীবনের প্রতীক ডিম দিয়ে। উৎসবের নাম ‘সিমবুরিজাদা’। বসনা নদীর ধারে সবাই জড়ো হয়, বিনামূল্যে দেওয়া হয় ‘স্ক্র্যাম্বলড এগ’। চিনে রয়েছে বসন্তের লোকগল্প। ‘নিয়োন’ নামের এক ক্ষুধার্ত অপদেবতা দীর্ঘ শীতঘুম শেষে গ্রামে এসে ধ্বংস করত শস্য। পটাপট খেয়ে ফেলত গরু-ছাগল, এমনকী ছোট ছেলেমেয়েদেরও। তার হাত থেকে রক্ষা পেতে প্রাচীন চিনের মানুষ বাড়ির দরজায় রেখে দিত সুস্বাদু খাবার, যেন সেসব খেয়ে তৃপ্ত হয়ে নিয়োন বিদায় নেয়। কিন্তু এক সময় গ্রামের মানুষ লক্ষ্য করল, লাল পোশাকের একটি শিশুকে দেখে নিয়োন ভয় পেয়ে পালাচ্ছে। এরপর থেকেই নিয়োনকে ঠেকাতে শীতের শেষে সকলে লাল বা জমকালো রঙের পোশাক পরতে শুরু করল, শুরু হল লাল রঙের লণ্ঠন দিয়ে ঘর সাজানোর রীতি। এ-যেন বাংলার লাল মাটির আর লাল পলাশের গল্প। এখানে নিয়ন নেই। আছে লাল আবির-পলাশ-কৃষ্ণচূড়া।
আরও পড়ুন-নীতু-সুইটির জোড়া সোনা, অভিনন্দন মুখ্যমন্ত্রীর
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তাইল্যান্ড বসন্তকে স্বাগত জানায় ‘সংক্রান’ উৎসবে। বাংলার ‘সংক্রান্তি’ এখানে ‘সংক্রান’। বেশ মজার এই উৎসব। জলে নেমে পরস্পরকে জল ছিটিয়ে ভিজিয়ে দেওয়া হয় এই উৎসবে। পুরনো রাগ-অভিমান-হিংসা সব ধুয়ে ফেলে শুদ্ধ হয়ে ওঠাই এর উদ্দেশ্য।
বাঙালির বসন্তে টিউলিপ-প্রেম অনেক পুরনো। বসন্ত আসার আগেই দলবেঁধে ছুটে যাই কাশ্মীর। এটাই টিউলিপ টাইম।
হল্যান্ডে বসন্ত উৎসবের নাম হচ্ছে টিউলিপ টাইম। প্রতি বছর বসন্তে প্রায় ৬ মিলিয়ন টিউলিপ ফোটে এখানে।
বসন্তে আকবর বাদশার সঙ্গে হরিপদ কেরানির কোনও ভেদ নাই…।
আকবর থেকে চৈতন্য মহাপ্রভু সকলে মেতেছেন রঙের খেলায়। রাসলীলা থেকে লোকজ গান বাংলার বসন্ত বিলাসের সাক্ষী।
আজও আমরা গলা ছেড়ে গাইতে পারি— আকাশে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা
কারা যে ডাকিল পিছে! বসন্ত এসে গেছে…।
আরও পড়ুন-বৈধতা চ্যালেঞ্জ শীর্ষ আদালতে
ঠিক তা-ই। অনেকের কাছেই বসন্ত হল প্রেমের ঋতু। প্রেম হোক বিরহ হোক। কলমে কলমে ঝড় উঠুক বাঙালির রঙিন অক্ষরের। রাঙিয়ে দিক চেতনা। শুধু আবেগ নয়, বাসন্তী ফুল হোক বিশ্ব বাংলার উপাচার। বিশ্ব বাঙালির আক্ষেপের বিলাস।
বসন্ত বাতাসে সই গো
সেই আক্ষেপের সুর ছড়িয়ে আছে আমাদের প্রাণে। প্রাণ খুলে আমরা গেয়ে উঠি— ‘বসন্ত বাতাসে সই গো, বসন্ত বাতাসে’।
আর বিরহকে লুকিয়ে রাখি হৃদয়ের চিলেকোঠায়— ‘‘অতি নিবিড় বেদনা বনমাঝে রে/আজি পল্লবে পল্লবে বাজে রে-দূরে গগনে কাহার পথ চাহিয়া/আজি ব্যাকুল বসুন্ধরা সাজে রে।”
আরও পড়ুন-হাতির উপদ্রব রুখতে খাদ্যভাণ্ডার
