অর্ধেক আকাশে স্বপ্নের উড়ান

সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে রাজ্য ও জাতীয় স্তরের কয়েকটি পরীক্ষার ফলাফল। মেয়েদের সাফল্য রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো। কয়েকজনের নাম উঠেছে মেধাতালিকায়, কয়েকজন দখল করেছেন শীর্ষস্থান। এই সাফল্য কিন্তু সহজে আসেনি। কাউকে কাউকে পেরোতে হয়েছে নানারকম বাধা, সমস্যা। ব্যতিক্রমী মেয়েদের আশাতীত সাফল্যের কথায় অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

শরণ্যা ঘোষ
পুরুষ থেকে নারী
জন্মেছিলেন পুরুষ হিসেবে। কয়েক বছর যেতে না যেতেই বুঝতে পারেন, পুরুষের শরীর পেলেও, তিনি মনেপ্রাণে একজন নারী। ছোটবেলায় তাঁর হাঁটাচলা দেখে, কথাবার্তা শুনে অনেকেই ব্যঙ্গবিদ্রুপ করতেন। বাঁকা চোখে দেখতেন। বলতেন, নারীসুলভ পুরুষ। শেষমেশ তিনি একটা সময়ে চরম সিদ্ধান্ত নেন। পুরুষ থেকে রূপান্তরিত হন নারীতে। ছিলেন শরণ্য, হলেন শরণ্যা। শুধুমাত্র এই কারণে নয়, তিনি আরও একটি কারণে রয়েছেন চর্চায়।

আরও পড়ুন-৪৪ দিনে ৪হাজার কিমি পথ পেরলো অভিষেকের জনসংযোগ যাত্রা

মেধাতালিকায় সপ্তম
এইবছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন হুগলির জনাইয়ের এই বাসিন্দা। চমকে দেওয়ার মতো বিষয়, মেধাতালিকায় রয়েছে তাঁর নাম। সপ্তম স্থান অর্জন করেন রূপান্তরকামী শরণ্যা, শরণ্যা ঘোষ। তাঁর প্রাপ্ত নম্বর ৫০০-র মধ্যে ৪৯০। শরণ্যার সাফল্যে খুশির জোয়ার পরিবার থেকে স্কুলে। খুশি এলাকাও। বাংলার ইতিহাসে সম্ভবত এই প্রথম উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় কোনও রূপান্তরকামী মেধাতালিকায় স্থান পেয়েছেন। ১৮ বছর বয়সি শরণ্যা কলাবিভাগে পড়াশোনা করেন। বাংলায় ৯৪, ইংরেজিতে ৯৫, অর্থনীতিতে ৯৭, ভূগোলে ৯৯, ইতিহাসে ১০০ এবং ঐচ্ছিক বিষয়ে ৯৯ পেয়েছেন।

আরও পড়ুন-আতঙ্কের রেলযাত্রা, ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা এড়াল দুর্গ-পুরী এক্সপ্রেস

একাদশ শ্রেণিতে সিদ্ধান্ত
বাবা প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক। মা গৃহশিক্ষিকা। মধ্যবিত্ত পরিবার। চণ্ডীতলার জনাই ট্রেনিং হাইস্কুলের পড়ুয়া শরণ্যা ছোট থেকেই মেধাবী। স্কুলে প্রথম হতেন। একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় বুঝতে পারেন আগামী জীবনটা নারী হিসাবেই বাঁচতে চান। সংবাদমাধ্যমকে জানান শরণ্য থেকে শরণ্যা হয়ে ওঠার যাত্রার কথা। বলেন, ‘‘পুরুষ হলেও, নারীসত্তা প্রবলভাবেই ছিল আমার মধ্যে। স্কুলে খেলাধুলা করতাম মেয়েদের সঙ্গে। সহপাঠীরা অনেকেই বাঁকা চোখে দেখত। একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় বুঝতে পারি, আমি আসলে একজন নারী। সিদ্ধান্ত নিই, পরবর্তী জীবনে নারী হিসাবেই বাঁচব। তারপরই পুরুষ থেকে নারীতে রূপান্তরিত হই। সেই সময় পাশে ছিল পরিবার এবং স্কুল। এই লড়াইয়ে সবাই মনোবল বাড়াতে সাহায্য করেছেন। তাই আমি পেরেছি। একটা সময় কটুকথা ছোঁড়া হত আমার দিকে। কখনও কখনও দিতাম মোক্ষম জবাব। আনন্দের বিষয়, একদিন কটুকথা বলা মানুষগুলোই আজ আমার সাফল্যে খুশি। তাঁরা আমাকে বুঝেছেন। এটা আমার মস্তবড় জয়। আমার রোল মডেল মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে দেখেই অনুপ্রাণিত হয়েছি। তিনি আমাকে আশীর্বাদ করেছেন। আমার জন্য প্রার্থনা করেছেন।”

আরও পড়ুন-৬৬তম ন্যাশনাল স্কুল গেমস: বাংলার সোনা-রুপো-ব্রোঞ্জ জয়ীদের শুভেচ্ছা মুখ্যমন্ত্রীর

