গান্ধীর আদর্শ মুছতে তৎপর ওরা

মুখে এক— কাজে আর-এক। এটাই মোদি সরকারের ও গেরুয়া রাজনীতির বৈশিষ্ট্য। সেই নির্লজ্জ দ্বিচারিতার মুখোশ ছিঁড়লেন চন্দন পাল

Must read

জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর ১৫৪তম জন্মজয়ন্তী পালনের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। সরকারি এবং বেসরকারি নানান সংগঠনের উদ্যোগে সারা দেশে নানান ভাবে এই দিনটি পালিত হবে। শুধু ভারতে নয় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এই মনীষীর জন্মদিনটিকে (২ অক্টোবর) ইউনাইটেড নেশনস দ্বারা ২০০ সালে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক অহিংসা দিবস (International Day of Nonviolence) হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

আরও পড়ুন-করাচিতে খতম কুখ্যাত হাফিজ সইদের সহযোগী

সততা, ন্যায়নিষ্ঠা, মানবীয় মূল্যবোধ, নৈতিকতা, সহজ-সরল জীবন এবং অহিংসক সংগ্রামী হিসেবে ভারতবাসী শুধু নয় বিশ্ববাসী যখন তাঁকে প্রেরণার উৎস হিসেবে বরণ করে নিয়েছে তখন তাঁর নিজের দেশের কিছু বিপথগামী সংকীর্ণ মানসিকতায় আবদ্ধ মানুষ ও সংগঠন তাঁর আদর্শকে জনমানস থেকে মুছে ফেলত। শুধুমাত্র তাঁর প্রতি ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ, অপমানকর, অসম্মানজনক ভাষা ব্যবহার করে অথবা তাঁর মূর্তি ভেঙে, নাটকীয়ভাবে তাঁর ছবিতেগুলি করে রক্ত ঝরিয়ে ক্ষান্ত না হয়ে যাতে তাঁর আদর্শকে ভিত্তি করে কোনওরূপ কর্মকাণ্ড না চলতে পারে তার জন্য তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংগঠন যেমন সত্যাগ্রহ আশ্রম বা সবরমতী আশ্রম (১৯১৭), গুজরাট বিদ্যাপীঠ (১৯২০) সরকারি গৃধ্নু দৃষ্টির শিকার হয়েছে।

আরও পড়ুন-বৃষ্টি উড়িয়ে উপচে পড়ল পুজোর বাজার

একদিকে যেমন স্বাধীনতা সংগ্রামের সত্যাগ্রহী তৈরির পীঠস্থান হিসেবে পরিচিত সবরমতী আশ্রম যা ছিল প্রেরণাস্থল তা আজ বিলাসবহুল হোটেল, মল, প্লাজা, রেস্টুরেন্ট নিয়ে পর্যটনস্থল হিসেবে পর্যবসিত হতে যাচ্ছে। যে গুজরাট বিদ্যাপীঠ গান্ধী আদর্শের এক উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যে প্রতিষ্ঠান গান্ধী-অধ্যয়ন ও গবেষণার জন্য দেশে বিদেশে সমাদৃত তা আজ গান্ধী-বিরোধীদের করায়ত্ত। উভয় ক্ষেত্রেই নির্লজ্জভাবে সরকারি অনুপ্রবেশ দেখা গেছে। ধারাবাহিক এই আক্রমণের সম্প্রতিক শিকার যে গান্ধী সংগঠনটি হয়েছে তা হল ‘সর্ব সেবা সংঘ’ (অখিল ভারত সর্বোদয় মণ্ডল) যার পূর্ব নাম ছিল অখিল ভারত সর্ব সেবা সংঘ। বহু মানুষের কাছে সর্ব সেবা সংঘ নামটি অপরিচিত হওয়ার কারণে এর অতীত ইতিহাসের দিকে একটু ঘুরে তাকানো যাক।

আরও পড়ুন-আইএসআইয়ের সাম্মানিক পদে দাউদ ইব্রাহিম?