অফিস ফেরার রাস্তায় বা রাতের নিয়ন আলোয় বসন্ত বাতাসের কানে কানে বাজে এ-গান— ‘‘আমার এ বনের পথে/কাননে ফুল ফোটাতে/ভুলে কেউ করত না-গো/কোনদিন আসা যাওয়া/…সেদিন ফাগুন প্রাতে/অরুণের উদয় সাথে/সহসা দিল দেখা/উদাসী দখিন হাওয়া।”
যে পথে কেউ কোনওদিন আসেনি, ফুল ফোটেনি সেই নির্জন পথের একাকী পথিক হয়ে বসন্তকে আপন করে রাখি আমরা।
বসন্ত তাই জড়তা থেকে মুক্তির মন্ত্র দেয়। সঙ্গে উচ্ছ্বাস আর প্রাণচাঞ্চল্য। রবার্ট্র ফ্রস্ট তাঁর ‘এ প্রেয়ার ইন স্প্রিং’-এ বসন্তের কাছে প্রার্থনা করছেন, ‘তুমি আমাদের পুষ্পের আনন্দ দাও, তুমি আমাদের ভালবাসা দাও, ভালবাসার চেয়ে ভাল কিছুই হয় না।’ আর উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ তাঁর প্রাক-বসন্তে বলছেন, ‘বসন্ত আসে স্বয়ং স্বর্গ থেকে, প্রকৃতি পবিত্রতায় পুষ্পিত হয় অতএব এখন শোক করবার সময় নয়।’
তাই তো ‘মানুষ জন্ম আমরা পেয়েছি/মনে হয় কোন এক বসন্তের রাতে/ভূমধ্যসাগর ঘিরে সেই সব জাতি/তাহাদের সাথে/সিন্ধুর আঁধার পথে করেছি গুঞ্জন…।’ বাঙালি যে বসন্ত পাগল। বসন্ত বিলাসী। বসন্ত বিলাপী।
আরও পড়ুন-মোদি-আদানি সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন, তাই নিশানা
লৈতন পেঁদ
পার্থসারথি গোস্বামী
পড়িমরি করে লোক ছুটছে, কিচিক-কিচিক শব্দ হচ্ছে, শহুরে স্যুট-বুট সোজা ল্যান্ড করছেন অখ্যাত পাড়াগাঁয়ে। মাঞ্জা দেওয়া মসৃণ স্ক্রিনের মাইক্রো মিনি বদনে সানসক্রিম মেখে টপাটপ খেতের আল ডিঙোচ্ছে। নানা রঙের পেটমোটা বা স্লিম ফিগার চারচাকা ব্রজের রাঙা ধূলি উড়িয়ে এবড়ো-খেবড়ো পথকে বানিয়ে ফেলছে বুদ্ধা ইন্টারন্যাশনাল সার্কিট। আকাশে বাতাসে শুধু আনন্দ আর আনন্দ।
হইহই রব। লোকে লোকারণ্য, নাভির কাছে প্যান্ট টেনে ধরে থাকা পিছনের দিকটা খালি আধ-ন্যাংটো ছেলেটা খুঁজেই পাচ্ছে না হলটা কী! বিরাট কোনও পরব বসবে হয়তো। কিন্তু নাগরদোলা বা মনিহারী দোকান আসছে কই, দু-একটা ঠেলা গাড়ি যদিও মুড়ি, কলাইভেজা, চপ-ঘুঘনি নিয়ে দোকান দিয়েছে।
আরও পড়ুন-জামিনের শুনানি পিছোল
অবশেষে গাঁয়ের বুড়ো দাদুও তার ছোকরা নাতিটাকে বলতে বাধ্য হচ্ছে,
—হাঁই শুন, কী হল্য বল দেখনি, ই শালা গাদ্যে লোক যে রে। নাতির সোজা জবাব— হাঁ ভাল, কী হইছে আমিও নাই বুঝত্যে পারছি, তবে কেলা যা মাল আমদানি হচ্ছে ন, চোখ গিলাইন জুড়াই যাচ্ছে, সারা বছর ত ওই টেঁপিই হামদের শিরিদেবী। বলেই নাতির ছুট।
হঠাৎ করে গণ্ডগ্রামগুলোতে এত লোক, চকচকে গাড়ি, ঝকঝকে পাঞ্জাবি, কেউ কেউ আবার দলবেঁধে গাছের চারপাশে গোল করে হাতে হাতে ধরে গান গাইছে, কোথাও কোথাও জমিয়ে খিচুড়ি আর মুরগির মাংসের আয়োজন চলছে গাছের তলায় উনুন বানিয়ে, আর শুধু কিচিক-কিচিক-কিচিক। কেউ কেউ ভাবছে হারিয়ে যাওয়া চড়ুই পাখিদের কোনও নতুন প্রজাতি ফিরে এল হয়তো!