কী হতে চান?
বিগত এক বছরের কঠিন লড়াই। এইভাবেই উচ্চমাধ্যমিকের পাশাপাশি জীবনযুদ্ধেও জয়ী হয়েছেন শরণ্যা। দূর করেছেন সমস্ত বাধা। ভবিষ্যতে সরকারি আমলা হয়ে মানুষের জন্য কাজ করতে চান। অথবা হতে চান অধ্যাপক। পাশাপাশি পাশে থাকতে চান রূপান্তরকামীদের। তাঁদের জন্য কাজ করতে চান। শরণ্যার সাফল্যে খুশি রূপান্তরকামীরাও। তাঁরা মনে করেন, রূপান্তরকামীরা এইভাবেই পড়াশোনা করুক, মাথা তুলে দাঁড়াক। তাঁদের যে বুদ্ধি আছে, মেধা আছে, প্রমাণ করেছেন শরণ্যা। আগামী দিনে আরও অনেক শরণ্যা উঠে আসবেন সমাজ থেকে।

###########

লতিকা মণ্ডল
ছেলের সঙ্গে
দুই সন্তানের মা লতিকা মণ্ডল। থাকেন নদিয়ার শান্তিপুর থানার নৃসিংহপুর নতুন সর্দারপাড়ায়। সংসার চালান তাঁত বুনে। এই মুহূর্তে তিনি বহু মানুষের চর্চায়। কী করেছেন তিনি? বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এই বছর উত্তীর্ণ হয়েছেন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায়। তাও আবার নিজের ছেলের সঙ্গে। ফল প্রকাশের পর দেখা গেছে, লতিকার প্রাপ্ত নম্বর ৩২৪। ছেলে সৌরভের প্রাপ্ত নম্বর ২৮৪! হইচই পড়ে গিয়েছে এলাকায়। লতিকার প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ। প্রশ্ন উঠেছে, দুই সন্তানের মা এই বয়সে উচ্চমাধ্যমিক দিলেন কেন? জানতে হলে ফিরে যেতে হবে অতীতে।

আরও পড়ুন-অর্ধাঙ্গিনী: সম্পর্কের উদ্‌যাপন

ছিল পড়াশোনার ইচ্ছে, বাপের বাড়িতে ছিল আর্থিক অনটন। ষষ্ঠ শ্রেণি পাশ করার পর আর পড়াশোনার খরচ জোগাতে পারেননি লতিকার বাপের বাড়ির সদস্যরা। অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যায় তাঁর। বিয়ের পরে ঘর সংসার সামলাতে চলে যায় অনেকগুলো বছর। তবে মনের মধ্যে ছিল পড়াশোনার ইচ্ছে। মেয়ে যখন কলেজের গণ্ডিতে, তখন লতিকার পড়াশোনা করার ইচ্ছেটা নতুন করে পল্লবিত হয়ে ওঠে।
রবীন্দ্র মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
যেমন ইচ্ছে তেমন কাজ। এরপর এক প্রতিবেশীর সাহায্যে রবীন্দ্র মুক্ত বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে ভর্তি হন লতিকা। ছেলে সৌরভ মণ্ডলের সঙ্গে একই বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন। মাধ্যমিকের গণ্ডি পার করে লতিকা ভর্তি হন নৃসিংহপুর উচ্চবিদ্যালয়ে। বলা যায় গোপনেই। বেশি কেউ জানতেন না। সকালে তাঁত বোনার কাজ, তারপর রান্নাবান্না সেরে দুপুরে স্কুল। বিকেলে ফিরে এসে ঘরের কাজ। রাতে পড়াশোনা। এইভাবেই চলছিল। ছেলে সৌরভ মণ্ডল তখন পড়ছেন কালনা উচ্চ বিদ্যালয়ে। মা ও ছেলে একসঙ্গে পরীক্ষা দেন। উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরনোর পর দেখা যায়, ছেলের থেকে ৪০ নম্বর বেশি পেয়েই পাশ করেছেন লতিকা।
আমিই যেন অপু
কথা হল তাঁর সঙ্গে। লতিকা জানালেন, ‘‘অভাবের কারণে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল পড়াশোনা। দেরিতে হলেও মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলাম। কিছু সমস্যা ছিল। সব পেরিয়েছি। বাড়িতে সবাই উৎসাহ দিয়েছেন। আমার স্বামী, দুই সন্তান খুব খুশি। সময় পেলে আমি ছেলেমেয়েকে পড়াই। টিচাররা খুব সাহায্য করেছেন। হেড স্যার সৌমিত্র বিদ্যান্তর কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।’’ পরীক্ষা দিয়ে কী মনে হয়েছিল? লতিকা জানালেন, ‘‘আমার কোনও প্রাইভেট টিউটর ছিল না। নিজে নিজেই পড়তাম। পরীক্ষা দিয়ে মনে হয়েছিল, আমি পাশ করব। পড়াশোনার বই ছাড়াও ভাল লাগত অন্যান্য বই। পড়েছি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’। মনে হত, আমিই যেন অপু। আগামী দিনে আরও পড়াশোনা করতে চাই। দেখা যাক কী হয়!’’