১৯৪৮ সালে ২-৩ ফেব্রুয়ারি ভারতের নবনির্মাণে নিজস্ব ভাবনা ও পরিকল্পনা দেশবাসীর সামনে উপস্থাপিত করার উদ্দেশ্যে নিজ প্রতিষ্ঠিত সেবাগ্রাম আশ্রমে (১৯৩৬) মহাত্মা গান্ধী এক সম্মেলন আহ্বান করেন। কিন্তু সেই সম্মেলন আর করা সম্ভব হয়নি তার পূর্বেই সংকীর্ণ হিন্দুত্ববাদী নাথুরাম গডসের তিন-গুলি গান্ধীজিকে দেশবাসীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়। হঠাৎ অনাকাঙ্ক্ষিত এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে অত্যন্ত বিমূঢ় গান্ধী-অনুসারী, স্বাধীনতা সংগ্রামী দেশের নেতৃবৃন্দের আহ্বানে ১৯৪৮ সালে ১৩-১৫ মার্চ ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের সভাপতিত্বে সেবাগ্রামে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে গান্ধীজির প্রথম সত্যাগ্রহী ভূদান আন্দোলনের প্রণেতা আচার্য বিনোবা ভাবে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, ড. জাকির হুসেন, ড. প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, লোকনায়ক জয়প্রকাশ নারায়ণ, আচার্য জে বি কৃপালনি, সুচেতা কৃপালনি, আশাদেবী আর্যনায়কম, জে সি কুমারাপ্পা দাদা ধর্মাধিকারী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। উক্ত সম্মেলনে মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ ও কর্মকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য গান্ধী ভাবধারার শীর্ষ সংগঠন হিসেবে সর্বসেবা সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়।

আরও পড়ুন-মোদি সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, দিল্লিতে বন্ধ হল আফগান দূতাবাস

বিগত ৭৫ বছরে সর্বসেবা সংঘের নেতৃত্বে যেসব উল্লেখনীয় কাজ হয়েছে তার মধ্যে (১) ভূদান আন্দোলনে সারা দেশে প্রায় ৪৫ লক্ষ একর জমি দান হিসেবে পাওয়া যায়। তার মধ্যে অর্ধেকের বেশি জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরিত হয়। (২) বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক স্তরে বিষয়টিকে তুলে ধরা হয়। (৩) শরণার্থী শিবিরে সেবাকাজ দীর্ঘদিন চলতে থাকে। (৪) পরমাণু যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বের জনমানস তৈরিতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়। (৫) খাদি গ্রামোদ্যোগ কর্মসূচিকে ব্যাপকভাবে প্রসারের দৃষ্টিতে উদ্যোগ নেওয়া হয়। (৬) দেশে বিদেশে শান্তি আন্দোলনকে প্রসারিত করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। (৭) গণতন্ত্র রক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখনীয় ভূমিকা পালন করে। (৮) বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাগ্রস্ত এলাকায় শান্তি স্থাপনে উদ্যোগী হয়। (৯) বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের পাশে থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। (১০) কিসান আন্দোলনের সমর্থনে সক্রিয় যোগদান করেছে। (১১) গান্ধী-সাহিত্য প্রচার প্রসারে উল্লেখনীয় ভূমিকা পালন করেছে।

আরও পড়ুন-পুরনো পেনশন নীতি ফেরানোর দাবিতে রাজধানীতে আন্দোলনে সরকারি কর্মীরা

এমনই গান্ধী সংগঠন সর্বসেবা সংঘের প্রকাশন বিভাগ যা বিগত প্রায় ষাট দশক যাবৎ রাজঘাট, বারাণসী, উত্তরপ্রদেশে গঙ্গা ও বরুণা নদীর সংযোগস্থলে ক্রয়কৃত প্রায় ১৩ একর জমির উপর কাজ করে এসেছে তা আজ অতীত হয়ে গেছে। বিগত ১৯৬০, ১৯৬১ এবং ১৯৭০ সালে তিনটি বিক্রয় দলিলের মাধ্যমে রেল বিভাগ থেকে অখিল ভারত সর্বসেবা সংঘের নামে কেনা হয়। এই জমি কেনার পেছনে যাঁদের ভূমিকা ছিল তাঁরা হলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ, আচার্য বিনোবা ভাবে, লালবাহাদুর শাস্ত্রী, বাবু জগজীবন রাম। ১৯৬৪ সালে ওই জমিতে ‘সাধনা কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়। যার উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী।