কৌতূহল নিবারণের তরে মাতব্বর নটবরকে শব্দের উৎসের কারণ জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, ‘উগুলান সব ছবি মানে ফট তুলার সাইন্ড হে ব’।
—ই বাইসা কার ছবি তুলছে রে বাপ! মাধ্যমিকের রেজাল্ট ত এখন বাইর হয় নাই। উ সময় নাল্যে হামদের বাঁকুড়া, পুরুল্যায় বগলে কেমেরা দাব্যে বোড় ফাস্টের ফট উঠাত্যে আসে গাঁ গিলান্যে।
আরও পড়ুন-কথা রাখলেন অভিষেক, খুলে গেল দোমোহনী হাট
এই অসময়েই লোকের আর খামতি নাই। কেউ আসছে দলে দলে, কেউ বিষণ্ণ হয়ে একা একা ঘুরছে। আর ঝোপে ঝাড়ে দুদ্দাড় করে বেড়ে চলেছে কাচ আর প্লাস্টিকের হরেকরকম বোতলের স্তূপ!
কেউ কেউ আবার একটু সন্তর্পণে গ্রামের কাউকে একটু আড়ালে ডেকে জিজ্ঞাসা করছে— দাদা মহুয়া কোথায় পাওয়া যাবে বলতে পারেন, এই পরিবেশে ইংলিশ একেবারে জোলো লাগছে, একটু মহুয়া, দু-চারটে ফোক সং। মন আজ পুরো বাউল দাদা।
সবই হচ্ছে শুধু গ্রামের মানুষগুলো বুঝতে পারছে না হলটা কী! না, কী হয়েছে সেটা জানতেই হবে, দাদু দেখল নটবরই ভরসা। কারণ নটবরের মতো কয়েকটা ছেলে-ছোকরাই সব লোককে পথ দেখাচ্ছে, দলে দলে ঢুকিয়ে দিচ্ছে বনে বাদাড়ে। নটবরকে একটু একলা পেতেই আড়ালে নিয়ে নিয়ে দাদু বলল— টুকুন ঝাইড়ে কাশ দেখিন ব, ই শালা এখন কন পরব পাইল তক নাই, তবু ই আমাদের গাঁয়ের ইদিকে এত গাদাল্যে গাদাল্যে লোক কেনে বল দেখনি!
আরও পড়ুন-স্বাস্থ্যে নতুন দিগন্ত রাজ্যে
—ই বাপ ইটই ত পরব হে ব। বড় পরব, হামদের লয় উ শহুরা বাবু গিলানের— হামদের হবেকনাই কেনে শুনি! উয়ারা হামদের গাঁয়ে আস্যে মাতুনি কইরব্যাক আর হামরা নাই কইরব?
—ই পরবে তুমার আমার কিছু নাই হে ব, আমিই শালা নাই বুঝলি কীসের এত পুলক ত তুমি কী বুঝব্যে বল, বলছে ন কি হামদের ই পরবটা বুঝার মতন কন ফিলিং নাই।
—ফিলিং! সেটা আবার কী!
—থাল্যে বুঝ, উটই নাই জান ত কী পরব করব্যে, বলছে হামদের উটা নাই ন কি। ত আমার মনে হচ্ছে উট ওই এখনকার চাললাড়া চাটুর মতন চ্যাপ্টা লম্বা পারা যে ফোন গিলান বেরাইছে ন, উ রকমেই কিছু একটা হবেক, সবাই দেখছি উ ফোন গিলানেই ফট গিলান ঢুকাই দিছে আর বলছে পরব পরব পরব। শহরের সব লিখাপড়া করা বড়লোক মানুষ, কত কী জানে, তাই উয়ারা মনে হয় ফিলিং বল্যে কিনেছে কিছু, তুমি আমি আর কুথায় পাব ফিলিং, ন কি ব।
আরও পড়ুন-কেন্দ্রের স্বীকৃতি বনগাঁ হাসপাতালের
—হঁ সে বঠে । হ্যাঁ রে, সে নাল্যে বুইঝলম, কিন্তুক পরবট কী সেট ত বল, কী নাম বঠে পরবের?