আরও পড়ুন-প্রয়াত লবনহ্রদ সংবাদের সম্পাদক সুধীর দে

#############

লিসা দাস
মেধাবী ছাত্রী
হাওড়ার আমতার ১ নং ব্লকের সোনামুই গ্রাম। এই গ্রামের ফুলের মতো একটি মেয়ে লিসা দাস। সহজ সরল। ছাত্রী হিসেবে বরাবরই মেধাবী। স্কুলের পরীক্ষায় বরাবর ফাটাফাটি রেজাল্ট। সবকিছু চলছিল ঠিকঠাক। দুই বছর আগে হঠাৎ ঘটে যায় ছন্দপতন। ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বাবা। সংসারের হাল ধরেন মা। নেন আশাকর্মীর কাজ। ঘরে অভাব। তার মধ্যেই মন দিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যান লিসা। লক্ষ্য ভাল রেজাল্ট। কিছুদিন আগেই প্রকাশিত হয়েছে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল। ৪৫০ নম্বর পেয়ে লিসা স্কুলের সেরা হয়েছেন। বাংলায় ৮৭, ইংরেজিতে ৯২, শিক্ষা বিজ্ঞানে ৯২, ভূগোলে ৮৮, সংস্কৃতে ৯০, পরিবেশ বিজ্ঞানে ৮৮ পেয়েছেন। আমতা সোনামুই কাদম্বিনী বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী লিসা স্কুলের এবং গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। হাসি ফুটিয়েছেন মায়ের মুখে। তাই সবাই খুব খুশি।
নার্স হতে চান
ছবি আঁকতে ভালবাসেন লিসা। সময় পেলেই রাঙিয়ে তোলেন সাদা ক্যানভাস। এক সময় নাচ শিখতেন। এখন আর সময় হয় না। তবে বই পড়েন। বিশেষত বিভিন্ন বিখ্যাত মানুষের জীবনী। সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’ তাঁর খুব প্রিয় বই। কথা হল লিসার সঙ্গে। তিনি জানালেন, ‘‘স্কুলের টিচাররা আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। সাহায্য করেছেন প্রাইভেট টিউটর। বিনা পয়সায় আমাকে পড়িয়েছেন। প্রতিদিন চার-পাঁচ ঘণ্টা পড়তাম। এত ভাল রেজাল্ট হবে ভাবতেই পারিনি। মা আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। নানা ভাবে সহযোগিতা করেছেন গ্রামের অনেকেই। তাঁদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। সবাই মিলে পাশে না দাঁড়ালে এত ভাল রেজাল্ট করতে পারতাম না।’’ কী হতে চান? লিসা জানালেন, ‘‘নার্স হতে চাই। সেবা করতে চাই মানুষের। হতে চাই স্বাবলম্বী।’’

আরও পড়ুন-পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘোষণা হতেই বেসামাল বিজেপি, ফের ইডির তলব

###########
ভাগ্যশ্রী মণ্ডল
বাবার মুখাগ্নি করে
ইতিহাস পরীক্ষার আগের দিন অন্ধকার নেমে আসে। মারা যান বাবা। তাঁর মুখাগ্নি করে বুকফাটা কান্না চেপে রেখে পরীক্ষায় বসেছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার মছলন্দপুরের ভাগ্যশ্রী মণ্ডল। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর জানা যায়, ইতিহাসে ৬৪ পেয়েছেন ভাগ্যশ্রী। পাশ করেছেন ভালভাবেই।
বাইক দুর্ঘটনা
বাবা অনিমেষ মণ্ডল ছিলেন পেশায় চিকিৎসক। থাকতেন রাজস্থানে। একসময় গোটা পরিবার রাজস্থানে থাকতেন। মেয়েদের পড়াশোনার জন্য মা দুই মেয়েকে নিয়ে মছলন্দপুরে চলে আসেন। উচ্চমাধ্যমিকে ইংরেজি পরীক্ষার দিন ভাগ্যশ্রী জানতে পারেন, রাজস্থানে বাবার বাইক দুর্ঘটনা হয়েছে। বাইক চালিয়ে রোগী দেখতে যাওয়ার সময় সামনে গরু চলে আসে। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তায় পড়ে যান বাবা। এই খবর যেদিন আসে, তার পরের দিন ছিল ইংরেজি পরীক্ষা। ইংরেজিতে ৬৬ পেয়েছেন ভাগ্যশ্রী। উচ্চমাধ্যমিকে তাঁর মোট নম্বর ৩৫১।
চিন্তায় গোটা পরিবার
ভাগ্যশ্রী রেলে চাকরি করতে চান। এই মুহূর্তে পরিবারে রয়েছে অর্থসংকট। কারণ রোজগার করতেন বাবা। আজ তিনি নেই। কীভাবে চলবে আগামী দিন, চিন্তায় গোটা পরিবার। উড়ে গিয়েছে ঘুম। উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরনোর পর অনেকেই এসেছেন শুভেচ্ছা জানাতে। ভাগ্যশ্রী মনে করেন, কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কারণ তাঁর সঙ্গে রয়েছে বাবার আশীর্বাদ। এই আশীর্বাদ তাঁকে লড়াই করতে সাহায্য করবে।