আরও পড়ুন-অভিনেতার চাকার তলায় পিষে গেল দম্পতি, গ্রেফতার তারকা

উল্লেখনীয় যে, ১৯৬০ সালে লোকনায়ক জয়প্রকাশ নারায়ণ গান্ধী বিচারের উচ্চ অধ্যয়ন ও গবেষণার জন্য প্রস্তাব দিলে সর্বসেবা সংঘের ওই জমিতে ‘গান্ধী বিদ্যা সংস্থান’ (Gandhian Institute of Studies) প্রতিষ্ঠিত হয়। যেখানে বিদেশের ছাত্র-ছাত্রীরা অধ্যয়ন করতেন আর অধ্যাপক অম্লান দত্ত, অধ্যাপক সুগত দাশগুপ্তের মতো প্রথিতযশা বহু অধ্যাপক যুক্ত ছিলেন। বিভিন্ন কারণে এই সংস্থায় পঠন-পাঠন বন্ধ থাকে। এই সংস্থার পরিসরে বসে বিশ্ব বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ Prof. E. F Shumakhar সেই প্রসিদ্ধ বই ‘Small is Beautiful’ রচনা করেন।

আরও পড়ুন-দুর্ঘটনাগ্রস্ত তৃণমূল কর্মীদের দিল্লিগামী বাস, এক্সে সুকান্তকে নিশানা দেবাংশুর

হঠাৎ ২৬ জুন, ২০২৩-এ এক সরকারি নোটিশ এই ঐতিহ্যশালী সংগঠনের প্রতিটি বাড়িতে লাগিয়ে দেওয়া হয় যাতে বলা হয় ৩০ জুন, ২০২৩-এর মধ্যে খালি করে দেওয়া না হলে ৩০ জুন প্রশাসন দ্বারা খালি করে দেওয়া হবে। এরকম একটা হতে পারে অনুমান করে ১৫ মে, ২০২৩ থেকে সত্যাগ্রহের মাধ্যমে প্রতিবাদ চলতে থাকে। যেহেতু এলাকাটি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সংসদীয় এলাকা তাই একবার তাঁর আগমনে বারাণসীতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতে তাঁর হাতে এক স্মারকলিপি দেওয়া হবে বলে ঠিক হয়। কিন্তু তাঁর দফতর থেকে সময় না মেলায় স্মারক লিপিটি গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়। নানাভাবে প্রতিবাদ চলতে থাকে। আদালতেও লড়াই চলতে থাকে, সত্যাগ্রহও চলতে থাকে। এরই মধ্যে ২২ জুলাই, ২০২৩ সকাল থেকে রেল অধিকারী, বারাণসী প্রশাসনের অধিকারী ও কয়েকশো পুলিশ সর্বসেবা সংঘের পরিসরে জোর করে প্রবেশ করে সব খালি করার নির্দেশ দেয়। অধিকারীদের কাছে আদালতের কোনও অর্ডার আছে কি না জানতে চাওয়া হলে আদালতের কোনও অর্ডার না দেখিয়ে সংঘের সভাপতি-সহ ৮ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে জেলে নিয়ে যায়।

আরও পড়ুন-‘বকেয়া দিতেই হবে’

সেই সঙ্গে লাইব্রেরি, সংগ্রহশালা, পাঠাগার, শিশুদের পাঠশালা, কর্মীদের আবাসগৃহ জোর করে খালি করা হয়। সংঘের প্রকাশন বিভাগের লক্ষাধিক বই খোলা জায়গায় ছুঁড়ে-ছুঁড়ে ফেলা হয়। সমস্ত পরিসরের দখল নেওয়া হয়। তার কয়েকদিন পর ১২ আগস্ট, ২০২৩ বুলডজার দিয়ে ঐতিহ্যশালী অনেক ইতিহাসের সাক্ষী প্রায় ২৫খানা বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। যা অতীতের নালন্দার ধ্বংসকারীদের কথা স্মরণ করায়। এর থেকে প্রমাণ হয় শুধুমাত্র বাড়িঘর ধ্বংস করে অন্যায়ভাবে জায়গা দখল করাই মূল উদ্দেশ্য নয়, নবপ্রজন্ম যাতে গান্ধী-বিচার জানতে না পারে, তার প্রতি আকৃষ্ট না হতে পারে, গান্ধী-আদর্শকে মুছে ফেলতে এ এক ঐতিহাসিক ষড়যন্ত্র বলা যায়।

Latest article