—নামটাম জানি নাই হে বাপ, তবে ইট ন কি এই বসন্ত কালের পরব, পরবের নামটই ন কি বসন্ত।
—লে চাঁদি, ইট কন পরব হল্য! বসন্ত আবার পরব! হামদের পিছু ফাট্যে যায় ই বসন্ত আল্যে, বনন্ত মানেই সকালে সুরসুরা পাতলা বাতাস, দুফুর বেলায় তাপ আর সাঁঝের বেলায় হিম, তার ঠেলায় গটা দিন ধইরে খুকখুকানি শুকনা কাশি, ঘরে ঘরে নুনু গিলানের সর্দিকাশি, আর গটা গাঁ মায়ের দয়ায় ধেতলা পাড়া, ভয়ে ভয়ে সইজনা ডাঁটা আর নিমবেগুন খাইয়ে মরছি, আর ইট উয়াদের পরব করার সময়! সব গিলান ফুটাবেক দেখবি।
—ওই যে ব ফিলিং, উয়াদের উটা আছে যে, তাই রোগ জ্বালা নাই হবেক।
—ই বাপ! রোগ জ্বালা নাই হবেক! থাল্যে মানত্যে হবেক ফিলিং একটা জিনিসের মতন জিনিস বেরাইছে বা বঠে।
আরও পড়ুন-বলতে হবে টাকার উৎস, না হলে দিতে হবে ১৩৭ শতাংশ জরিমানা
—শুধু কি উটা হে বাপ, শুন নাই ওই বনধারে কত রিসট হইয়েছে, পাল পাল লোকের ভিড়, খলমকুচির মতন টাকা উড়চ্যে, দিন কতক আগে যারা গাঁয়ের খড়ের ঘর ছাইড়ে শহরে যাইয়ে পাকা মকান বানালি তারাই আবার টাকা দিয়ে উখেনকার খড়ের ঘরে রাইত কাটাচ্ছে, পিদিমের আলতে। বড় মাস্টার বইলত বহু আগে মানুষ গাছে রাইত কাটাত্য, কাঠের আগুনে পুঁড়াই মাংস খাতেক। সে শখ গিলানও ফিরে আসছে হে বাপ, গাছের উপর মাচা বাঁধ্যে বলছে টিরি হাউস, তলে আঙ্গরা জ্বাইলে গটা গটা মুরগি গিলাইন ধুড়সাই মাইরে দিচ্ছে, সব ওই ফিলিং-এর চোটে হে ব।
—বিস্তর ব্যাপার যে রে, এত ত শুনি নাই। তবে বুঝলি একটা ফিলিং না কিনল্যে জীবনট বিথা, উটা কিনত্যে পারল্যে হামদেরও মনে হয় জীবন গিলাইন পাইল্টে যাবেক। কিন্তুরুক হেঁ রে, বসন্ত ত শহরেও আছে তার লাগ্যে উয়াদিকে গাঁয়ে কেনে আসত্যে হবেক?
—ই বাইসা জান নাই! পলাশ ফুট্যেছে হে ব।
আরও পড়ুন-রাহুলের সাংসদ পদ বাতিল, কেন্দ্রকে তোপ তৃণমূলনেত্রী ও অভিষেকের
—ত কী হইয়েছে, উ ত পতি বছর ফুট্যে।
—ই বাপ, উ পলাশ দেখ্যেই ন কি বুক হুদক্যে হুদক্যে উঠচ্ছ্যে উয়াদের, পলাশের রং ন কি উয়াদের ধনে মনে আগুন লাগাই দিচ্ছে। কত গান বাঁধচ্ছ্যে পলাশ লিয়ে। মাইয়া গিলান ত পটাপট পলাশ ফুলের ডাল গিলাইন ভাঙচ্ছ্যে আর ফুল গিলাইন গুঁজে লিছেক মাথায় বুকে ইখেনে উখেনে।
—অ, ইট উয়াদের ফিলিং! ফুল গিলান গাছের লে উয়াদের মাথায় গলায় বেশি শোভা পাবেক?
—হঁ ব, ওই মাতনেই ত মাত্যেছে সবাই।
কানের পাশে গুঁজে-রাখা আধপোড়া চুটিটা হাতে নিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে দাদু বলল— বুইঝলম। ফিলিংট কি সেটা বুইঝলম, ফিলিং ন আমড়া পাকা। বাপ হুঁ কত্তেই বইলথক ‘বন ফুরাল্যে কেঁদ আর ধন ফুরাল্যে পেঁদ’, ইট থাল্যে উয়াদের আর একটা লৈতন পেঁদ।