আরও পড়ুন-প্রয়াত লবনহ্রদ সংবাদের সম্পাদক সুধীর দে

###############
মৌসুমি দোলুই
বাবাকে শ্মশানে রেখে
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার আগের রাতে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত বাবা। শেষমেশ চলেই গেলেন না ফেরার দেশে! এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। এতদিনের প্রস্তুতি, এখন কী করবেন মেয়ে? বাবাকে শ্মশানে রেখে বুকের কষ্ট চেপে পরীক্ষার হলে পৌঁছন মৌসুমি, মৌসুমি দোলুই। পরীক্ষা দিয়েছেন কোনওরকমে। তাই পরিবারের কেউ ভাল ফল আশা করেননি।
সবাই অবাক
কিছুদিন আগেই প্রকাশ পেয়েছে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল। বীরভূমের বোলপুর ১০ নম্বর ওয়ার্ডের মৌসুমি সবাইকে অবাক করে দিয়ে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছেন। পারুলডাঙা শিক্ষানিকেতন আশ্রম বিদ্যালয়ের এই ছাত্রী পেয়েছেন ৬২ শতাংশ নম্বর। শিক্ষকেরা মনে করেন, বাবার মৃত্যুর ঘটনা না ঘটলে হয়তো তাঁর ফল আরও ভাল হত।
চিন্তায় পরিবার
মৌসুমির বাবা অষ্টম দোলুই। বোলপুরের নেতাজি বাজার এলাকায় চায়ের দোকান ছিল তাঁর। সেই দোকানের উপার্জন দিয়ে চলত চারজনের সংসার। পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সদস্য ছিলেন। তাঁর অকালে মৃত্যু দোলুই পরিবারকে দাঁড় করায় খাদের কিনারে। চিন্তায় পড়েছেন মা। দুই মেয়েকে নিয়ে কী করবেন, ভেবে পান না। বাধ্য হয়ে মা চায়ের দোকানের দায়িত্ব তুলে নেন নিজের কাঁধে। পেট চালাতে হবে তো! মৌসুমি ভাল রেজাল্ট করেছেন। কিন্তু কী হবে ভবিষ্যৎ? চিন্তায় পরিবার।
স্বপ্ন দেখতেন বাবা
মৌসুমি আশায় আছেন, কেউ নিশ্চয়ই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন। তিনি বলেন, ‘‘প্রথম বিভাগে পাশ করেছি। বাবার মৃত্যু না হলে হয়তো আরও ভাল রেজাল্ট হত। আশা করেছিলাম, অনেক বেশি নম্বর পাব। কিন্তু সেটা হল না। জানি না, আগামী দিনে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারব কি না। তবে চেষ্টা চালিয়ে যাব। বাবা আমাকে নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্ন পূরণ করব। সহৃদয় মানুষের সাহায্য পেলে উপকৃত হই।’’

আরও পড়ুন-নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠানের নামে কেরল সিপিএমের তোলাবাজি!

#############
তিয়াসা প্রামাণিক
হুইলচেয়ার
দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর মজিলপুর পুরসভা এলাকার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ঘোষপাড়ার বাসিন্দা তিয়াসা প্রামাণিক। এবারের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছেন। পেয়েছেন ৩৮৩ নম্বর। এইটুকু পড়লে বোঝা যাবে না কিছুই। মনে হতে পারে, ৩৮৩ কী এমন নম্বর! এর থেকে অনেকেই বেশি পেয়েছেন। তাহলে কেন এত আলোচনা? খুব সহজে আসেনি তিয়াসার এই সাফল্য। কারণ তিনি দুরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত। একেবারেই হাঁটাচলা করতে পারেন না। ভরসা হুইল চেয়ার। মনের জোরে পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিয়ে সফল হয়েছেন। পাশাপাশি পেয়েছেন তিনটি বিষয়ে লেটার।

আরও পড়ুন-মুম্বইয়ে নৃশংস খুন সঙ্গীকে, দেহের টুকরো সিদ্ধ করল প্রৌঢ়

সুরেলা কণ্ঠ
তিয়াসার পরিবার নিম্নমধ্যবিত্ত। বাবা তাপস প্রামাণিক। পেশায় একজন ব্যবসায়ী৷ জয়নগরেই একটি জামাকাপড়ের দোকান চালান। ছোটবেলা থেকে মেধাবী ছাত্রী হিসেবে এলাকায় পরিচিতি তিয়াসার। সুরেলা তাঁর কণ্ঠ। দীর্ঘদিন গানের শিক্ষকের কাছে তালিম নিয়েছেন। এলাকার পাশাপাশি বাইরেও বিভিন্ন গানের অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। গান করেছেন টিভির অনুষ্ঠানেও।
মনের জোর
সবকিছু চলছিল ঠিকঠাক। গানের নরম সুরের মতোই। হঠাৎ ছিঁড়ে যায় গিটারের তার, কেটে যায় তাল। ২০২০ সাল নাগাদ, দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিয়াসা। পায়ের যন্ত্রণা দিয়ে সমস্যার শুরু। ডাক্তার দেখিয়ে জানা যায়, মেরুদণ্ডে টিউমার। বেঙ্গালুরু গিয়ে চিকিৎসার পর ক্যানসার ধরা পড়ে। তারপর কলকাতার টাটা ক্যানসার হাসপাতালে চিকিৎসা। তিন-চারমাস ঠিক থাকার পর আবার সেই আগের অবস্থায় ফিরে আসেন। কপালে চিন্তার ভাঁজ পরিবারের। এইটুকু মেয়ের শরীরে মারণরোগ! তবে হাল ছাড়েন না কেউ। শক্ত থাকেন মানসিকভাবে। কঠিন লড়াই। ইতিমধ্যেই দু’বার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন তিয়াসা। একটু সুস্থ হতেই হাতে তুলে নিয়েছেন বই, খাতা। প্রবল মনের জোর এবং ইচ্ছাশক্তির জেরে হুইলচেয়ারে বসেই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছেন। সাফল্য পেয়েছেন জয়নগর ইনস্টিটিউট অফ গার্লস-এর এই লড়াকু ছাত্রী। তাঁর পরীক্ষার সিট পড়েছিল নিমপীঠ রামকৃষ্ণ সারদা বিদ্যামন্দির ফর গার্লস স্কুলে। সবাই তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সহযোগিতার হাত।

আরও পড়ুন-রাজ্যে আরও বাড়ছে ডাক্তারি আসন, বাংলায় আরও দুটি নয়া মেডিক্যাল কলেজ

ফিরে আসুন
ফল প্রকাশের পর অন্যান্য সফল ছাত্রছাত্রী যখন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করছেন, তখন কঠিন হয়ে উঠছে তিয়াসার লড়াই। চিকিৎসার খরচ নিয়ে চিন্তিত পরিবার। ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে। তাই উদ্বিগ্ন চিকিৎসকরাও। উচ্চশিক্ষা পরে, আপাতত পরিবারের প্রার্থনা, তিয়াসা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুন। যদিও তিয়াসা চাইছেন আরও পড়াশোনা করতে। তাঁর সাফল্যে খুশি স্কুল, গোটা এলাকা। সবার আশা, জীবনযুদ্ধে জয়ী হবেন এই লড়াকু মেয়ে।
########
শিরিন আলম
উচ্চমাধ্যমিকে অষ্টম
দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি। উত্তরবঙ্গের এই শহরের আসরাফ নগরের বাসিন্দা শিরিন, শিরিন আলম। শিলিগুড়ি গার্লস হাইস্কুলের ছাত্রী। এবার উচ্চমাধ্যমিকে অধিকার করেছেন অষ্টম স্থান। পেয়েছেন ৪৮৯ নম্বর। তাঁর সাফল্যে খুশি গোটা পরিবার এবং স্কুল। খুশি এলাকার বাসিন্দাও।
হতে চান আইএএস
মা-বাবা দু’জনেই জড়িয়ে রয়েছেন শিক্ষকতার সঙ্গে। বাবা ফাঁসিদেওয়ার বিধাননগরের মুরালিগছ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সামসুর আলম। পেয়েছেন শিক্ষারত্ন সম্মান। শিরিন ছোটবেলা থেকেই দারুণ মেধাবী। ক্লাস পরীক্ষায় বরাবর ভাল রেজাল্ট করে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘‘আমার সাফল্যে বড় ভূমিকা রয়েছে মা, বাবা, স্কুলের শিক্ষক এবং গৃহশিক্ষকদের। কোনও দিন পড়াশোনায় ফাঁকি দিইনি। টেস্টের পর দিনে ১২ ঘণ্টা পড়াশোনা করেছি। অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি বড়দের নির্দেশ, পরামর্শ।” কী হতে চান? শিরিন জানান, ‘‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চাই। ইউপিএসসি পরীক্ষায় বসে হতে চাই আইএএস।’’

আরও পড়ুন-মানুষের জন্যই এই গরমে পথে অভিষেক, প্রতিবাদসভায় দাবি কাকলির

########
সরস্বতী বাস্কে
সাক্ষাৎ সরস্বতী
উচ্চমাধ্যমিকে সাঁওতালি মাধ্যমে মেয়েদের জয়জয়কার। যুগ্মভাবে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন সরস্বতী বাস্কে। তাঁর প্রাপ্ত নম্বর ৪৭২। অর্থাৎ ৯৪.৪ শতাংশ। সরস্বতীর বাড়ি ঝাড়গ্রাম জেলার বিনপুর থানা এলাকার চাঁপাবনি গ্রামে। জঙ্গলমহলে। পড়তেন ঝাড়গ্রাম রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির একলব্য মডেল স্কুলে। সরস্বতীর সাফল্যে খুশি শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীরা। সকলেই আনন্দ মেতে উঠেছেন। বন্ধুদের বক্তব্য, রেজাল্ট ভাল হবে জানতাম। ও যে সাক্ষাৎ সরস্বতী!
শিক্ষিকা হতে চান
বাবা বিশ্বনাথ বাস্কে একজন দিনমজুর। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার। কোনওরকমে সংসার চালান। মেয়ের সাফল্য তাঁকে আনন্দ দিয়েছে। সরস্বতী ভূগোল নিয়ে লেখাপড়া করতে চান। ভবিষ্যতে হতে চান শিক্ষিকা। তিনি বলেন, ‘‘প্রথম স্থান অধিকার করে খুব ভাল লাগছে। অনেক লড়াই করে আমাকে উঠে আসতে হয়েছে। পেয়েছি পরিবার ও স্কুলের সাহায্য। আমাদের সমাজে মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার প্রবণতা আছে। এটা একেবারেই ঠিক নয়। নিজে লেখাপড়া করে বিষয়টা বুঝতে পেরেছি। মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে হবে। আমি শিক্ষিকা হয়ে এই কথাগুলো আমাদের সমাজের মেয়েদের কাছে তুলে ধরতে চাই। জানি, খুব কঠিন কাজ। তবে চেষ্টা চালিয়ে যাব।”

আরও পড়ুন-জাতীয় পতাকার অবমাননা, কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি তৃণমূলের, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বিরুদ্ধে এফআইআর

######
মৌসুমি টুডু
অভাব নিত্যসঙ্গী
জঙ্গলমহলের কন্যা মৌসুমি টুডু। বাড়ি বাঁকুড়া জেলার বারিকুল থানা এলাকার এক প্রত্যন্ত গ্রামে। বাবা গণেশ টুডু চাষের কাজ করে সংসার চালান। অভাব তাঁদের নিত্য সঙ্গী। তার মধ্যেও মৌসুমি সৃষ্টি করেছেন নজির। উচ্চমাধ্যমিকে সাঁওতালি মাধ্যমে যুগ্মভাবে অধিকার করেছেন প্রথম স্থান। এই সাফল্যে গর্বিত জেলাবাসী।
পুলিশ হতে চান
বাঁকুড়ায় বাড়ি হলেও তিনি পড়তেন ঝাড়গ্রাম রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির একলব্য মডেল স্কুলে। এই সাফল্যে খুশি স্কুল। তাঁর প্রাপ্ত নম্বর ৪৭২। অর্থাৎ ৯৪.৪ শতাংশ। মৌসুমি জানান, ‘‘দিনে ৪ ঘণ্টা পড়াশোনা করতাম। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলো ও নাচ করতেও ভালবাসি। ইংরেজি নিয়ে পড়তে চাই। হতে চাই পুলিশ। স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা, মহারাজ ও পরিবারের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তাঁরা পাশে না থাকলে এত ভাল রেজাল্ট করতে পারতাম না।”

আরও পড়ুন-বিকল টয়ট্রেনের ইঞ্জিন, স্বাভাবিক করলেন যাত্রীরা

######
ঈশিতা কিশোর
তৃতীয়বারে সাফল্য
প্রথম দু’বার ব্যর্থ হয়েছেন। ঘিরে ধরেছিল মনখারাপ। তবে হাল ছাড়েননি। আরও ডুবেছেন পড়াশোনায়। লড়াই করেছেন দাঁতে দাঁত চেপে। তারপর? বসেছিলেন তৃতীয়বার। অবশেষে আশাতীত সাফল্য ইউপিএসসি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায়। সারাদেশে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন ঈশিতা কিশোর। লিখিত পরীক্ষায় ৯০১ নম্বর এবং ইন্টারভিউতে ১৯৩ নম্বর পেয়েছেন। তাঁর মোট নম্বর ১০৯৪। ইউপিএসসি সিভিল সার্ভিসেস পরীক্ষায় ৫৪.০২% নম্বর পেয়েছেন। সর্বভারতীয় র্যা ঙ্কিং অনুসারে প্রথম স্থান। আপাতত ভাইরাল তাঁর মার্কশিট। নিজেও হয়ে উঠেছেন সোশ্যাল মিডিয়া সেনসেশন। ২৬ বছরের কন্যে চমকে দিয়েছেন সবাইকে। পরিবার, আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব, চেনাজানা প্রত্যেকেই খুশি।
ইন্টারভিউ রাউন্ডে
ইউপিএসসি পরীক্ষার জন্য যোগ্যতা অর্জনের তৃতীয় ধাপ ইন্টারভিউ পর্ব। এই প্রথম ইন্টারভিউ রাউন্ডের জন্য যোগ্যতা অর্জন করেছেন ঈশিতা। জানলে অবাক হবেন, প্রথম দুটি প্রচেষ্টায়, এমনকী ইউপিএসসি-র প্রিলিম পরীক্ষা পাশ করতে পারেননি তিনি। এই পরীক্ষার তিনটি ধাপ রয়েছে। তিনটি ধাপ পেরোলেই যোগ্যতা অর্জন করা যায়। এই ধাপগুলি হল প্রিলিম, মেন ও শেষে ইন্টারভিউ।

আরও পড়ুন-মোদির প্রকল্প সুপার ফ্লপ হল বাংলায়

পড়াশোনার পাশাপাশি
ঈশিতা অর্থনীতিতে স্নাতক। ২০১৭ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রীরাম কলেজ অফ কমার্স থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং-এর সঙ্গে ‘রিস্ক অ্যাডভাইজরি’ হিসাবে কাজ করেন। তবে শুধুমাত্র পড়াশোনার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। তিনি একজন জাতীয় স্তরের ফুটবলার। স্কুল থেকেই একজন ভাল অলরাউন্ডার পারফর্মার হিসাবে ঈশিতাকে চেনেন সবাই। নিয়মিত মাঠে যান। অনুশীলন করেন। খেলেন ম্যাচ। ২০১২ সালে সুব্রত টুর্নামেন্টে খেলেছিলেন। বাড়তি আকর্ষণ আছে মধুবনি শিল্পকর্মের প্রতি। ২০২২ সালের ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (ইউপিএসসি) সিভিল সার্ভিসেস পরীক্ষায় প্রথম হয়ে বুঝিয়ে দিলেন, যিনি রাঁধেন তিনি চুলও বাঁধেন।
শিক্ষিত পরিবার
বাবা ভারতীয় বায়ুসেনার অফিসার। মা বেসরকারি স্কুলে পড়াতেন। দাদা পেশায় আইনজীবী। ঈশিতা বলেন, ‘‘প্রথম হওয়ায় অত্যন্ত গর্ববোধ করছি। আমার স্বপ্ন সত্যি হল। এই সাফল্যের পিছনে বড় অবদান আছে পরিবারের। আমি তাঁদের কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। প্রথম দু’বার ইউপিএসসি সিভিল সার্ভিসেসের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারলেও পরিবারের সদস্যরা আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। বাড়িয়েছিলেন আমার মনোবল।”

আরও পড়ুন-বেআইনি নির্মাণ হলেই এবার জামিন-অযোগ্য ধারায় গ্রেফতার

তিনি আরও বলেন, ‘‘যথেষ্ট পরিশ্রম করেছি। সাফল্যের কোনও শর্টকাট নেই। ভাল ফল পেতে হলে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। এই পরীক্ষার জন্য দিনে আট থেকে নয় ঘণ্টা পড়াশোনা করেছি। পাশাপাশি করেছি অনেক স্বার্থত্যাগ।”
কী হতে চান?
ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস (আইএএস) অফিসার হতে চান। সাফল্য লাভের পর জানিয়েছেন ঈশিতা। তিনি বিহারের পাটনার মেয়ে। তবে বেছে নিতে চান উত্তরপ্রদেশের ক্যাডার। দিল্লি থেকেই স্কুল ও কলেজের পড়াশোনা শেষ করেছেন। আপাতত উত্তরপ্রদেশের গ্রেটার নয়ডায় থাকেন। তিনি চান, আইএএস অফিসার হয়ে মহিলাদের ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করতে।

আরও পড়ুন-উত্তরপ্রদেশে গণধর্ষণে মৃত কিশোরী অভিযুক্ত এক বিজেপি নেতা

######
গরিমা লোহিয়া
দ্বিতীয়বারেই সাফল্য
বিহারের বক্সারের একটি ছোট্ট জনপদে বাড়ি গরিমা লোহিয়ার। কিন্তু স্বপ্নপূরণের জন্য তিনি একদিন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন দিল্লির উদ্দেশ্যে। করেছেন কঠিন পরিশ্রম। সেই পরিশ্রমের ফল পেলেন হাতেনাতে। ইউপিএসসি পরীক্ষায় দেশের মধ্যে অর্জন করেছেন দ্বিতীয় স্থান। তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের কমার্স গ্র্যাজুয়েট। দ্বিতীয়বার এই সর্বভারতীয় পরীক্ষা দিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বারেই মুঠোয় পুরেছেন সাফল্য।
চোখে জল
রেজাল্ট দেখে তিনি চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি। আনন্দের পাশাপাশি তাঁকে ঘিরে ধরেছিল মনখারাপ। ২০১৫ সালে বাবা নারায়ণপ্রসাদ লোহিয়া প্রয়াত হয়েছেন। সুখের দিনে প্রয়াত বাবার কথা বারবার মনে পড়ছে তাঁর। তিনি মনে করেন, এই সাফল্যের পিছনে বাবার আশীর্বাদ রয়েছে। সবসময় বাবার ছবি সঙ্গে রাখতেন।

আরও পড়ুন-বিভেদ রাজনীতির অভিযোগ মুখ্যমন্ত্রীর, আদিবাসী-কুর্মিদের মধ্যে দাঙ্গা লাগাতে চায় বিজেপি

কোভিডের সময় সিদ্ধান্ত
গরিমা জানিয়েছেন, ‘‘কোভিডের লকডাউনের সময়ই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সিভিল সার্ভিসের জন্য প্রস্তুতি নেব। বাড়ি ফিরে নিজে পড়া শুরু করি। তারপর পড়া শুরু করি অনলাইনে। প্রথমবার প্রিলিতেও পাশ করতে পারিনি। এবার কঠোর পরিশ্রম করি। ভেবেছিলাম পাশ করব। কিন্তু দ্বিতীয় হব বুঝতে পারিনি।”
পাশে পরিবার
এই সাফল্যে বড় অবদান রয়েছে পরিবারের। বিশেষত মায়ের। গরিমা জানিয়েছেন, ‘‘আমি প্রতিদিন প্রায় ১৫ ঘণ্টা করে পড়তাম। কোচিংয়ের উপর ভরসা করিনি। প্রচুর বই পড়েছি, অনলাইন স্টাডি করেছি। গিয়েছি লাইব্রেরিতে। আমার পরিবার ও বন্ধুরা সবসময় পাশে ছিল। মা আমার সঙ্গে সবসময় জেগে থাকতেন। অর্থনৈতিক অভাব ছিল। তবে সেটা আমল দিইনি। মন দিয়ে পড়াশুনা করে গিয়েছি।’’
বিহারের জন্য
তাঁর এই সাফল্যে গর্বিত বিহার, গর্বিত গোটা দেশ। বক্সার থেকে মাধ্যমিক দিয়েছিলেন। তারপর তিনি বেনারস চলে যান। পরে দিল্লির কিরোরি মাল কলেজে ভর্তি হন। গরিমা বলেন, ‘‘আইএএস হতে চাই। বিহারের সেবা করতে চাই। কারণ আমি এখান থেকে অনেক কিছু পেয়েছি। চাই কিছুটা ফেরত দিতে।”

আরও পড়ুন-রেলের কাছ থেকে কোনও সাহায্য মেলেনি, পাশে ছিল রাজ্য, নিহতদের পরিবার প্রবল ক্ষুব্ধ

########
স্মৃতি মিশ্র
তৃতীয়বারের মাথায়
উত্তরপ্রদেশের মেয়ে স্মৃতি মিশ্র। ইউপিএসসি পরীক্ষায় দেশের মধ্যে অর্জন করেছেন চতুর্থ স্থান। তবে এক চান্সে পাননি সাফল্য। আগে দু’বার বসেছিলেন। তৃতীয়বারের মাথায় কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পেলেন। উত্তরপ্রদেশের বরেলি শহরের সেকেন্ড সার্কেলে পোস্টেড সিও রাজকুমার মিশ্রের মেয়ে স্মৃতি। রাজকুমার প্রয়াগরাজের বাসিন্দা। মেয়ে সারা দেশে চতুর্থ হয়েছেন শুনে নিজের খুশি চেপে রাখতে পারেননি।
জোরদার প্রস্তুতি
স্মৃতি বর্তমানে দিল্লি থেকে আইন নিয়ে পড়াশোনা করছেন। দিল্লিতে থেকেই নিয়েছিলেন পরীক্ষার প্রস্তুতি। স্নাতক শেষ করছেন দিল্লির মিরান্ডা কলেজ থেকে। এর আগে যে দু’বার পরীক্ষা দিয়েছিলেন তাতে ইন্টারভিউ পর্যন্ত পৌঁছতেই পারেননি। স্মৃতি বলেন, ‘‘এবার মেন-এর খুব জোরদার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। ইন্টারভিউ-ও খুব ভাল হয়েছিল। তবে চতুর্থ হব, ভাবিনি।”
জ্বলন্ত উদাহরণ
প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা পড়াশোনা করতেন। ছোটবেলা থেকেই আইএএস হওয়ার স্বপ্ন ছিল স্মৃতির। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। সেই লক্ষ্যে নিয়মিত পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন। নিজের পড়া নিজে পড়ে নোট তৈরি করে রাখতেন। নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকলে আর প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিলে যে কোনও লক্ষ্যই পূরণ হতে পারে, স্মৃতি প্রমাণ করেছেন। এই মুহূর্তে তিনি ভেসে যাচ্ছেন শুভেচ্ছা-বন্যায়।

আরও পড়ুন-‘ইমার্জেন্সি রোগীদের হাসপাতালের ভর্তির ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে একটি মেকানিজম’, মুখ্যসচিবকে নির্দেশ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের

#####
উমা হারাথি এন
বাবার জন্য
উমা হারাথি এন তেলেঙ্গানার মেয়ে। এবার ইউপিএসসি পরীক্ষায় দেশের মধ্যে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছেন। তাঁর বাবা নারায়ণপেট জেলার পুলিশ সুপার। এন বেঙ্কটেশ্বরালু। উমা নিজের সাফল্যের যাবতীয় কৃতিত্ব দিয়েছেন বাবাকেই। বলেছেন, ‘‘স্বপ্ন পূরণে পরিবার, পরিবারের পাশে থাকাটা খুবই জরুরি। এই পরীক্ষার জন্য প্রয়োজন সময়োপযোগী পারিবারিক সমর্থন। যা আমি পেয়েছি। তথ্য, বইপত্র তো হাতের মুঠোয়। অনলাইনে পাওয়া যায়। কিন্তু আবেগের সঙ্গ দিতে পরিবারকে পাশে প্রয়োজন। সেটা কোনওভাবেই অনলাইনে মেলে না।”
মেয়ের সাফল্যে গর্বিত পুলিশকর্তা বাবা। তিনি মনে করেন, দশ বছরের পরিকল্পিত পরিশ্রমের ফসল উমার এই ফল। একইসঙ্গে ভবিষ্যতের সিভিল সার্ভিস প্রত্যাশীদের পড়াশোনায় মনোযোগী হতে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। নিষেধ করেছেন সময় নষ্ট করতে।
পাঁচবারের চেষ্টায়
নিজের সিভিল সার্ভিস প্রস্তুতি চলাকালীন অনেক ব্যর্থতা দেখেছেন উমা। তবে ভেঙে পড়েননি। জীবনসংগ্রামে হেরে গিয়ে আত্মঘাতী হওয়ার মতো চরম পথ বেছে নেন যাঁরা, তাঁদের অনুপ্রেরণা জোগাবে উমার সাফল্য। তিনি বলেন, ‘‘কম বয়সিদের হতাশ হয়ে ভেঙে পড়া উচিত নয়। ধীরে ধীরে এগোতে হবে স্বপ্নপূরণের পথে। একবার অকৃতকার্য হওয়া মানেই সব শেষ নয়। লক্ষ্যে স্থির থাকলে স্বপ্ন ধরা দেবেই। আমি পাঁচবারের চেষ্টায় এই সাফল্য পেয়েছি।”

আরও পড়ুন-পাঁচ ঘণ্টার বৈঠকে তদন্ত শেষের আশ্বাস

ভুল থেকে শিক্ষা
তৃতীয় শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি। হায়দরাবাদের ভারতীয় বিদ্যাভবনে পড়েছেন উমা হারাথি। পরে ইন্টারমিডিয়েট পড়েন ব্রিজ কলেজে। সেখানে রাজ্যস্তরের মেধাতালিকাতেও ছিল তাঁর নাম। পরে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে যান আইআইটিতে। একইসঙ্গে চলতে থাকে সিভিল সার্ভিসের প্রস্তুতিও। পরীক্ষায় বসেন, ব্যর্থ হন। আবার বসেন। আবার ব্যর্থ হন। প্রতিবারই নিজের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছেন উমা। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন, ঘুরে দাঁড়িয়েছেন নতুন ভাবে। উমা মনে করেন, জীবনে ব্যর্থতা তো আসতেই পারে। নিজের উপর আস্থা থাকলে আশাহত হওয়ার কিছু নেই। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা। তাই অনুশীলনও হতে হবে সেই মাত্রায়। একইসঙ্গে তৈরি করতে হবে নিজের স্ট্র্যাটেজিও।

Latest article